*উত্তরে ২৩-দক্ষিণের ৩৭ ওয়ার্ড মারাত্মক ঝুঁকিতে
*ঢামেকের রোগীর ৮০ ভাগ ঢাবি শিক্ষার্থী
*ঢাকার বাইরে ৬১১ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত
*২৯ জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত
মহসীন আহমেদ স্বপন : রাজধানীতে ভয়ঙ্কর আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেঙ্গু। এডিস মশার ছোবলে প্রতিদিন শিশুসহ কয়েকশ নারী-পুরুষ হাসপাতালে ছুটছেন। হাসপাতালের বেড অথবা ফ্লোরে শুয়ে চিকিৎসা নিলেও ডেঙ্গু মশার বিষের যন্ত্রণা থেকে সহজে পরিত্রাণ মিলছে না। যন্ত্রণায় হাসপাতালেই কাতরাচ্ছেন কোমলমতি শিশুরা। আদরের সন্তানকে যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখে কাঁদছেন বাবা-মাও।
রাজধানীতে মহামারি আকার ধারণ করা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১০ হাজারেও বেশি। দিন যত যাচ্ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা তত বাড়ছে। ফলে চাপ বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে। এত রোগীদের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে অধিকাংশ হাসপাতাল।
রোগীদের বেড দিতে পারছে না অধিকাংশ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকেই বাঁচার আশায় হাসপাতালের ফ্লোরে বিছানা পেতে অবস্থান নিচ্ছেন। ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিতে ফ্লোরে আবস্থান নেয়াদের মধ্যে যেমন বয়স্করা রয়েছেন, তেমনি রয়েছে শিশুরা।
রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের দুই শতাধিক নারী-পুরুষ ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা অর্ধশতাধিক। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু রোগীদের এই চাপ সামাল দিতে হাসপাতালের অষ্টম তলার ফ্লোরেও ভর্তি রেখে চিকিৎসা সুবিধা দেয়া হচ্ছে।
চিকিৎসা সুবিধা পেলেও ডেঙ্গুর যন্ত্রণায় হাসপাতালের ফ্লোরে শুয়ে কাতরাচ্ছে অনেক শিশু। কেউ কেউ বমিও করছে। যে শিশুটি কিছুদিন আগেও দুরন্তপনায় সারা ঘর মাতিয়ে রাখত, সেই এখন ব্যথায় কাঁতর। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাটছে দিন। দুরন্তপনায় মেতে ওঠা তো দূরের কথা মুখ দিয়ে ঠিকমতো কথাও বের হচ্ছে না। আদরের শিশুর এমন অবস্থায় চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না বাবা-মা।
সন্তানকে নিয়ে তিন দিন ধরে হাসপাতালে রয়েছেন ফাতেমা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, বাবুর খুব জ্বর। তিন দিন ধরে এই হাসপাতালে আছি। জ্বর কমছে না। ব্যথায় বাবু ছটফট করছে। ছেলের এমন অবস্থা দেখে কোনো মা কি ঠিক থাকতে পারে? এতটুকু শরীরে ও এত যন্ত্রণা কীভাবে সহ্য করবে? ওর আব্বু তো ছেলের দিকে তাকাতেই পারে না। ছেলের মলিন মুখ দেখে নীরবে কাঁদে।
তিনি বলেন, আল্লাহ্ যদি ওকে এই যন্ত্রণা না দিয়ে আমাদের দিত তাও সহ্য করা যেত। আমাদের একটাই সন্তান। রাতে ওর আব্বু, আমি কেউ ঘুমাতে পারি না। একটু চোখ বুজে আসলেই আবার ছটফট করে উঠে পড়ে। কবে যে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব? ছেলের এই যন্ত্রণা তো আর সহ্য করতে পারছি না।
নারায়ণগঞ্জ থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলেকে নিয়ে মুগদা হাসপাতালে আসা খায়রুল বলেন, গত শুক্রবার বাবুর ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। এখন কিছুটা ভালো। কিন্তু গায়ে প্রচ- ব্যথা রয়েছে। বাবু এখনো ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না। ব্যথায় কাতরাচ্ছে। ওর মা তো সারাদিনই ছেলের জন্য কান্নাকাটি করে। আমি সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু মায়ের মন তো সহজে মানে না।
তিনি বলেন, জ্বরে পড়ার আগে আমাদের ছেলে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সারাক্ষণ এ ঘর ও ঘরে ছুটে বেড়াত। এক মিনিটের জন্যও স্থির থাকত না। সারাক্ষণ ওর দুরন্তপনায় পুরো ঘর মেতে থাকত। সেই ছেলে এখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে, এটা কে সহ্য করতে পারে বলেন?
মশা নিধনে কর্তৃপক্ষের ভূমিকায় সন্তুষ্ট নন এই মা। অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, আমরা এত কিছু করছি। দেশ ডিজিটাল হয়েছে। কিন্তু মশার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারছি না-এটা কেমন কথা? প্রতিদিন হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সবারই আমার মতো অবস্থা। যার সন্তান অসুস্থ হয়, সে বোঝে কী জ্বালা! দোয়া করি আর কারও সন্তান যেন আমার সন্তানের মতো অবস্থায় না পড়ে।
কোমলমতি শিশুদের যন্ত্রণায় বাবা-মার পাশাপাশি কষ্ট পাচ্ছেন নার্সরাও। হাসপাতালের অষ্টম তলায় দায়িত্ব পালন করা এক নার্স বলেন, প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে নতুন নতুন শিশু ভর্তি হচ্ছে। ডেঙ্গুর যন্ত্রণায় শিশুদের ছটফট দেখে আমাদের মনও কেঁদে উঠছে। বড়রাই ডেঙ্গুর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না, এত ছোট বাচ্চারা এই যন্ত্রণা কীভাবে সহ্য করবে?
তিনি বলেন, আমরা স্বাভাবিক থেকে সেবা দিচ্ছি ঠিক আছে, কিন্তু আমাদেরও তো মন আছে। মনের ভেতর যেমন ভয় আছে, তেমনি প্রতিনিয়ত চাপা কান্না রয়েছে।
উত্তরে ২৩-দক্ষিণের ৩৭ ওয়ার্ড মারাত্মক ঝুঁকিতে : ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২৩টি ও দক্ষিণের ৩৭টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুর মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে বলে উঠে এসেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে। চলতি বর্ষা মৌসুমে করা রিপোর্টে এই ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে যা বর্ষার আগে করা জরিপের চেয়ে কয়েকদিন বেশি। মশা নিধনে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগই এমন অবস্থার জন্য দায়ী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যার ভয়াবহ প্রভাবের আশঙ্কা করছেন তারা।
রাজধানীতে মশার ঘনত্ব নির্ণয়ে ১৮ থেকে ২৭ জুলাই বর্ষা মৌসুমের জরিপ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মোট ১২টি টিম উত্তরের ৪০টি ও দক্ষিণের ৫৮টি ওয়ার্ডের উপর এই জরিপ পরিচালনা করে। বর্ষার আগে করা জরিপে এই তালিকায় সাতটি ওয়ার্ড থাকলেও এবারে উত্তরে তা তিনগুণ যার মধ্যে ১৮, ১৯, ২১, ২৩ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের অবস্থা ভয়াবহ। অন্যদিকে বর্ষার আগের জরিপে দক্ষিণের ১৫টি ওয়ার্ড ঝুঁকিপূর্ণ থাকলেও এবারের এই তালিকায় রয়েছে ৩৭ টি ওয়ার্ড। এগারোটি ওয়ার্ডে মশার ঘনত্ব শূন্য।
জরিপে উঠে আসে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৫৮.৫৩ শতাংশ এবং দক্ষিণের ৬২.৭২ শতাংশ এলাকাতেই মশার ঘনত্ব অস্বাভাবিক হারে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশক নিধনে সিটি কর্পোরেশনের খামখেয়ালীপনাতেই ঘটছে এমনটা। আর এ জন্য সাধারণ মানুষকে চরম মূল্য দিতে হবে বলেও মনে করেন তারা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, আমরা যে পদক্ষেপ নিচ্ছি তা কার্যকরী হলে ডেঙ্গু এই পরিস্থিতিতে আসতো না। কাজেই বোঝা যাচ্ছে এ নিয়ে উদ্যোগ সমন্বিত না।
নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে সিটি কর্পোরেশনের সেই গতানুগতিক আশ্বাস।
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মমেনুর রহমান মামুন বলেন, আমরা যে পদক্ষেপগুলো নিচ্ছি সেগুলো বাদে আরও কি করার আছে তা নিয়ে আমরা চিন্তা করছি।
সব রেকর্ড ছাপিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়েছে।
ঢামেকের রোগীর ৮০ ভাগ ঢাবি শিক্ষার্থী : ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ডেঙ্গু সন্দেহে রক্ত পরীক্ষা করতে যাওয়া রোগীর ৮০ শতাংশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের এক চিকিৎসক। গত কয়েকদিন যাবত প্রতিদিনই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হল থেকে জ্বরাক্রান্ত ছাত্র-ছাত্রীরা ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে ছুটছেন।
বিশেষ করে মাত্র কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের ছাত্র ফিরোজ কবির স্বাধীন নামে এক শিক্ষার্থী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডেঙ্গু ভীতি দেখা দিয়েছে।
সামান্য জ্বর হলেই চিকিৎসকের কাছে ছুটছেন তারা। প্রথমবার রক্ত পরীক্ষায় নেগেটিভ এলেও অনেকেই আতঙ্কে দ্বিতীয়বার রক্ত পরীক্ষা করাচ্ছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের শিক্ষক মো. আনিসুর রহমান সোমবার বলেন, বর্তমানে ঢামেক ভাইরোলজি বিভাগের ল্যাবরেটরিতে প্রতিদিন গড়ে ৯০ থেকে ১০০ জন জ্বরের রোগী ডেঙ্গু পরীক্ষা করাচ্ছেন। এ সব রোগীর ৮০ শতাংশই ঢাবি শিক্ষার্থী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলগুলোতে যত্রতত্র ডেঙ্গু মশার প্রজননের সহায়ক উপাদান রয়েছে উল্লেখ করে তিনি ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে ডেঙ্গু মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সরেজমিনে দেখা গেছে ঢামেকের চতুর্থ তলায় ভাইরোলজি ল্যাবরেটরিতে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে আসা রোগীদের লম্বা লাইন। কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, অনেকেই ভয়ের কারণে সামান্য জ্বর অথবা শরীর ম্যাজ ম্যাজ করলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে আসছেন।
ঢাবির মহসীন হলের শিক্ষার্থী আজম জানান, গত ৪দিন যাবত জ্বরে ভুগছেন। জ্বর ওঠার পরদিন ডেঙ্গু পরীক্ষা করলেও তা নেগেটিভ আসে। আজ আবার রক্ত দিয়ে যাচ্ছেন। কাল ফলাফল হাতে পাবেন। চারদিকে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে এ সংবাদে ভীত হয় দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করাচ্ছেন তিনি।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অবনতির শঙ্কা : আগামী সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। নভেম্বর পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা থাকবে। এতে করে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, পরিস্থিতি মহামারীতে রূপ নেওয়ার আগেই পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে ডেঙ্গু নিয়ে জনসচেনতামূলক কর্মসূচি বাড়ানোর জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমাদের দেশে সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। তবে এবার ডেঙ্গু আগেই চলে এসেছে। এজন্য রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। এসব কারণে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এমন প্রশ্নের উত্তরে মহাপরিচালক জানান, আমরা জনসচেনতার ওপর জোর দিচ্ছি সবচেয়ে বেশি। এছাড়া সরকারের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে আমাদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি সরকারের যেসব দফতর এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাদেরও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। নইলে নিয়ম অনুযায়ী সামনে ডেঙ্গুর সিজন আমাদের জন্য ভয়াবহ বির্পযয় ডেকে আনতে পারে।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও বিএসএমএমইউয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ জানান, বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর বিস্তার সবচেয়ে বেশি হয়। এডিস মশা নর্দমা, বাসাবাড়িতে থাকা চৌবাচ্চাসহ যেসব স্থানে পানি জমে থাকে, সেসব স্থানে প্রজনন করে। চক্রাকারে প্রজাতির বিস্তার ঘটায়।
তিনি বলেন, আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস ডেঙ্গু বিস্তারের সবচেয়ে উপযোগী সময়। কারণ এ সময় থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হয়। আর জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তারের সুযোগ তৈরি হয়। তাই আগামী সেপ্টেম্বর পর্য়ন্ত আমাদের ভয় বেশি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত বছরগুলোতে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি দেখা গেছে। কারণ ওই দুই মাসে বৃষ্টি বেশি হয়। বর্ষায় এডিস মশার প্রজনন ক্ষমতা চক্রাকার হারে বাড়ে। আর থেমে থেমে থেমে বৃষ্টি হলে নালা-নর্দমায় জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তারের সুযোগও পায় বেশি। কিন্তু এবার বর্ষা আগে আসার কারণে জুলাইয়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে। সেপ্টেম্বর নাগাদ এই প্রাদুর্ভাব আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
জানা গেছে, গত বছর চিকুনগুনিয়ার পর স্বাস্থ্য অধিদফতর ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ে পৃথক পৃথক পর্যালোচনা করে। এই পর্যালোচনায় চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। এ নিয়ে আগাম প্রস্তুতি হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদফতর সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মশালা ও কার্যক্রম হাতে নেয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে আগাম সর্তকতার কথা বলা হলেও সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য সংস্থাগুলো এসব আমলে নেয়নি। যে কারণে এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতিও প্রায় মহামারী আকার ধারণ করেছে।
রাজধানীর বাইরের ৯০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী ঢাকা থেকে যাওয়া : অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত রোববার পর্যন্ত দেশে ১১ হাজার ৬৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৮ জন। শুধু তাই নয়, বর্তমানে ডেঙ্গু রোগী ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকার বাইরে। এখন পর্যন্ত ঢাকার বাইরে ৬১১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা গেছে।
সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. সানিয়া তাহমিনা।
ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়াকে চিন্তার বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ঢাকার বাইরে যত রোগী পাওয়া গেছে, আমি বলব ৯০ শতাংশ রোগী ঢাকা থেকে গেছে। তারপরও আমি আত্ম-সন্তুষ্ট থাকতে চাই না। কারণ তারপরও ওই রোগীগুলো থেকে ডেঙ্গু ছড়াবে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর সম্পূর্ণভাবে সতর্ক রয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
সানিয়া তাহমিনা বলেন, জেলাগুলোতে ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে আজ কিট (এক ধরনের ডিভাইস) পাঠানো হচ্ছে। সেখান থেকেও যেন এটা কোনোভাবে ছড়িয়ে না যায়, সে বিষয়েও আমরা সতর্ক থাকার জন্য চেষ্টা করছি।
বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে ডেঙ্গুর ফি নির্ধারণের বিষয়ে সানিয়া বলেন, ডেঙ্গুর জন্য যে ৪টা পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয়, এগুলো করতে মোট ১৪০০ টাকা লাগবে। এই টাকা ঠিকমতো রাখা হচ্ছে কি-না, তা তদারকির জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে মনিটরিং শুরু হয়েছে। ১০টা টিম গঠন করে এই মনিটরিং শুরু হয়েছে রবিবার থেকে।
সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরগুলোকে ইতোমধ্যে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এই কর্মকর্তার ভাষ্য, এসব জায়গায় জ্বরের রোগী পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে সেখানে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে। যারা আসবেন, তাদের সবাইকে স্বাস্থ্য বার্তা সম্বলিত পোস্টার, লিফলেট প্রদান করা হবে।
রোববার সব সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিন্সিপালদের স্বাস্থ্য অধিদফতরে ডাকা হয়। এ বিষয়ে সানিয়া তাহমিনা বলেন, তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) সারা ঢাকা শহরকে অঞ্চলভিত্তিক ভাগে শনাক্ত করা হবে। পরে সেসব অঞ্চলের সব স্কুল-কলেজে প্রচার ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এজন্য মেডিকেল কলেজের শিক্ষকরা টিম গঠন করবেন এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর তাদের কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে।
বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৯২১ জন বলেও জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের এ কর্মকর্তা।
ঢাকার বাইরে ৬১১ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত : ঢাকার বাইরে ৬১১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. সানিয়া তহমিনা। তিনি বলছেন, বিষয়টি উদ্বেগজনক। ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।
ডা. সানিয়া তহমিনা বলছিলেন, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু ছড়িয়ে যাওয়া ঠেকাতে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আজকে থেকে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট (ডিভাইস) ঢাকার বাইরে পাঠানো হচ্ছে। শাহজালাল বিমানবন্দর, বেনাপোল, চট্টগ্রামে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থার পাশাপাশি সচেতনতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, রোববার স্বাস্থ্য অধিদফতর বেসরকারি হাসপাটাল, ক্লিনিকগুলোর জন্য যে মূল্য নির্ধারণ করছে, তা পালন করা হচ্ছে কি না, তা তদারকি করার জন্য ১০টি মনিটরিং টিম কাজ করছে।
২৯ জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত : ঢাকার বাইরে ২৯ জেলায় শনাক্ত হয়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। তাদের স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদের বেশিরভাগই রাজধানী থেকে গিয়েছেন বলে জানা গেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, ঢাকার বাইরে এ পর্যন্ত ৬১১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলেও জানায় সংস্থাটি।
বরিশাল: বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। সোমবার ৩০ জন নতুন রোগীর শরীরে ডেঙ্গুর জীবাণু পাওয়া গেছে। ডেঙ্গুতে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ চিকিৎসকদের।
বগুড়া: বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৩৬ জন ডেঙ্গু রোগী। এদের মধ্যে ৯ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আলাদা, ওয়ার্ড, হেল্প ডেস্কসহ সব ধরণের ব্যবস্থা নিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
চাঁদপুর: চাঁদপুর সদর হাসপাতালে ২১জন রোগী ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রয়েছেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ঢাকা অসুস্থ হয়ে গ্রামের বাড়ি যান। ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসার পাশাপাশি তরল জাতীয় খাবারের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
চাঁদপুর সদর হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান ডা. ছালেহ আহমেদ বলেন, এখনও পর্যন্ত যারা ভর্তি হয়েছেন তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা একটু খারাপ।
মাদারীপুর: মাদারীপুরে এ পর্যন্ত ১৫ জন আক্রান্তের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া সিরাজগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, দিনাজপুর, মৌলভীবাজার, টাঙ্গাইলসহ ২০টিরও বেশি জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে এ পর্যন্ত রাজধানীর বাইরে ৬১১ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে তারা। ডেঙ্গু পরীক্ষায় সরকার নির্ধারিত ফি আদায় করা হচ্ছে কিনা সেটি মনিটরিংয়ে ১০টি টিম কাজ করছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।