ডেঙ্গুবিরোধী অভিযান সফলতা নিয়ে সংশয়

এইমাত্র জাতীয় স্বাস্থ্য

মহসীন আহমেদ স্বপন : ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ মোকাবিলা ও মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা দক্ষিণ (ডিএসসিসি) ও উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি বাসাবাড়িতে গিয়ে লার্ভা নিধন অভিযান চালাচ্ছে। অভিযান চালিয়ে গত এক মাসে ঢাকার দুই সিটি এলাকার বাসা-বাড়ি ও অফিস এবং হাসপাতাল থেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে এক কোটি টাকা। সেই সঙ্গে কারাদ- দেওয়া হয়েছে দেড়শতাধিক বাড়ির মালিককে। বাড়ি মালিকদের অবহেলার কারণে মশার প্রজননস্থল সৃষ্টি করার দায়ে এসব শাস্তি করা হয়েছে। কিন্তু এত জরিমানা এবং অভিযানের পরও কতটুকু সফলতা পেয়েছেন তা নিয়ে এখনও শঙ্কায় রয়েছেন সংস্থা দুটি।
অভিযান পরিচালনাকারীরা বলছেন, লার্ভা নিধন অভিযানের মাধ্যমে বাসা-বাড়ির মালিকদেরকে সর্বোচ্চ সতর্কতা সৃষ্টি করার পাশাপাশি কখনও কখনও জরিমানা করা হয়। আর এ জরিমানা করার উদ্দেশ্য হলো বাড়ির মালিকদেরকে একটা সতর্ক বার্তা দেওয়া। যেন তারা সচেতন নয়। কিন্তু তাতেও তেমন কার্যকরিতা মিলছে না। কারণ এখনও প্রতিনিয়ত বাসা-বাড়িতে মশার প্রজননস্থলের দেখা মিলছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, আমরা প্রতিদিন নিয়মিত ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি বাসা-বাড়িতে লার্ভা নিধনে বিশেষ চিরুনি অভিযান অব্যাহত রেখেছি। যখন দেখা যায়, বাড়ির মালিকদের অবহেলার কারণে মশার প্রজননস্থল সৃষ্টি হচ্ছে তখন জরিমানাও করি। আর এ জরিমানার উদ্দেশ্য হলো তিনি নিজে যেমন সচেতন হবেন, তেমনি অন্য বাড়ির মালিকরাও সচেতন হবেন। সেই সঙ্গে লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া বাড়িগুলোতে বিশেষ স্টিকারও লাগানো হয়, যাতে পরবর্তী সময়ে আবার গিয়ে পরিদর্শন করে দেখা যায় সে বাড়িটি। কিন্তু এত এত জরিমানা, সচেতনতা সৃষ্টির পরও বাড়ির মালিকরা কতটুকু সচেতন হয়েছে তা নিয়ে এখনও যথেষ্ট সন্দেহে রয়েছে। কারণ এখনও প্রতিদিন কোনো না কোনো বাড়িতে লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। তাই যতদিন পর্যন্ত বাড়ির মালিকরা সচেতন না হবে ততদিন পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এ কথা সত্য যে বাড়ির মালিকরা আগের চেয়ে অনেকটা সচেতন হয়েছে। তবে তাতে এখনই আস্থা রাখা যাচ্ছে না।
ডিএনসিসি সূত্রে জানা যায়, চলতি মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংস্থাটির আওতাধীন প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার বাড়ির মধ্যে প্রায় সোয়া ১ লাখ বাড়ি ও স্থাপনা পরিদর্শন করা হয়। এর মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার বাড়ি ও স্থাপনায় মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও প্রায় ৪০ হাজার বাড়ি ও স্থাপনায় এডিস মশার বংশবিস্তার উপযোগী স্থান কিংবা জমে থাকা পানি পাওয়া গেছে। এসব কারণে সংস্থাটি এক মাসে জরিমানা আদায় করেছে প্রায় ৬৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, সংস্থাটির আওতাধীন প্রায় আড়াই লাখ বাসা-বাড়ির মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮৭ হাজার বাড়ি ও স্থাপনা পরিদর্শন করে প্রায় দেড় হাজার বাড়ি ও স্থাপনায় মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও প্রায় ২৫ হাজার বাড়ি ও স্থাপনায় এডিস মশার বংশবিস্তার উপযোগী স্থান/জমে থাকা পানি পাওয়া গেছে। এসব কারণে সংস্থাটি এক মাসে জরিমানা আদায় করেছে প্রায় ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
গুলশানের নিকতন এলাকার একটি নির্মাণাধীন ভবনের গেইটের সামনে দেখা যায় সাবধান, এ বাড়ির স্থাপনায় এডিস মশার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে লেখা স্টিকার লাগানো।
এ বিষয়ে কথা বলতে ভবনটির কেউ রাজি হননি। পরে নির্মাণাধীন ওই ভবনের একজন নির্মাণ নাম প্রকাশ না শর্তে এক শ্রমিক বলেন, গত পরশু সিটি করপোরেশনের লোকজন স্টিকারটি লাগিয়েছে। কারণ বিল্ডিংয়ের বেজমেন্টে পানি জমা ছিল। লাখ টাকা জরিমানাও করেছে। এ কারণে লজ্জায় কেউ কথা বলতে রাজি হয়নি।
একই রকম স্টিকার লাগানো দেখা গেছে হাতিরঝিলের ডি ব্লকের একটি সাততলা ভবনের গেইটে। ভবনটির কেয়ারটেকার নিয়াজ আলী বলেন, এক সপ্তাহ আগে ম্যাজিস্ট্রেটরা আইসা স্টিকার লাগিয়েছে। তখন ছাদে পানি জমতো ট্যাঙ্ক থেকে পানি পড়ে। স্টিকার লাগিয়ে বলেছে যেন এটি দ্রুত ঠিক করি। আমরাও পরের দিন সেটি ঠিক করে ফেলেছি। এখন কোনো সমস্যা নেই। তাকে কোনো জরিমানা করেনি বলে জানান তিনি।
ডিএনসিসির এডিস মশার লার্ভা নিধন কার্যে নিয়োজিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাজিদ আনোয়ার বলেন, মশার লার্ভা বেশি পাওয়া যাচ্ছে নির্মাণাধীন ভবন এবং পরিত্যক্ত স্থান ও হাসপাতালের আশেপাশে। বাসা-বাড়িতে তেমন লার্ভা পাওয়া যায় না। যদিও লার্ভা সৃষ্টির উপযোগিতা বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা দেখেছি, অভিযানগুলোতে বাড়ির মালিকরা অনেকটা সচেতন হচ্ছে। কারণ তারা আগে জানতেই পারতেন না কোন স্থানে মশা জন্মাতে পারি। যেটি অভিযানে গিয়ে আমরা অবহিত করি তাদের। তবে বাড়ির মালিকরা যদি সচেতন থাকে তাহলে এডিস মশার বৃদ্ধি কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।
বংশালের ৬২/২ এর মালিক বুলবুল আহমেদ বলেন, ছাদে একটা ভাঙাচোরা বালতি-বোতল ছিল। এটার জন্য সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল গত সপ্তাহে। তবে ছাদে এসব কে রেখেছিল তা জানতাম না। যদিও এটা রাখা ঠিক হয়নি। ভাড়াটিয়াদের কেউ হয়তো রেখেছিল। কিন্তু অপরাধের দায় আমার কাঁধে এসেছিল। তবে ভাড়াটিয়াদেরকেও সচেতন হতে হবে। তা নাহলে বাড়ির মালিকদের একার পক্ষে বাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখা কঠিন।
কাঠালবাগান এলাকার ২৩/২/১ এর বাড়ির মালিক রমিজ আহমেদ বলেন, ছাদে শ্যাওলা জমে ছিল এবং ওই শ্যাওলাতে পানি জমে থাকত। এ অপরাধে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল। নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছি। তাই এখন থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখব।
তিনি আরও বলেন, বাসা-বাড়ির ছাদসহ কোথাও কোনোভাবে যেন পানি জমতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাড়ির ছাদ বা অন্য যে কোনো খোলা স্থানে- যেখানে বৃষ্টির পানি পড়তে পারে এমন স্থানে কোনো ভাঙাচোরা বালতি, বোতল কিংবা আইসক্রিম বা বিরিয়ানির প্যাকেট বা বাটি যেখানে সেখানে ফেলে রাখা যাবে না।
বাড়ির চারপাশে কোথাও ময়লা আবর্জনা ফেলে স্তূপ বানানো যাবে না। ময়লা হলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের পরিচ্ছন্নতা বিভাগকে বিষয়টি জানাতে হবে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *