ষাটোর্ধ্বদের বুস্টার ডোজ

বিশেষ প্রতিবেদন

আফ্রিকা ফেরত প্রবাসীদের বাড়িতে লাল পতাকা
আফ্রিকা থেকে আসা ২৪০ জনের হদীস নেই
দক্ষিণ আফ্রিকায় হাসপাতালে ভর্তি বাড়ছে

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের করোনার বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে করোনাভাইরাসের আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ‘ওমিক্রন’ মোকাবিলার প্রস্তুতি সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি।
মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যারা ষাটোর্ধ্ব আছে, সিভিয়ার অসুস্থ যারা, তাদের আমরা বুস্টার ডোজের চিন্তা-ভাবনা করেছি। যাতে আমরা আগামীতে আমরা বুস্টার ডোজ দিতে পারি। অনেক দেশ ভারত থাইল্যান্ড মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এরা বুস্টার ডোজ দিচ্ছে। আমেরিকা-ইউরোপের মতো উন্নত দেশগুলোতেও দিচ্ছে।’
পিসিআর টেস্টটা আরও জোরদার করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘র্যাপিড টেস্ট আরও জোরদার করারও পরামর্শ রয়েছে। বুস্টার ডোজের বিষয়েও ওনার (প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।’
কবে নাগাদ বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে- জানতে চাইলে জাহিদ মালেক বলেন, এটা নিয়ে আমাদের মন্ত্রণালয়, ডিজি (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) অফিস বসবে। বসে আমরা দিনক্ষণ ঠিক করবো। আমরা মোটামুটি একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।
দক্ষিণ আফ্রিকায় হাসপাতালে ভর্তি বাড়ছে : দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনা সংক্রমণ অনেকটাই লাফিয়ে বাড়ছে। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের কারণে দেশটিতে চলতি সপ্তাহে দৈনিক সংক্রমণ ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে সোমবার শীর্ষস্থানীয় এক ভাইরাসবিদ সতর্ক করেছেন।
এনবিসি নিউজ জানায়, দক্ষিণ আফ্রিকার যে প্রদেশে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে, সেখানে কোভিডে আক্রান্ত লোকজনের হাসপাতালে ভর্তির হার দ্রুত বাড়ছে।
দেশটির ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর কমিউনিক্যাবল ডিজিজ (এনআইসিডি) এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের শুরুর তুলনায় দক্ষিণ আফ্রিকায় হাসপাতালে ভর্তি ৬৩ শতাংশ বেড়েছে।
সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গাওটেঙ প্রদেশে। এর প্রদেশেই দক্ষিণ আফ্রিকার বৃহত্তম শহর জোহান্সবার্গ অবস্থিত। সেখানে চলতি মাসের শুরুর তুলনায় কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার ৪০০ শতাংশ বেড়েছে।
ব্রিটেনের ডেইলি মেইল অনলাইন জানায়, গাওটেঙ প্রদেশে চলতি সপ্তাহে ৫৮০ জন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগে এ সংখ্যা ছিল ১৩৫।
দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষকদের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, রোববার ২ হাজার ৮০০-এর বেশি লোকের শরীরে নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়, যা আগের সপ্তাহে গড়ে ছিল ৫০০। এর আগের সপ্তাহে দেশটিতে গড়ে ২৭৫ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল।
দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞাপ্তিতে ড. সেলিম আবদুল করিম বলেন, ‘আমরা সংক্রমণ তীব্র হওয়ার আশংকা করছি। সপ্তাহান্তে দৈনিক সংক্রমণ সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে।’
এ পরিস্থিতির মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরাও তীব্র সংক্রামক করোনার নতুন ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জো ফালা বলেছেন, একেবারেই আতংকিত হওয়ার কিছু নেই।
গত ডিসেম্বরের বেটা ধরনের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা আগেও এ ধরনের সংক্রমণ দেখেছি।’ প্রসঙ্গত, দক্ষিণ আফ্রিকায় এ পর্যন্ত ২৯ লাখ লোক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ৮৯ হাজার ৭৯৭ জন।
আফ্রিকা থেকে আসা ২৪০ জনের হদীস নেই: দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কেউ যাতে না আসেন সেটি চায় সরকার। যদি কেউ আসে তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি। মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী এই মন্তব্য করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা মহাদেশ থেকে আসতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। যদি আসে তাহলে ১৪ দিনের কঠোর কোয়ারেন্টাইন অবশ্যই মানতে হবে।
মন্ত্রী বলেন, ডেল্টার চেয়েও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন। ওমিক্রনের সংক্রমণ রোধে সরকার সতর্ক অবস্থানে আছে। তবে দুঃখের বিষয় গত এক মাসে ২৪০ জন আফ্রিকা থেকে এসেছেন। এখন তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের ফোনও বন্ধ।
বিশ্বজুড়ে নতুন আতঙ্কের নাম ওমিক্রন। আফ্রিকায় প্রথম মিউটেশন হলেও করোনা ভাইরাসের এ ভ্যারিয়েন্ট দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইউরোপ আমেরিকায়। এরই মধ্যে এশিয়াও বেশ কিছু দেশে শনাক্ত হয়েছে এ প্রকৃতি। বিশ্বজুড়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
ওমিক্রনের প্রবেশ ঠেকাতে এরই মধ্যে নড়েচড়ে বসেছে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ। মঙ্গলবার সংবাদ সম্মলনে মন্ত্রী জানান, সবক্ষেত্রে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। বলেন, নো মাস্ক নো সার্ভিস নয় এখন সরকার বলতে চায়, নো ভ্যাকসিন নো সার্ভিস।
ওমিক্রন ঠেকাতে সকলকে স্বাধ্যবিধি মানতে হবে গণজমায়েত না করতে অনুরোধ জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মন্ত্রী বলেন, তবে দেশে করোনার প্রকোপ কমায় যে ঢিলেঢালাভাব চলে এসেছে তা নিয়ন্ত্রণে কঠোর হওয়া হবে।
বাংলাদেশে ওমিক্রনের সম্ভাব্য সংক্রমণ প্রতিরোধে ইতোমধ্যে ১৫টি নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এগুলো হলো— দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা, এসওয়াতিনি, লেসোথো এবং বিভিন্ন সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত অন্যান্য আক্রান্ত দেশ থেকে আসা যাত্রীদের বন্দরগুলোতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্ক্রিনিং জোরদারকরণ; সবধরনের (সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য) জনসমাগম নিরুৎসাহিতকরণ; বাড়ির বাইরে সবসময় সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিতকরণ; রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়ার ব্যবস্থা ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম করা প্রভৃতি।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, সবধরনের জনসমাবেশ, পর্যটন স্থান, বিনোদন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার, সিনেমা হল/থিয়েটার হল ও সামাজিক অনুষ্ঠানে (বিয়ে, বৌভাত, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি) ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম সংখ্যক লোক অংশগ্রহণ করতে পারবে; মসজিদসহ সব উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিতকরণ; গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতকরণ; আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আসা যাত্রীদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন নিশ্চিতকরণ; সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (মাদ্রাসা, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, সহশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়) ও কোচিং সেন্টারে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতকরণ; সব স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে সেবা গ্রহীতা, সেবা প্রদানকারী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সব সময় সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভ্যাকসিন কার্যক্রম পরিচালনা; করোনা উপসর্গ/লক্ষণযুক্ত সন্দেহজনক ও নিশ্চিত করোনা রোগীর আইসোলেশন ও কোভিড পজিটিভ রোগীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা অন্যান্যদের কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ; কোভিড-১৯ এর লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে রাখা এবং তার নমুনা পরীক্ষার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয়; অফিসে প্রবেশ ও অবস্থানকালে বাধ্যতামূলকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরা নিশ্চিতকরণ এবং কোভিড-১৯ রোগ নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস করতে কমিউনিটি পর্যায়ে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সচেতনতা তৈরির জন্য প্রচারণা চালানো যেতে পারে উল্লেখ করা হয় নির্দেশনায়।
আফ্রিকা ফেরত প্রবাসীদের বাড়িতে লাল পতাকা : করোনায় ভাইরাসের ভয়ঙ্কর ধরন ওমিক্রন মোকাবেলায় সতর্ক রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্বাস্থ্য বিভাগ। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং সামাজিক সংক্রমণ রোধে বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতসহ সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফেরত আসা প্রবাসীদের বাড়িতে টাঙানো হলো লাল পতাকা। চলতি সপ্তাহের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরেছেন কসবার পাঁচজন, বাঞ্ছারামপুর ও নবীনগরের একজন করে।
মঙ্গলবার দুপুরে কসবা, নবীনগর ও বাঞ্ছারামপুরে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফেরত আসা সাত প্রবাসীর বাড়িতে গিয়ে লাল পতাকা টানিয়ে তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. একরাম উল্লাহ জানান, সোমবার আফ্রিকা থেকে আগতদের তালিকা স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে এসেছে। তালিকায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাতজন প্রবাসী রয়েছেন, যারা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসেছেন। তাদের বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বিদেশ থেকে আগতদের কোনো উপসর্গ থাকলে নমুনা সংগ্রহ করা হবে। করোনার অস্তিত্ব ধরা পড়লে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার আওতায় আনা হবে। এছাড়াও আখাউড়া স্থলবন্দরে বিভিন্ন সতর্কতা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।
জেলা করোনা কমিটির একটি সূত্র জানায়, আগত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাত নাগরিকের বাড়িতে প্রাথমিক নিরাপত্তা পদক্ষেপ হিসেবে লাল পতাকা টানিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইন এ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। সে সাথে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে সকল যাত্রী পারাপারে ও কঠোরভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষার নির্দেশ জারি করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত জেলায় ১২ হাজার ৪১৬ জনের করোনা সনাক্ত হয়েছে এবং মৃত্যু হয়েছে ১৮০ জনের।


বিজ্ঞাপন