ভাড়া নিয়ে তর্কাতর্কি

বিশেষ প্রতিবেদন

অবৈধ ওয়েবিল টিকিয়ে রাখার পাঁয়তারা

 

নিজস্ব প্রতবিদেক : নব্য ভাড়ায় সীমাহীন বিপাকে পড়েছেন গণপরিবহনের যাত্রীরা। ডিজেলের দাম বাড়ার অজুহাতে রাতারাতি গ্যাসচালিত বাস ডিজেলচালিত বনে গেছে। আর সব বাসেই আদায় হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। গতকাল থেকে অবৈধ ওয়েবিল, সিটিং সার্ভিস ও গেটলক সার্ভিস বন্ধ হওয়ার কথা থাকলেও তা এখনো কাজীর গরু। কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। তবে এসব গালভরা নামে যেসব অবৈধ পদ্ধতি পরিবহন খাতে রাজত্ব করছে এবং যাত্রীদের পকেট কাটছে, তার বিরুদ্ধে দেরিতে হলেও মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিভিন্ন বাস ও বিভিন্ন সেবা না দিয়ে উন্নত বিশ্বের কার্যক্রম অনুসরণ করে সরকারিভাবে একই ধরনের বাস পুরো রাজধানীতে চালু করা যেতে পারে।
ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণে গত ৭ নভেম্বর ঢাকায় ডিজেলচালিত বড় বাসে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ২ টাকা ১৫ পয়সা ও মিনিবাসে ২ টাকা ৫ পয়সা নির্ধারণ করে দেয় বিআরটিএ। বড় বাসে সর্বনি¤œ ভাড়া ঠিক করা হয় ১০ টাকা, মিনিবাসে ৮ টাকা। যেসব বাস সিএনজিতে চলে, সেগুলোর ভাড়া বাড়বে না।
গত কয়েক দিন ধরে পরিবহনের বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধে মাঠে আছে বিআরটিএর ভ্রাম্যামাণ আদালত। সড়কে চলমান গাড়ি আটকে যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। বাড়তি ভাড়ার অভিযোগ পেলেই করা হচ্ছে জরিমানা। তবুও বাড়তি ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য থেমে নেই।
পরিবহন শ্রমিকদের খামখেয়ালিপনায় বিরক্ত যাত্রীরা। ভাড়া বৃদ্ধির দিন থেকে অনেকটা নড়েচড়ে বসেছেন নগরবাসী। এখন বাড়তি ভাড়া চাইলেই চালক ও চালকের সহকারীর ওপর রেগে যাচ্ছেন যাত্রীরা। যদিও তাতে খুব একটা সুফল মিলছে না।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়াটার রুটে চলাচলকারী স্বাধীন পরিবহনে দেখা যায়, যাত্রীদের সঙ্গে চালকের সহকারীর বাগবিত-া। চালকের সহকারী ভাড়া চাইছেন ওয়েবিল হিসেবে। কিলোমিটার হিসেবে ভাড়া নিতে নারাজ তিনি।
এ সময় ওই বাসের যাত্রী সাফাত হোসেন বলেন, ‘এরা খুবই ফালতু প্রকৃতির। ভাড়া যেটা সেটা নিবে না। তারা ভাড়া চায় ওয়েবিল হিসেবে। ওয়েবিল তো বন্ধ হওয়ার কথা।’
একই অভিযোগ বাসের অপর যাত্রী সায়লা মাহবুবের। তিনি বলেন, ‘সবকিছুর একটা সিস্টেম থাকা উচিত। ভাড়া যেটা সেটা দিব। কিন্তু এরা ভাড়া বেশি চায়।’
এ বিষয়ে ওই চালকের সহকারীর কাছে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। স্বাধীন পরিবহনের পরিচালক মো. আলাউদ্দিনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, তার রুটে ৪৬টি বাস রয়েছে। কিন্তু রোববার মাত্র ২২টি বাস চলছে। বাস চালানোর জন্য চালক পাওয়া গেলেও চালকের সহকারী পাওয়া যাচ্ছে না।
আলাউদ্দিন বলেন, ওয়েবিল হচ্ছে কয়জন যাত্রী উঠলো, আমরা সেটার হিসাব পাই। ওই হিসাবে আমরা ড্রাইভার, হেলপারের থেকে টাকা বুঝে নেই। কিন্তু ওয়েবিল হিসেবে তো ভাড়া নেওয়া হয় না। আবার বাস চুক্তিতেও দিতে পারছি না। চুক্তিতে দেওয়াও নিষেধ আছে।
ভাড়া বাড়ানোর পরই অনেক বাসে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন যাত্রীরা।
গত বুধবার ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির কার্যালয়ে বাস ভাড়া বাড়ানোর পরবর্তী অবস্থা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্যাহ জানিয়েছেন, রাজধানীতে ওয়েবিল সিস্টেমেও আর বাস চলবে না। গাড়িতে ভাড়ার চার্ট ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোববার থেকে ওয়েবিল বন্ধ হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে বন্ধ হয়নি।
সরেজমিন দেখা গেছে, রজনীগন্ধা, ট্রান্সসিলভা, হিমাচল, শিকড়, ওয়েলকাম, স্বাধীন পরিবহনসহ আরও বেশ কয়েকটি বাস কোম্পানির নিজস্ব চেকাররা ছাউনিতে বসে আছেন। আগের মতো বাস আসতেই চেকাররা বাসে উঠে যাত্রী গণনা করছেন এবং ওয়েবিলে স্বাক্ষর করছেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্যাহর কাছে ওয়েবিলের ভবিষ্যত সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি পরিষ্কার উত্তর দেননি। ওয়েবিল কবে বন্ধ হবে তা জানেন না বলে জানান পরিবহন খাতের শ্রমিক ও মালিকদের এই নেতা।
এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, আপাতত সিটিং সার্ভিস ও গেটলক সার্ভিস বন্ধে কাজ করছি। এরপর ওয়েবিল বন্ধে কাজ শুরু হবে। যারা বাড়তি ভাড়া আদায় করছে, বিআরটিএর মোবাইল কোর্ট তাদের জরিমানা করছে, ডাম্পিং করছে।
কবে নাগাদ ওয়েবিল বন্ধ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা এখনো বলতে পারছি না।’ ওয়েবিলের সঙ্গে ভাড়ার কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান এই পরিবহন নেতা।
পরিবহন মালিকরা ওয়েবিল টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে কি না জানতে চাইলে এনায়েত উতুল্ল্যাহ বলেন, ‘না, আমরা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করব কেন?’ এরপর ব্যস্ততা দেখিয়ে কল কেটে দেন তিনি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আমরা এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ইনভেস্ট করে তিনটা মেট্রো লাইন করতে পারছি। এখন চার হাজার কোটি টাকা ইনভেস্ট করে বিশ্বমানের বাস সার্ভিস ঢাকা শহরে চালু কর যায়।
ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘কেন বছর বছর এর সঙ্গে ওর মিটিংয়ে বসতে হবে? কেন সড়কে ১৪ রকম সার্ভিস থাকবে, দুই-তিন রকম ফুয়েল থাকবে? এখানে কার স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে এটা নিয়ে আমি সন্দিহান।’
বিশ্বমানের পদ্ধতি অনুসরণ না করে সমস্যাকে জিইয়ে রাখা হচ্ছে বলে মন্তব্য করে এই গবেষক বলেন, সরকারিভাবে পুরো ঢাকায় এক রকম বাস সার্ভিস চালু হলে রাজধানীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও সংস্থার জন্য আলাদা বাসের প্রয়োজন হবে না। মানসম্মত বাসসেবা চালু হলে সব শ্রেণির মানুষ একই বাসে উঠতে পারবে।
ভাড়া নিয়ে তর্কাতর্কি : সিটিং সার্ভিস বা ওয়েবিলের নামে কোনো গণপরিবহন চলবে না বলে বাস মালিকদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হলেও আজও তা বন্ধ হয়নি। রোববার থেকে ওয়েবিল বন্ধের কথা বলা হলেও দ্বিতীয় দিনেও রাজধানীর সিটিং সার্ভিস গাড়িগুলোতে চলছে ওয়েবিল কার্যক্রম। নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। ফলে ভাড়া নিয়ে গাড়িতে গাড়িতে যাত্রীদের সঙ্গে বাকবিত- করতে দেখা গেছে যাত্রীদের। সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন ওয়েবিল চেকিং পয়েন্ট ঘুরে এমনটাই দেখা গেছে। তবে ভিন্ন ভিন্ন কথা বলছে বিভিন্ন পরিবহনের ওয়েবিল চেকার এবং গাড়ির স্টাফেরা। চেকারের ভাষ্যমতে মালিকপক্ষের যাত্রীদের হিসাব রাখতে চলছে ওয়েবিল। তবে ওয়েবিল অনুযায়ী বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে না বলে দাবি করেন। এদিকে গাড়ির যাত্রীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন চেক প্রতি ভাড়া বেশি নেওয়া হচ্ছে। পরিবহন স্টাফ বলছেন চেক প্রতি ৩ টাকা ভাড়া বাড়িয়েছে মালিক পক্ষ।
রাজধানীর কলেজগেট এলাকায় এম এম লাভলী পরিবহনের ওয়েবিল চেকার বলেন, ‘এখন তো সব গাড়ি সরকার লোকাল করে দিছে। আর ওয়েবিল সিস্টেম নাই। এখন প্রতিটা গাড়ি লোকাল ভাড়াই নিতেছে। কিন্তু এখন ওয়েবিলে যে হিসাবটা হচ্ছে তা মালিককে যাত্রীর হিসাব পাওয়ার লাইগা। এই ওয়েবিলটা না থাকলে মালিক যাত্রীদের হিসাব পাবে না। যাত্রীরা গাড়িতে উঠে কিলোমিটার হিসাবে ১০ টাকা ভাড়া আসলে ১০ টাকাই দিবে। আগের মতো কোন সিটিং ভাড়া নেওয়া হচ্ছে না। এই হিসাবটা না থাকলে গাড়ির সব টাকাতো ড্রাইভার হেলপাররাই খায়া ফালাইবে।’
লাব্বাইক পরিবহনের ওয়েবিল চেকার বলেন, ‘হিসাব অনুযায়ী যাত্রীদের ভাড়া বাড়েনি। যেমন ধরেন আমিন বাজার থেকে বাংলামোটর ১৫ টাকা ভাড়া ছিল। তেলের দাম বাড়ানোর পরেও ভাড়া বাড়াইনি। তারপরেও যদি পাবলিক ভাড়া নিয়ে এইরকম ঝামেলা করে তাহলে মালিকরা দেবে গাড়ি বন্ধ করে। কারণ মালিকের না পোষালে মালিক গাড়ি চালাবে কিল্যাইগা। আর ওয়েবিল বন্ধ করে দিয়েছে। ওয়েবিল দেইখা মালিকের হিসাব নিতে হবে না। হিসাবের জন্য মালিকের একটা ওয়েবিল কাগজ লাগবেই।’
নীলাচল পরিবহনের ওয়েবিল চেকার বলেন, ‘ভাই আমাদের পেটেতো লাথি দেওয়ার দরকার নেই ভাই। আমরা মাসে প্রায় ১০ হাজার টাকা বেতনে কাজ করি। কোম্পানি থেকে বলে আমাদের ওয়েবিলে লিখে দিতে আমরা লিখে দেই। কোম্পানি যে ভাড়া ঠিক করে দেয় গাড়িতে সেই ভাড়াই নেওয়া হয়। এমন না যে পাবলিকের কাছ থেকে কিছু ভাড়া বেশি নিলে আমাদের পকেটে ঢোকে। সরকার যে ভাড়া ঠিক করে দিয়েছে তাই নিচ্ছে গাড়িতে। শুধু চেক হচ্ছে যাত্রীর হিসাব রাখার জন্য।’
সবার ভাষ্য একই যে মালিকপক্ষ থেকে ওয়েবিল বন্ধের কোন নির্দেষ আসে নাই। যাত্রীদের হিসাব মেলানোর জন্যই ওয়েবিল এখনও চালু রেখেছে মালিকরা। তবে ওয়েবিল অনুযায়ী ভাড়া নেওয়া হচ্ছে না। সকল গাড়ি লোকাল হিসেবে চলছে এবং কিলোমিটার হিসেবে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে ওয়েবিল বন্ধের দ্বিতীয় দিনেও অনেক গাড়িতে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়াকে কেন্দ্র করে যাত্রীদের সঙ্গে তর্কে জড়াতে দেখা গেছে গাড়ির স্টাফদের। যাত্রীদের অভিযোগ গাড়িতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
এম এম লাভলী পরিবহনের যাত্রী নাহিদ হাসান বলেন, কলেজগেট থেকে উঠেছি যাবো ফার্মগেট। ভাড়া নিয়েছিল ২০ টাকা। পরে ঝামেলা করায় ১৫ টাকা রেখেছে ৫ টাকা ফেরত দিয়েছে। এখনতো গাড়িতে কোন সিটিং নাই। তবুও এত বেশি ভাড়া নিচ্ছে। কিলোমিটার হিসেব করলে এতটুকু রাস্তা ১০ টাকাও ভাড়া আসবে না।
অন্য এক যাত্রী বলেন, সিটিং সার্ভিস থেকে লোকাল করে দিয়ে এখন এদের লাভ হয়েছে। এখন ভাড়াতো বেশি রাখছেই সেই সাথে যাত্রীও তুলছে ইচ্ছামতো। এখন এদের লাভের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
পাশে থাকা আরেক যাত্রী বলেন, আগেতো ভাড়া নিত সিটিং হিসেবে। সিটিং হিসেবে ভাড়া নিত ১৫ টাকা কিন্তু এখন তো কিলোমিটার হিসেবে। সেই হিসেবেতো ভাড়া আসে ১৫ টাকারও কম। সে ক্ষেত্রেতো তো আমরা আগের ভাড়ার থেকে বেশি ভাড়া দেবো না। আমরা এখন ভাড়া দেবো কিলো হিসেবে। কিন্তু এরা আগের সিটিং ভাড়ার সঙ্গে নতুন করে ভাড়া যোগ করে বৃদ্ধি করে ভাড়া নিচ্ছে। বলছে চেক প্রতি ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৩ টাকা।’
এ ব্যাপারে এম এম লাভলী পরিবহনের চালকের সহকারীর সঙ্গে কথা বললে তিনি কোন সুনির্দিষ্ট উত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, প্রতি চেকে তিন টাকা করে ভাড়া বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, ‘আপাতত সিটিং সার্ভিস ও গেটলক সার্ভিস বন্ধে কাজ করছি। এরপর ওয়েবিল বন্ধে কাজ শুরু হবে। যারা বাড়তি ভাড়া আদায় করছে, বিআরটিএর মোবাইল কোর্ট তাদের জরিমানা করছে, ডাম্পিং করছে।’
কবে নাগাদ ওয়েবিল বন্ধ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা এখনো বলতে পারছি না।’ ওয়েবিলের সঙ্গে ভাড়ার কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান এই পরিবহন নেতা।
পরিবহন মালিকরা ওয়েবিল টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে কি না জানতে চাইলে এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, ‘না, আমরা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করব কেন?’ এরপর ব্যস্ততা দেখিয়ে কল কেটে দেন তিনি।


বিজ্ঞাপন