সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশা

অন্যান্য অর্থনীতি এইমাত্র খুলনা চট্টগ্রাম জাতীয় জীবন-যাপন ঢাকা বরিশাল বানিজ্য ময়মনসিংহ রাজধানী রাজশাহী সারাদেশ

বড় বড় গর্ত মেরামতে চলছে জোড়াতালি

মহসীন আহমেদ স্বপন : সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোর বেহাল দশার কারণে আগামী দিনগুলোতে গোটা পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বর্ষা শুরুর আগে সরকারি হিসাবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়কের ৪ হাজার ২৪৭ কিলোমিটার খারাপ ছিল। এরপর ভারী বর্ষা ও বন্যায় তলিয়েছে অনেক সড়ক। চলছে জোড়াতালির মেরামতও। আসন্ন ঈদুল আজহায় যানবাহনের চাপ বেড়ে গেলে এই জোড়াতালির সড়ক ঘরমুখী মানুষকে কতটা স্বস্তি দিতে পারবে, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-টাঙ্গাইল বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক। এ সড়কে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৪টি জেলার যানবাহন চলাচল করে। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশব্যাপী বয়ে যাওয়া অতি বৃষ্টির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ মহাসড়কের উন্নয়ন কর্মকা-।
উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা অংশের প্রায় ২০০ মিটার এলাকাজুড়ে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
সামান্য বৃষ্টিতেই এসব গর্তে পানি জমছে। ফলে মহাসড়কটিতে চলাচলরত যানবাহন আর যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়ছেন। সড়ক দুর্ঘটনার শঙ্কায়ও বাড়ছে।
এ সমস্যা নিরসনে মহাসড়কের মেরামত কাজ শুরু করেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ কর্তৃপক্ষ। তবে ইটের জোড়াতালিতে চলছে মেরামত। কাজটি শুধুই ঈদ মৌসুমে কর্তৃপক্ষের টাকা লুটপাটের একটি তৎপরতা বলে অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ভোগান্তির শিকার পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন দেখা যায়, মহসড়কের এলেঙ্গা অংশের প্রায় ২০০ মিটার এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য বড় বড় গর্ত। গর্তে পানি জমে যাচ্ছে। ফলে মহাসড়কের এ অংশে গতি হারাচ্ছে বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন। সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।
দেখা গেছে, ইট দিয়ে গর্ত মেরামতের কাজ করছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের শ্রমিকরা। যদিও গাড়ির চাকা অথবা বৃষ্টির পানিতে নিমিষেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এসব মেরামত।
এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের চারদিকে গড়ে উঠেছে একাধিক ব্যাংক, বীমা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জনবহুল এ বাসস্ট্যান্ড দিয়ে প্রতিদিন হেঁটে চলা হাজার হাজার মানুষের ভোগান্তি এখন চরমে রূপ নিয়েছে।
ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গগামী হানিফ পরিবহনের বাসচালক কবির মিয়ার অভিযোগ, দেশের অন্যান্য মহাসড়কের কাজ দ্রুতগতিতে শেষ হলেও কাজের সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এ মহাসড়কের কাজ শেষ হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু সেতু ব্যবহারে এ মহাসড়কটি করা হলেও লক্ষ্যণীয় গুরুত্বই দেখা যাচ্ছে না। মহাসড়কে বিভিন্ন স্থানে দুই এক দিন পরপরই দেখা দিচ্ছে নতুন নতুন খানাখন্দ।
তিনি বলেন, মহাসড়কে অতি ব্যস্ততম এলেঙ্গার প্রায় ২০০ মিটার এলাকায় সৃষ্ট ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত পরিবহন সংশ্লিষ্টদের জীবনমরণ সমস্যা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঁদা ও খানাখন্দের ফলে এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে গাড়ি থামানোর মতো কোনো অবস্থায়ই নেই।
এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকার স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে এই অল্প জায়গার জন্য আমাদের প্রতিনিয়তই ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। বর্ষায় কাঁদা আর শুষ্ক মৌসুমের ধুলায় আমাদের জীবন আর জীবিকা নির্বাহ প্রায় বিপন্ন হতে বসেছে। এরপরও দুই দিন পরপর মহাসড়কে সৃষ্ট ভাঙন আর গর্ত মেরামতে লোক দেখানো ইট দিয়ে জোড়াতালির কাজ করা হচ্ছে, যা কয়েকদিনেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে সেই ভোগান্তির কোনো স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। এভাবে দেশের টাকা বিনষ্টের জোড়াতালির কাজ বন্ধ করে, স্থায়ী মেরামত করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে দায়িত্বরত টাঙ্গাইল ট্রাফিক পুলিশের টিএসআই রফিকুল ইসলাম জানান, ঢাকা-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে প্রতিদিন গড়ে ১৪-১৫ হাজার ছোটবড় যানবাহন চলাচল করে। তবে এই খানাখন্দের জন্যে এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে যানবাহনগুলো আসার পর একেবারে গতি কমিয়ে পারাপার হচ্ছে। এ কারণে সারিবদ্ধ পরিবহনে প্রায়ই সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। দ্রুত ওই যানজট নিরসনে যেমন বেড়েছে তাদের ভোগান্তি, তেমনি ওই ভোগান্তিতে পড়ছে যাত্রী ও পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।
তিনি জানান, এ মহাসড়কের ডিউটি ট্রাফিক বিভাগের সদস্যদের খুবই কষ্ট করতে হচ্ছে। অতি দ্রুতই মহাসড়কের সৃষ্ট সমস্যার স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন।
এলেঙ্গা পৌরসভার মেয়র নূর এ আলম সিদ্দিকী জানান, মহাসড়কের প্রবেশদ্বার এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের এ সমস্যার কথা টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনের একাধিক মিটিংয়ে বলেছি। মিটিং পরবর্তী সময়ে শুধু নিম্নমানের দায়সারা কাজ করার দায়িত্ব পালন করেছে সড়ক বিভাগ। তবে সঠিক কোনো সমাধান আসেনি। এ ক্ষেত্রে বলাই চলে জনগণের ভোগান্তিতে সড়ক বিভাগ কর্মকর্তাদের কি কোনো কষ্ট আছে?
এ প্রসঙ্গে টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আমিমুল এহসান জানান, কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিতে এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে সৃষ্ট হওয়া গর্ত সাময়িকভাবে ইট দিয়ে মেরামত করা হচ্ছে। যাতে যান চলাচল স্বাভাবিক থাকে। তবে এ সমস্যা নিরসনে এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকার ৩০০ মিটার রাস্তা পাকাকরণের কাজ খুব দ্রুতই শুরু হচ্ছে।
সওজের সমীক্ষা : বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়ক সওজের অধীনে। এগুলো জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক—এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। মোট সড়ক ২২ হাজার ৯১ কিলোমিটার। প্রতিবছর সওজ হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট মডিউল (এইচডিএম) পদ্ধতিতে সড়কের অবস্থা সমীক্ষা করে থাকে।
সর্বশেষ গত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ১৭ হাজার ৪৫২ কিলোমিটার সড়কের সমীক্ষা চালানো হয়েছে। প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় মে মাসে। সমীক্ষা প্রতিবেদনে ভালো, চলনসই, দুর্বল, খারাপ ও খুব খারাপ এই পাঁচ শ্রেণিতে সড়ক-মহাসড়ক ভাগ করা হয়। এইচডিএমের প্রতিবেদন বলছে, দেশের ২২ শতাংশ জাতীয় মহাসড়ক দুর্বল, খারাপ ও খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। অন্যদিকে আঞ্চলিক মহাসড়কের ২৩ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং ২৫ দশমিক ৬০ শতাংশ জেলা সড়ক খারাপ। তিন শ্রেণির সড়ক এক করে হিসাব করলে দেখা যায়, দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ২৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ খারাপ বা বেহাল।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, সওজে বড় প্রকল্পে মনোযোগ বেশি বলে মেরামতে মনোযোগ একটু কম। আর মেরামতকাজটাও হয় অর্থবছরের শেষের দিকে, বর্ষা মৌসুমে। বর্ষা মৌসুমে মেরামত টিকবে না এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, মেরামত করতে হবে শুষ্ক মৌসুমে, ভালোভাবে করতে হবে। আর নতুন সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে উপকরণ ব্যবহার এবং প্রযুক্তিগত কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন, সড়কের পিচ করার ক্ষেত্রে মডিফায়েড বিটুমিন ব্যবহার করা যায়। এই বিটুমিন ব্যবহার করা হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে উঁচুনিচু হয়ে গেছে, তা হয়তো হতো না।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *