সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন জীবনী ঢাকা সারাদেশ স্বাস্থ্য

*প্রধানমন্ত্রীর কড়া বার্তা, আক্রান্ত ১৫ জেলা
*অসাধুদের ব্যবসার হাতিয়ার ডেঙ্গু
*ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে
*২২ ঘন্টার বিল প্রায় ২ লাখ!
*ডেঙ্গু টেস্টের মূল্য নির্ধারণ
*বাড়ির পাশেই লার্ভা পুষছেন রাজধানীবাসী
*ব্যর্থ হয়ে সরকার ডেঙ্গুকেও গুজব বলছে

 

 মহসীন আহমেদ স্বপন : চলতি মাসজুড়ে রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকলেও সারাদেশে তার পরিমাণ ছিল যৎসামান্য। তবে গত কয়েকদিন ধরে ডেঙ্গুর প্রকোপ রাজধানী ঢাকা ছাড়িয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। রংপুর, খুলনা, শেরপুর, পাবনা, ফিরোজপুর, লক্ষীপুর, কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় বেশ কয়েকটি জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সনাক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে রাজধানী ঢাকার বাইরে দেশের ১৫ উপজেলায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২ শতাধিক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৪৯, খুলনা বিভাগে চলতি মাসের ২২ দিনে ৭১, রংপুরে ২১, পাবনায় ১২, বরিশালে ২৫ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়াও কক্সবাজারে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই মেয়রকে কড়া বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ বিষয়ে বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ও উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামকে প্রধানমন্ত্রী ডেঙ্গু নিধনে কার্যকরী ওষুধ প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন।
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ডেঙ্গু আতঙ্ক দূর করতে সারাদেশে সচেতনতামূলক সভা করবে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ শুধু বন্যার সময়েই নয়, বন্যা পরবর্তী সময়েও পুনর্বাসন পর্যন্ত বানভাসি মানুষের পাশে থাকবে।
চট্টগ্রাম : গত ১৫ দিনে চট্টগ্রামে হঠাৎ ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। কয়েকদিনের ব্যবধানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সিভিল সার্জন অফিসের হিসেবমতে, প্রতিদিন গড়ে পাঁচজন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে নগরীর সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৪৯ রোগী শনাক্ত করেছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। তাঁদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। জেলা সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী জানান, সর্বশেষ শুক্রবার সাতজন রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র আটজন। কিন্তু ২০ থেকে ২৬ জুলাই আক্রান্ত হয়েছেন ৩৮ জন। আর গত ছয় মাসে এ সংখ্যা ছিল মাত্র তিনজন। ফেনী : সদর হাসপাতালে গত ১৫ দিনে ৪৪ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২১ জন এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং ছয়জনকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। আর ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন একজন রোগী। অন্য চারজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এ জেলায় চিকিৎসা নেওয়াদের বেশির ভাগই রাজধানীতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা আবু তাহের পাটোয়ারী জানান, গত শনিবার পর্যন্ত ২১ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। মোট চিকিৎসা নিয়েছেন ৪৪ জন। জেলা সিভিল সার্জন ডা. নেয়াতুজ্জামান বলেন, এখন পর্যন্ত ফেনীতে কোনো এডিস মশার জীবাণু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়নি। এখানে যাঁরা চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাঁরা ঢাকা অথবা চট্টগ্রাম থেকে এ জীবাণু নিয়ে আসছেন।
রংপুর: গত আট দিনে ২১ রোগী রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আক্রান্তরা সবাই ঢাকায় থাকতেন। সেখানেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. সুলতান আহমেদ জানান, ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে তাঁরা আশঙ্কামুক্ত রয়েছেন।
খুলনা: বিভাগের খুলনা, যশোর, ঝিনাইদহ, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও বাগেরহাটে চলতি মাসের ২২ দিনে ৭১ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৪ জন, খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নয়জন ও গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনজন ভর্তি হয়েছেন। এ পর্যন্ত দুজন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেলেও স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, তাঁদের মৃত্যু যে ডেঙ্গুর কারণেই হয়েছে, তা নিশ্চিত না। সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি নয়জনই ঢাকা থেকে আসার পর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন বলে স্বাস্থ্য বিভাগ নিশ্চিত করেছে। খুলনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. ফেরদৌসী আক্তার বলেন, ৩ জুলাই বিভাগীয় পর্যায়ে ডেঙ্গু রোগের তথ্য সংরক্ষণের জন্য সেল খোলা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৭১ জন শনাক্ত হয়েছেন। ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আয়ুব আলী জানান, গত ১৩ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত সদর হাসপাতালে ১০ জন রোগী জ¦রে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছেন। পরে তাদের রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গুর জীবাণু ধরা পড়ে। এদের মধ্যে তিনজনকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়েছে এবং চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ছয়জন ও বাকি একজন সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এছাড়াও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন জেলার শৈলকুপা উপজেলার বিপ্রবকদিয়া গ্রামের দু’জন। ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে লিফলেট বিতরণ ও মৌখিকভাবে পরামর্শসহ আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান ডা. আয়ুব আলী।
শেরপুর: জেলা হাসপাতালে তিনজন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। তাঁরা সবাই ঢাকায় জ¦রে আক্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে হাসপাতালে ভর্তি হলে পরীক্ষায় এ রোগ ধরা পড়ে। সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক খাইরুল কবির সুমন বলেন, আমরা এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছি। দ্রুত ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা বেডের ব্যবস্থা করা হবে।
পাবনা: সদর হাসপাতালে চার দিনে ১২ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। আক্রান্তদের বেশির ভাগই ঢাকায় ছিলেন। তাঁরা জানান, রাজধানী থেকে ফেরার পরই জ¦রে আক্রান্ত হন এবং চিকিৎসকের কাছে গেলে রক্ত পরীক্ষা করে তাঁদের ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এসব রোগীর মধ্যে ছাত্র, ব্যবসায়ী এবং পরিবহন ও পোশাকশ্রমিক রয়েছেন। সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, আক্রান্তদের মধ্যে ১০ জন ঢাকায় অবস্থানকালে ডেঙ্গুর শিকার হয়েছেন। এর বাইরে স্থানীয় পর্যায়ে দুজন রোগীকে আমরা পেয়েছি। হাসপাতালের বহির্বিভাগেও কয়েকজন রোগী পাওয়া গেছে এবং তাদের ভর্তির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। পাবনার সিভিল সার্জন মেহেদী ইকবাল বলেন, আক্রান্তরা ঢাকা থেকে অসুস্থ হয়ে এসেছেন। যাঁরা ভর্তি আছেন, তাঁদের সঠিকভাবে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অনেকের উন্নতি হওয়ায় বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। আবার কেউ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
পিরোজপুর: স্বরূপকাঠি উপজেলায় একজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন বলে গত শনিবার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন। আক্রান্ত নুর ইসলাম রাহুতকাঠি গ্রামের বাসিন্দা। তাঁকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
লক্ষ্মীপুর: সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, গত শনিবার বিকেল পর্যন্ত ছয়জন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে গুরুতর অবস্থায় হোসেন আহমেদ নামে একজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। হোসেনের স্ত্রী ও স্বজনরা জানায়, তিনি চট্টগ্রামে ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করেন। গত ১০ দিন ধরে তাঁর প্রচ- জ¦র। বৃহস্পতিবার তাঁকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষতচিহ্ন দেখা দিয়েছে।
কক্সবাজার: জেলার মেধাবী ছাত্রী উকিনো নুশাং (১৯)-এর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ডেঙ্গু। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। গত শনিবার চিকিৎসকের পরামর্শে সদর হাসপাতাল থেকে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে বিকেলে তিনি মারা যান। সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. মহিউদ্দিন জানান, শুক্রবার রাতে পরীক্ষা করে উকিনোর মধ্যে ডেঙ্গুর জীবাণু পাওয়া যায়। তিনি আরো বলেন, এখন পর্যন্ত কক্সবাজারে বসবাসকারী কোনো ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়নি। যে কয়েকজন পাওয়া গেছে, তাঁরা সবাই ঢাকা থেকে জীবাণু নিয়ে এসেছেন।
বরিশাল: শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। শেবাচিম হাসপাতালে ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্তদের আলাদা কোনো জায়গার ব্যবস্থা না করা হলেও মেডিসিন ওয়ার্ডগুলোতেই সাধারণ রোগীদের সঙ্গেই তাদের চিকিৎসা চলছে। তবে এসব রোগীদের জন্য মশারিসহ সব ব্যবস্থাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করছে। পাশাপাশি পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হাসপাতাল থেকেই করা হচ্ছে। আর রোগীদের প্রতিনিয়ত খোঁজ-খবর নিচ্ছেন হাসপাতালের পরিচালকসহ বিভাগীয় প্রধানরা। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, শেবাচিম হাসপাতালে গতকাল রোববার সকাল পর্যন্ত ২৫ জন ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের মধ্যে ২০ পুরুষ ও ৫ নারী। গত শনিবার যার সংখ্যা ছিল মাত্র ১২ জন। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। গত ১৬ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত বরিশালে ৪২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৭ জন। এদিকে, শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের বরাত দিয়ে চিকিৎসকরা বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের বেশিরভাগ রোগী ঢাকা থেকে ডেঙ্গুর জীবাণু শরীরে বহন করে বরিশালে এসেছেন। শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. বাকির হোসেন বলেন, বরিশালে আগে ডেঙ্গুর উপস্থিতি না থাকলেও ঢাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তরা বরিশালে ফিরে আসায় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এ রোগ প্রতিরোধে বাড়ির আশে-পাশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাসহ রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা মাত্র চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম ঢাকার ১২টি সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল এবং ১৭টি বেসরকারি হাসপাতালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন হাসপাতালে দুই হাজার ৩২২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল। এর মধ্যে শুধু ২৫ জুলাই ভর্তি ছিল ৫৪৭ জন, আগের দিন যা ছিল ৫৬০ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ডেঙ্গুতে আটজন মারা গেছে। তবে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মতে এ সংখ্যা প্রায় ৩৩ জন।
ডেঙ্গু দমনে এবার আসছেন আন্তর্জাতিক মশা বিশেষজ্ঞ! : ‘মশা মারতে কামান দাগানো’ প্রচলিত এ প্রবাদটি কমবেশি সবারই জানা। ক্ষুদ্র ও নিরীহ প্রাণী মশা মারতে কামানের গোলার ব্যবহার রূপক অর্থে বহুল প্রচলিত। কিন্তু এবার সত্যি সত্যি ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা দমনে আন্তর্জাতিক মশা বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ সফরে আসছেন।
চলতি সপ্তাহে কিংবা আগামী সপ্তাহের মধ্যেই কমপক্ষে দুইজন আন্তর্জাতিক মশা বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ সফরে আসছেন এমন তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদের একজন আসছেন যুক্তরাজ্যের লন্ডন এবং অপরজন প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে।
লন্ডন থেকে যিনি আসছেন তিনি ‘ইনোভেটিভ মসকিটো’র উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠান ‘অক্সিটেক’র শীর্ষ কর্মকর্তা। অপরজন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক কার্যালয় (ভারত) থেকে আসছেন। তিনি একজন রোগতত্ত্ববিদ।
সম্প্রতি এডিস মশার প্রকোপ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় ও হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বাস্থ্য অধিদফতরে দুজন মশক বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ করে আনা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, এ মুহূর্তে মশকনিধন ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোনো উপায় নেই। যেকোনো উপায়ে এডিস মশা নিধন ও নির্মূলের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এ বিষয়টি চিন্তা করেই এ দুজন বিশেষজ্ঞকে দাওয়াত করে আনা হচ্ছে। তাদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে সন্তুষ্ট হলে সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে মশকনিধন ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লন্ডনের অক্সিটেক নামক প্রতিষ্ঠানটি গবেষণার মাধ্যমে এক ধরনের পরিবেশবান্ধব মশা উৎপাদন করে। সেগুলো ডেঙ্গুবাহী এডিস (স্ত্রী) মশার সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে নতুন মশার প্রজনন ঘটায়। নতুন জন্ম নেয়া মশা দুই সপ্তাহ পর এমনিতেই মরে যায়। পরবর্তীতে যত মশা জন্মাবে সেগুলো ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা হয়ে জন্মাবে না, ‘ভদ্র মশা’ হয়ে জন্মাবে। তবে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রায় পাঁচ মাস লেগে যায়।
অক্সিটেক নামক প্রতিষ্ঠানটির দাবি, ইনোভেটিভ মশার মাধ্যমে সাফল্য শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ। ওই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে আলোচনা করে সন্তুষ্ট হলে লন্ডন থেকে মশা আমদানি করা হতে পারে বলে জানা গেছে। অপরদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশকে মশকনিধনে কীভাবে সহায়তা করবে তার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ রোগতত্ত্ববিদ পাঠাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের কাছে জানতে চাইলে তিনি দুজন বিশেষজ্ঞের বাংলাদেশ সফরের কথা স্বীকার করলেও বিস্তারিত কিছু এ মুহূর্তে বলতে রাজি হননি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ইতিহাসে চলতি বছরে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৫২৮ জন ডেঙ্গু রোগী সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন; এটি নতুন রেকর্ড। গতকাল শনিবার (২৭ জুলাই) পর্যন্ত গত ২৭ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি কিছু রোগীর সংখ্যা আট হাজার ৩৮৪।


বিজ্ঞাপন

অসাধুদের ব্যবসার হাতিয়ার ডেঙ্গু : রাজধানীতে হঠাৎ করেই মহামারি আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু। ইতোমধ্যে ডেঙ্গু মশার ছোবলে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন। প্রতিদিন অনেকটাই স্রোতের মতো হাসপাতালে ছুটে আসছেন শিশুসহ সব বয়সের মানুষ। এসব ডেঙ্গু রোগীদের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতাল। এটাকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ব্যবসার ফাঁদ পেতেছে অসাধু চক্র। এই চক্রে হাসপাতালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে রয়েছে বিশেষ দালাল চক্র।
সরেজমিন হাসপাতালটি ঘুরে দেখা যায়, প্রতিদিন শত শত রোগী ভিড় করছেন এখানে। এদের বড় অংশ জ্বর নিয়ে আসছেন। আর জ্বর নিয়ে আসা এসব রোগীদের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার মধ্যে ডেঙ্গুর পরীক্ষার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। ফলে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার স্থল ও টাকা জমা দেয়ার স্থলেও ভিড় করছে শত শত মানুষ। এই ভিড়ের মধ্যেই অবস্থান করছেন দালাল চক্র।
চক্রটি রোগী বা রোগীর স্বজনকে বুঝিয়ে পরীক্ষার জন্য অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন অথবা মোটা অংকের কমিশনের মাধ্যমে মুগদা হাসপাতাল থেকেই পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। পরীক্ষার টাকা জমা দেয়া স্থলে দীর্ঘলাইন থাকায় অনেকে বাধ্য হয়ে এই দালাল চক্রের সহায়তা নিচ্ছেন। আর যারা দালাল চক্রের সহায়তা নিচ্ছেন না তারা ঘণ্টার পর ঘণ্ট দাঁড়িয়ে থেকেও টাকা জমা দিতে পারছেন না।
সম্প্রতি দেশের সকল সরকারি হাসপাতালে রোগীদের বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এর ফলে রোগীরা কোনো ধরনের ইউজার ফি ছাড়াই বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার সুযোগ পাওয়ার কথা। তবে মুগদা হাসপাতালে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন না রোগীরা।
ডেঙ্গুর প্রাথমিক পরীক্ষার জন্য রোগীদের দিতে হচ্ছে ৩০০ টাকা করে। তবে হাসপাতালটিতে আসা অধিকাংশ রোগীর ৩০০ টাকা দিয়েও ডেঙ্গু পরীক্ষা করার সুযোগ মিলছে না। দালাল ও হাসপাতালের অসাধু কর্মকর্তাদের চক্রে পড়ে ডেঙ্গুর প্রাথমিক পরীক্ষার জন্য রোগীদের গুনতে হচ্ছে ৫০০-৫৫০ টাকা। বাড়তি এই টাকা না দিলে ডেঙ্গুর যন্ত্রণার সঙ্গে হয়রানিও বেড়ে যাচ্ছে কয়েক গুণ।
অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে মুগদা হাসপাতালে দৌরাত্ম্য চালাচ্ছে এমন দালালের সংখ্যা প্রায় অর্ধশতাধিক। এ চক্রে যেমন পুরুষ আছে তেমনি আছে নারীরাও। তবে পুরুষদের থেকে নারী দালালদের বেশি সক্রিয়তা দেখা গেছে। এসব দালাল চক্রকে আবার রোগী ভাগিয়ে আনতে কমিশন দিচ্ছে কিছু অখ্যাত ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
মুগদা হাসপাতালে দৌরাত্ম্য চালানো দালালদের এক জন্য সালমা, যিনি মুগদা হাসপাতালের সামনে অবস্থিত সান ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড সেয়ার লিমিটেডের পক্ষে কাজ করছেন। প্রতিদিন সকালে এই নারী মুগদা হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় পরীক্ষার টাকা জমা দেয়ার ক্যাশ কাউন্টারের সামনে অবস্থান নেন।
রোগী সেজে কথা বললে সালমা নিজেকে মুগদা হাসপাতালের কর্মী বলে পরিচয় দেন। ডেঙ্গুর পরীক্ষার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে লাইনে দাঁড়িয়ে পরীক্ষা টাকা জমা দিতে লাগবে ৩০০ টাকা। তবে কী ভিড় সেটা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন! এখানে লাইনে দাঁড়িয়ে আপনার পক্ষে টাকা জমা দেয়া সম্ভব হবে না। হাসপাতালের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে টাকা জমা দিলে ৫০০ টাকা লাগবে। এত ঝামেলা না করে আপনি ডেঙ্গুর পরীক্ষা বাইরে থেকেও করাতে পারেন। বাইরে থেকে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করাতে আপনার ৬০০ টাকা লাগবে।
এ সময় এ প্রতিবেদক তাকে প্রশ্ন করেন-আপা, ডেঙ্গুর পরীক্ষা বাইরের কোথা থেকে করা যেতে পারে? উত্তরে তিনি বলেন, পাশেই ডায়াগনস্টিক স্টোর আছে। এরপর তিনি সান ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কেয়ার লিমিটেডের একটি ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দেন এবং বলেন, ওখানে গিয়ে তার পরিচয় দিতে।
এরপর কার্ডে থাকা মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে সালমার পরিচয় দিয়ে কথা বললে কাউন্টার থেকে একজন বলেন, ‘সালমা আমাদের লোক। কোনো সমস্যা নেই। আপনি স্লিপ নিয়ে আমাদের এখানে চলে আসেন, স্লিপ দেখলে আমরা বুঝতে পারব পরীক্ষা করতে কত টাকা লাগবে।
সালমার মতো দ্বিতীয় তলায় একই কাজ করা আর এক নারী সদস্য নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ভাই, এখানে আমাদের মতো প্রায় ৫০ জন আছেন। যারা বিভিন্ন ডায়াগনস্টিকের পক্ষে কাজ করেন। ডায়াগনস্টিকে পরীক্ষার জন্য রোগী পাঠানো হলে আমরা কিছু কমিশন পাই। আবার এখানে হাসপাতালের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ আছে। তাদের মাধ্যমে এখানেও আমরা দ্রুত পরীক্ষা করে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারি। এজন্য প্রতি রোগীকে দুইশ থেকে আড়াইশ টাকা বেশি দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ডায়াগনস্টিক সেন্টার আমাদেরকে এখান থেকে রোগী পাঠানোর দায়িত্ব দেয়ার পাশাপাশি হাসপাতালের কর্মকার্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখে। তাদেরকেও কমিশন দেয়। যে কারণে এই হাসপাতালে এসে সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজে পরীক্ষার টাকা জমা দেয়া সম্ভব হয় না। নিজে টাকা জমা দিতে হলে সকাল ৬-৭টার সময় এসে লাইনে দাঁড়াতে হবে। এরপর যারা আসেন তাদের পক্ষে আর টাকা জমা দেয়া সম্ভব হয় না। তবে কিছু বাড়তি টাকা দিলে আমরা ব্যবস্থা করে দেই।
মানিকনগর থেকে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করতে আসা মো. আসলাম মিয়া বলেন, সকাল সাড়ে ৮টার সময় এসে কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়াই। ১১টা বেজে গেলেও টাকা জমা দিতে ব্যর্থ হই। এরপর এই আপার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নারী) মাধ্যমে টাকা জমা দিয়েছি। এজন্য ৩০০ টাকার জায়গায় ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে। বাইরে পরীক্ষার জন্য তো আরও বেশি টাকা দিতে হবে। আর নিজে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টাকা জমা দিতে পারব কি না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। তাই বাধ্য হয়ে এটি করতে হয়েছে।
ক্যাশ কাউন্টারের এক কর্মকর্তা বলেন, ডেঙ্গুর পরীক্ষা ফ্রিতে করতে হবে এমন কোন নির্দেশনা আমরা পাইনি। নির্দেশনা পেলে তখন আমরা সেভাবে পদক্ষেপ নেব। আর এখন যে পরীক্ষার জন্য যে মূল্য তা আমরা বাইরে সাইনবোর্ডে লিখে ঝুলিয়ে দিয়েছি। বাড়তি টাকা নেয়ার সুযোগ নেই। আমাদের এখানে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যারা লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা দিতে পারবে, আমরা সবার টাকা নেব।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে: ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে। তাই ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক জানিয়েছেন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন।
রোববার সকালে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীদের দেখতে গিয়ে তিনি এ কথা জানান।
সাঈদ খোকন বলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় সকলের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এছাড়াও নগরবাসীকে সচেতন হওয়ার কথাও জানান তিনি।
এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ২১৭ জন। এছাড়াও হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে শিশু, মহিলা ও পুরুষ রোগী ভর্তি ২০৯ জন।

২২ ঘন্টার বিল প্রায় ২ লাখ!: ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২২ ঘণ্টা চিকিৎসাধীন থাকার পর অবশেষে মৃত্যু কাছে হার মানেন ঢাবির মেধাবী শিক্ষার্থী ফিরোজ কবীর স্বাধীন (২৫)। স্বাধীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফিন্যান্স বিভাগের ছাত্র ছিলেন। শুক্রবার (২৬ জুলাই) রাত সাড়ে ৯টার দিকে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এই ঢাবি শিক্ষার্থী। তবে স্বাধীনের চিকিৎসা খরচে হাসপাতালে বিলের কপিকে ঘিরে আলোচনা চলছে প্রায় সবার মুখে মুখে। ডেঙ্গে জ্বরে আক্রান্ত একজন রোগীর ২২ ঘন্টার চিকিৎসার খারচ বাবদ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৪৭৪ টাকা। তবে জানা গেছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে মৃত্যুর পর বিল কিছু কম রাখা হয়েছে। তবে কেন এত টাকা বিল আসলো তা নিয়ে ধোয়াশা আর সন্দেহ রয়েই যায়।
ফিরোজ কবীর স্বাধীনের ২২ ঘণ্টার চিকিৎসায় করা হাসপাতালের বিলে দেয়া তথ্যগুলো হলো, ওষুধ বাবদ ৩২ হাজার ৩২১ টাকা ৫১ পয়সা, ল্যাবরেটরি চার্জ ৭৩ হাজার ৮৩৬ টাকা, মেডিকেল হসপিটাল সাপ্লাইতে ১০ হাজার ২১৯ টাকা বিল ধরা হয়েছে। বাকি টাকা অন্যান্য কয়েকটি খাতে ধরা হয়েছে। মোট বিল দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৪৭৪ টাকা!
এ বিলের বিষয়ে স্বাধীনের পরিবার ও সহপাঠীদের থেকে যোগাযোগ করা হলে তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেনি স্কয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এমন বিল প্রসঙ্গে স্বাধীনের বড় ভাই মো. ফজলুল করীম অভিযোগ করেন, হাসপাতালগুলো রোগীদের অসহায়ত্ব নিয়ে ব্যবসা করছে।
তিনি গণমাধ্যমকে জানান একদিনও পার হয়নি আর এর ভেতর বিল উঠল দুই লাখ টাকার কাছাকাছি। তারা কী করলেন আমার ভাইয়ের জন্য যে চিকিৎসা খরচ এত হলো। তার পরও মনকে বোঝাতে পারতাম যদি আমার ভাইকে বাঁচানো যেত।
স্বাধীনের বড় বোনের স্বামী হুমায়ুন কবীর বলেন, স্কয়ার হাসপাতালে ২০-২১ ঘণ্টা চিকিৎসাধীন ছিল স্বাধীন। এই সময়ের মধ্যে বিল উঠল এক লাখ ৮৭ হাজার টাকা! হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, আইসিইউর বিল ৬০-৭০ হাজার টাকার মতো আসতে পারে। সেটি হিসাব করে উপস্থিত সময়ে আমরা ৫৭ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছিলাম তাদের। কিন্তু এখন এত টাকা বিলের হিসাব আমরা মেলাতে পারছি না।
মাত্র ২২ ঘণ্টায় কী করে এত টাকা বিল হলো, সে প্রশ্ন ছুড়েছেন স্বাধীনের পরিবারসহ তার সহপাঠীরা।
শরিফুল নামের এক সহপাঠী জানান স্বাধীনকে কত দামি ওষুধ দিয়েছিল তারা যে ওষুধ বাবদ ৩২ হাজার টাকা বিল করা হলো? সার্ভিস চার্জের নামে তারা রোগীর পরিজনদের গলা কাটছে।
স্বাধীনের পরিবার ও সহপাঠীদের এমন অভিযোগের ভিত্তিতে বিলের বিষয়ে জানতে গণমাধ্যমকর্মীরা স্কয়ার হাসপাতালের অভ্যর্থনা ডেস্কে গেলে এ বিষয়ে তারা কোনো বলতে পারবেন না বলে জানান।
পুরো বিষয়টি তৃতীয় তলায় বিলিং সেকশন দেখেন বলে জানান তারা। সে অনুযায়ী বিলিং সেকশনে গেলে তারা বলেন, হাসপাতাল থেকে কোনো ডকুমেন্টস দেয়া হয় না।
পরে সেখানে বিলের কপি দেখানো হলে তারা আবারও বলেন, এ বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারব না।
প্রসঙ্গত শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্বাধীনের মৃত্যু হয়। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তরিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে স্বাধীন এক সপ্তাহ ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন।
বৃহস্পতিবার ঢামেক হাসপাতাল থেকে স্কয়ার হাসপাতালে তাকে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তার মৃত্যু হয়।

ডেঙ্গু টেস্টের মূল্য নির্ধারণ : রাজধানীতে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ মোকাবিলায় প্রাইভেট হাসপাতাল- ক্লিনিক, ডায়াগনিস্টিক সেন্টারগুলোর পরিচালক-ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা’ সংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রোববার (২৮ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে স্বাস্থ্য ভবনের সম্মেলন কক্ষে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল অফিসার (হাসপাতাল) ডা. শাহ্ আলম সিদ্দিকী।
সভায় ডেঙ্গু টেস্টের মূল্য নির্ধারণসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। নি¤েœ এগুলো তুলে ধরা হলো:
১) ডেঙ্গু রোগ নির্ণয়ের জন্য টেস্টগুলোর মূল্য নি¤œরূপ হবে:
ক) ঘঝ১- ৫০০ টাকা (সর্বোচ্চ); পূর্বমূল্য ছিল ১২০০-২০০০ টাকা।
খ) ওমগ + ওমঊ অথবা ওমগ/ ওমঊ- ৫০০ টাকা (সর্বোচ্চ), যার পূর্বমূল্য ছিল ৮০০-১৬০০ টাকা
গ) ঈইঈ (জইঈ + ডইঈ + চষধঃবষবঃ + ঐবসধঃড়পৎরঃ)- ৪০০ টাকা (সর্বোচ্চ) যার পূর্বমূল্য ছিল ১০০০ টাকা।
এই মূল্য তালিকা রোববার থেকে কার্যকর হবে। পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত এই মূল্য তালিকা কার্যকর থাকবে।
২) সব প্রাইভেট হাসপাতাল-ডায়াগনিস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য একটি ‘ওয়ান স্টপ সেন্টার’ চালু করবে।
৩) সব হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে।
৪) ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যার অনুপাতে ডাক্তার, নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবল বৃদ্ধি করা হবে।

বাড়ির পাশেই লার্ভা পুষছেন অসচেতন রাজধানীবাসী : সব রেকর্ড ছাপিয়েছে ডেঙ্গু, তবু ঘুম ভাঙ্গেনি রাজধানীবাসীর। অভিজাত এলাকায় ঘুরে দেখা যায় বাড়ির আশপাশে এখনো এডিসের বংশ বৃদ্ধির সহায়ক পরিবেশ। নিজেদের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে সাধারণ মানুষের সহায়তা চাইলো সিটি করপোরেশন। এদিকে, রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাওয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সর্বস্তরে সচেতনতা তৈরি না হলে ডেঙ্গু মোকাবিলা সম্ভব নয়।
এ যেন হ্যাচারিতে করে রেনুপোনা উৎপাদনের মতো এডিসের লার্ভা চাষ। কয়েক’শ গজ সামনে ন্যাম ভবন। কয়েকদিন আগে সিটি করপোরেশন সতর্ক করে দিলেও দৃশ্যপট বদলায়নি এতটুকু।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তথ্য মতে, পুরো মশক নিধনে ফগার মেশিনের সংখ্যা ৩শ ৮টি আর মশক কর্মী ৪শ ২৯ জন। অন্যদিকে উত্তরে ৩শ ২২টি ফগারের বিপরীতে মশক কর্মী আড়াইশো জন। এই সীমাবদ্ধতায় আড়াই কোটির ঢাকায় নিজেদের অসহায় বলছে সিটি করপোরেশন।
ডিএসসিসি-র প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন বলেন, আমি স্বীকার করছি যে অভিযোগ আছে সমস্ত জায়গায় আমাদের লোকজন যেতে পারে না, কিন্তু এই অবস্থা যদি প্রত্যেকটা জায়গায় থাকে তাহলে আমার কর্মীরা ওষুধ দিলেও আমি জানি না কতটুকু উন্নতি হবে।
নগরজুড়ে এমন লার্ভার আধারের প্রভাব পড়ছে হাসপাতালগুলোতে। শয্যা সংকট চরমে আবার সরকারি হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই হচ্ছে বারান্দায় আর মেঝেতে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে বাহক মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরিস্থিতি হবে আরো ভয়াবহ।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, এডিস মশার বংশ বিস্তার কন্ট্রোল হলো সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব, আর প্রিভেনশন-প্রোটেকশানের দায়িত্ব জনগণের। অতএব এর জন্য দরকার সমন্বিত উদ্যোগ।
ডেঙ্গুতে প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মৃত্যুর সংখ্যা আটজনেই আটকে আছে।

ব্যর্থ হয়ে সরকার ডেঙ্গুকেও গুজব বলছে: ডেঙ্গুর ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে সরকার মশাবাহিত এই রোগের প্রাদুর্ভাবকেও গুজব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে বলে অভিযোগ এসেছে বিএনপির তরফ থেকে। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল রোববার নয়া পল্টনের দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বর্তমানে যেকোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় গুজব। তারা ডেঙ্গু দমনে ব্যর্থ হয়ে এখন ছেলেধরা গুজবের মতো ডেঙ্গু জ¦রকেও গুজব বলছে। এ বছর ঢাকায় ব্যাপক হারে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের মধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলার হাসপাতালেও বেড়ে চলেছে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। গত সপ্তাহে প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্তের সংখ্যা এরইমধ্যে সাড়ে তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ডেঙ্গু নিয়ে মানুষের উৎকণ্ঠার মধ্যেই গত ২৫ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন অভিযোগ করেন, ছেলে ধরা, সাড়ে তিন লাখ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত একই সূত্রে গাঁথা। সরকার দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞ, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই ষড়যন্ত্রকারীদেরা মোকাবেলা করবে। ডেঙ্গু রোগীদের পাশে থেকে কঠিন জেবাব দেওয়ার জন্য সরকার প্রতিজ্ঞ। রিজভী বলেন, ডেঙ্গুতে মানুষ মরছে, মরছে চিকিৎসক, মরছে শিশুসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা। এ পর্যন্ত একজন সিভিল সার্জনসহ কয়েকজন ডাক্তার মারা গেছেন ডেঙ্গুতে। আর সরকারি দলের নেতাসহ মেয়ররা জনগণকে ধমক দিচ্ছেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *