নিজস্ব প্রতিবেদক : ডেঙ্গুর বাহক এডিস ইজিপ্টি মশা নিয়ন্ত্রণে পুরুষ মশা বন্ধ্যাকরণের যে চিন্তা করছে পরমাণু শক্তি গবেষণাকেন্দ্র সেটি কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সংশয়ে একজন কীটতত্ত্ববিদ। ওই বিশেষজ্ঞ বলছেন, প্রতিবেশী দুই দেশ মিয়ানমার ও ভারতকে সঙ্গে না নিলে এই পদ্ধতি সফল হবে না।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার শরীফুল ইসলাম বলেছেন, এই পদ্ধতিটি কার্যকর হতে পারে যদি বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার একযোগে এ নিয়ে কাজ করে। নইলে বাংলাদেশে বন্ধ্যা পুরুষ মশা ছাড়লেও প্রতিবেশী দেশের প্রজননক্ষম পুরুষ মশার কারণে বন্ধ্যারা কাজ করতে নাও পারে। ডেঙ্গু এখন ঢাকা ছাড়িয়ে সারা দেশে পৌঁছে যাওয়াতেই এই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
পরমাণু শক্তি গবেষণাকেন্দ্র শনিবার জানিয়েছে ‘স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক’- এসআইটি পদ্ধতিতে পুরুষ মশাকে বন্ধ্যা করে ছাড়া হবে প্রকৃতিতে। এর ফলে স্ত্রী মশা ডিম পারলেও তা নিষিক্ত হবে না। এই পদ্ধতিতে দীর্ঘমেয়াদে মশা নিয়ন্ত্রণ হবে বলে আশা করছে তারা।
পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে যেভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, এই পদ্ধতিটি অনেকটাই যে রকমেরই। এই পদ্ধতিটি পরিবেশবান্ধব বলেও জানানো হয়েছে।
পরমাণু শক্তি গবেষণাকেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কাজলা সেহেলি জানান, ম্যাক্সিকো, ব্রাজিল, থাইল্যান্ড ও চীন দেশে এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। বাংলাদেশেও এসআইটি টেকনিক প্রয়োগের লক্ষ্যে ২০০৭ সাল থেকে কাজ করছেন আমাদের গবেষকরা। তবে জনবল, মানসম্মত ল্যাব ও অর্থ সংকটের কারণে গবেষণাটি প্রয়োগে এখনো প্রস্তুত হতে পারেননি তারা।
তবে শনিবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্র পরিদর্শন করে এসে টাকার সংস্থানের আশ্বাস দিয়েছেন এবং বিজ্ঞানীরা আগামী মৌসুমে পদ্ধতিটি মাঠ পর্যায়ে ব্যবহারের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন।
২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরুর পর থেকে চলতি বছরের মতো পরিস্থিতি আর একবারও হয়নি। এখন পর্যন্ত ২৩ হাজারের মতো রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে প্রতিদিন দেড় হাজার রোগী হাসপাতালে যাচ্ছেন সারা দেশে। এদের সিংহভাগ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও প্রায় ৬০ জন রোগীর মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে।
এই অবস্থায় সরকার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে নতুন ‘কার্যকর’ ওষুধ আনার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ওষুধ ছিটিয়ে ডেঙ্গু এডিসের বিস্তার ঠেকানো যাবে কি না, এ নিয়েও আছে প্রশ্ন।
এই অবস্থায় সরকার স্থায়ীভাবে সমস্যার সমাধানের দিকে আগাচ্ছে এবং প্রয়োজনে বিদেশ থেকে এই ‘ভদ্র মশা’ আমদানির কথাও বলা হচ্ছে।
পরমাণু শক্তি গবেষণাকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা জানান, এসআইটি পদ্ধতিতে পুরুষ জাতীয় এডিস মশাকে গামা রশ্মি প্রয়োগের মাধ্যমে বন্ধ্যাকরণ করা হয়। এই মশা ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব রয়েছে এমন এলাকায় অবমুক্ত করা হলে তা স্ত্রী এডিস মশার সঙ্গে মিলিত হয়। আর ওই স্ত্রী এডিস মশা যে ডিম বা লার্ভা নিষিক্ত না হওয়ায় মশার পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকে।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের মহাসচিব আহমেদুল কবির এই ধরনের একটি পদ্ধতিকেই কার্যকর বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া আছে উর্বেশিয়া নামে। ওই ব্যাকটেরিয়া পুরুষ মশায় দিয়ে দিচ্ছে, সেই ব্যাকটেরিয়া স্ত্রী মশার মধ্যেও ছড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে ডিম দিলেও তা ফুটে বাচ্চা হবে না।
আমাদের যেতে হবে পরিবেশকে ঠিক রেখে। ওনারা এখনই যদি প্ল্যান না করে, আগামীবার এর চেয়ে বড় ভয়াবহতা নিয়ে আবার বসতে হবে। তখন ওনারা বলবে, আমরা এবারও প্রস্তুত না।
তবে কীটতত্ত্ববিদ খন্দকার শরীফুল ইসলাম এই পরিকল্পনার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয়ের কথা বলেছেন মূলত বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। বলেন, এটা মূলত আইল্যান্ড (দ্বীপ) এলাকাগুলোতে কাজে লাগে। যেখান থেকে মশা এদিক ওদিক যাওয়ার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ এমন একটা জায়গা যেটার চারদিকে মিয়ানমার আর ভারত। যার জন্য বাংলাদেশ থেকে যদি এই পদ্ধতি কাজ করেও থাকি এরপরও এটা (মশা) থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনো সুযোগ নাই।
কারণ, নেইবারিং এরিয়া (আশপাশের এলাকা) থেকে যেসব পুরুষ মশা আসবে তারা আবার স্ত্রী মশার ডিম পড়লে সেটা নিষিক্ত করবে। যার জন্য এটা কাজে আসবে না। তাছাড়া ডেঙ্গু এখন সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। আমাদের প্রেক্ষাপটে এটা খুব উপযোগী হবে বলে আমার মনে হয় না।
এই মুহূর্তে তাহলে কী করণীয়?- জানতে চাইলে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, সতর্কতা যেগুলো আছে সবগুলো মানতে হবে। আর এটা মানতে হবে প্রত্যেকটা লেভেলে। এটা এখন আর সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়, যার কারণে সবাকাইকে এটার জন্য কাজ করতে হবে। যেখানে যেখানে এডিস মশা ডিম পারতে পারে, তার কোথাও যেন পানি জমতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের মহাসচিব আহমেদুল কবিরও বলেছেন, এডিস মশা এরই মধ্যে যে ডিম দিয়েছে, সেগুলো নষ্ট করা প্রায় অসম্ভব।… কীটনাশক দিয়েও এটা (ডিম) মারা সম্ভব নয়। এক বছর এটা কার্যকর থাকতে পারে, পানি পেলেই সেটা ফুটে বাচ্চা বের হবে। তিন দিন পানি জমে থাকলেই বাচ্চা হয়ে যাবে।
এই অবস্থায় বাসাবাড়িতে এসির পানি যেন জমে থাকতে না পারে, ফুলের টব বা অন্য কোথাও যেন তিন দিন পানি না থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখার তাগিদও দিয়েছেন তিনি।