বিপথে কিশোর

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন জীবনী ঢাকা রাজধানী

গ্যাংয়ের অভয়ারণ্য নদীতীর

মহসীন আহমেদ স্বপন: উদ্ভট স্টাইলে চুলের কাট। পরনে জিন্স প্যান্ট-টি-শার্ট। দলে দলে পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে বিচরন। আড্ডার নামে ইভটিজিং, পথচারীদের নানাভাবে কটূক্তি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতে বাধে না তাদের। মুখে উচ্চস্বরে বলিউডি গান। নারীদের উত্ত্যক্ত করার ক্ষেত্রে বয়সের কোনও বিবেচনাও নেই। মায়ের বয়সী নারীকেও অশ্লীল ইঙ্গিত করে তারা। সিগারেট দিয়ে শুরু। তারপর মাদকে ঝুঁকে পড়া। তারপর নেশার টাকা জোগাড় করতে কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে।
এদিকে বিভিন্ন জেলা থেকে নৌপথে রাজধানীতে আসা মালবাহী জাহাজ হয়ে উঠেছে গ্যাং কালচারে বেড়ে ওঠা কিশোরদের আড্ডার জায়গা। সেখানে নদীতীরে আড্ডা, নতুন বন্ধু জোগাড়, মাদক সেবন, ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা সবই হয়। ছিনতাই করে এসে গা ঢাকা দেয়ার পছন্দের জায়গাও হয়ে উঠেছে বুড়িগঙ্গা-তুরাগ নদের তীরের স্টিমার ও জাহাজ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়, গ্যাং কালচারের জন্ম মহল্লা থেকে হলেও এদের সক্রিয়তা বাড়ে আড্ডায়। আর এই আড্ডার মাধ্যমেই তারা জড়িয়ে পড়ছে ছিনতাই এবং মাদকে।
সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় সামনে এসেছে কিশোর গ্যাংয়ের নানা তথ্য। এরই মধ্যে আটক হয়েছে বেশ কিছু গ্যাংয়ের বিপুল পরিমাণ সদস্য। আর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে গ্যাং কালচার পুরোপুরি নির্মূলের কথা। গত দুই বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের সক্রিয়তা বেড়েছে। প্রাথমিক তথ্য বলছে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা শতাধিক।
রাজধানীর গাবতলী এলাকায় দেখা মিলেছে কিশোর গ্যাংয়ের অনেক সদস্যের। গাবতলী ইট-বালুর ঘাট এলাকায় এসব কিশোরের আনাগোনা নিয়মিত। প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে তারা এখানে জড়ো হতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নদীতীরে বাড়ে সদস্যের সংখ্যা। আর বিকাল হতেই শুরু হয় মাদকের আড্ডা।
স্থানীয় অনেকেই বিপদের শঙ্কায় এবিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। তবে অনেকেই জানালেন এসব গ্যাং সদস্যের সক্রিয়তার কথা।
সাইদুল ইসলামের নামের এক শ্রমিক বলেন, আমরা শিপ থেকে মাল নামাই। বিকালের মধ্যে আমগো কাজ শেষ হয়। শিপ তো ঘাটেই থাকে। ঐসব পোলাপান আইসা শিপে ওঠে। গাঞ্জা খায়, মদ খায়, বাবা (ইয়াবা) খায়।
একাধিক মানিব্যাগ, নারীদের ব্যাগ এবং অলঙ্কারসহ অনেকেই এসে জাহাজে ওঠে এবং তা ভাগ-বাটোয়ারা করে। এসময় তাদের সঙ্গে দেশীয় অস্ত্রও দেখা যায় বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক। দেশীয় অস্ত্র এবং কিশোর দলের বিপরীতে অবস্থান নিতে সাহস হয়ে ওঠে না জাহাজে কর্মরত শ্রমিকদের। কারণ নদীপথে দূর-দূরান্ত থেকে আসা পণ্যবাহী এসব জাহাজ ঘাটে থাকে বেশ কয়েক দিন। সিমেন্ট, বালু, পাথর ও কয়লা বোঝাই জাহাজের শ্রমিকদের বসবাস জাহাজেই। স্থানীয় ছেলেদের সঙ্গে ঝামেলা করতে গেলে উল্টো নিজেরা বিপদে পড়তে পারেন এমন শঙ্কায় এসব কিশোরকে কেউ কিছু বলছে না বলে জানান মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা জাহাজ শ্রমিক ফারুক।
এ চিত্র ঢাকার উঠতি কিশোরদের গ্যাং কালচারের। এমন কিশোরদের নিয়ে সক্রিয় রাজধানীতে সক্রিয় শতাধিক গ্রুপ। এলাকাভেদে এদের রয়েছে পৃথক গ্রুপ। একেকটি গ্রুপকে ‘গ্যাং’ বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে এসব দল গড়ে উঠছে বিভিন্ন নামে খোলা ফেইসবুক গ্রুপকে কেন্দ্র করে। স্মার্টফোনের অ্যাপ ব্যবহার করে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছে, সংগঠিত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পড়াশোনার কথা থাকলেও কিশোর বয়সে পারিবারিক কারণে অনেকেই ঝড়ে পড়েছে। ফলে তাদের জীবনের লক্ষ্য হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত। পড়াশোনা করা এবং পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়াদের অনেকেই চলে যাচ্ছে বেপথে। কিশোর বয়সে ধুমপান, মদ্যপান, মাদক সেবন শুরু করছে তারা। আবার মাদকের টাকা জোগাড় করতে বাধ্য হয়ে নামছে ছিনতাই করতে। কিছু দিন ছিনতাইয়ের পর তা পরিণত হচ্ছে অভ্যাসে। তারপর জড়িয়ে পড়ছে আরও বড় অপরাধেও।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, গ্যাং কালচারের জন্ম মহল্লা থেকে হলেও এদের সক্রিয়তা বাড়ে আড্ডায়। আর এই আড্ডার মাধ্যমেই তারা জড়িয়ে পড়ছে ছিনতাই এবং মাদকে। এদের সিংহভাগই কিশোর বয়সী। তারা বিভিন্ন জায়গায় জটলা করে ইভটিজিং করে, পথচারীদের নানাভাবে কটূক্তি করে, অশ্লীল ভঙ্গি করে।
সর্বশেষ গত শুক্রবার রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১১০ জন কিশোরকে আটক করে পুলিশ। পুরনো মামলা থাকায় তাদের সাতজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে বাকিদের সতর্ক করে দিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এরপর রাজধানী থেকে অপরাধ দূর করতে সব ধরনের ‘গ্যাং’ নিশ্চিহ্ন করা হবে বলে জানান ঢাকার পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া। কিশোর গ্যাং হোক আর বড় গ্যাং, ঢাকায় গ্যাং বলে কোনো শব্দ থাকবে না বলে কঠোর হুঁশিয়ার করেন তিনি।
প্রাথমিক তথ্য বলছে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং এর সংখ্যা প্রায় শতাধিক। ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরায় আদনান কবীর নামের এক স্কুলছাত্র নিহত হয়। সে উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল। বাসা উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরে। আদনান হত্যার পেছনে কারণ ছিল দুটি কিশোর গ্যাং এর আধিপত্য বিস্তার। নাইন স্টার আর ডিস্কো বয়েজ নামের দুটি কিশোর গ্যাং এর মধ্যে আধিপত্য নিয়ে এ ঘটনা ঘটে।
এরপর ছোট ছোট নানা ঘটনা ঘটিয়েছে রাজধানীর অন্যান্য এলাকার বিভিন্ন গ্যাং। গত ২৯ জুন হাজারীবাগে এক ইয়াসিন নামের এক কিশোরকে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে জখম করা হয়ল। হাসপাতালে নেয়ার পর সে মারা যায়। পরে জানা যায়, স্কুলের সামনের রাস্তায় আড্ডা দেয়ার আধিপত্যকে কেন্দ্র করে দুটি কিশোর গ্যাং এর দ্বন্দ ছিল। তার জের ধরে ইয়াসিনকে হত্যা করা হয়েছে।
সর্বোশেষ গত ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুরের চান মিয়া হাউজিং এলাকায় প্রেমিকাকে কেন্দ্র করে দুই কিশোর গ্যাং গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এসময় আতঙ্ক গ্রুপের মহসিন মারা যায়। এঘটনায় একই গ্রুপের আরও দুই জন আহত হয়।
শিশু-কিশোর অপরাধের মামলার বিচার হতো ঢাকার শিশু আদালতে। এই আদালতে ২০১৮ সালের ৩১ নভেম্বর পর্যন্ত চলমান ছিল ১ হাজার ৩৮১টি মামলা। এর মধ্যে খুনের মামলা ৮৬টি। আর এসব খুনের ঘটনা ঘটেছে গত ১৫ বছরে। অনুসন্ধানের পর দেড় শতাধিক কিশোরের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দেয় পুলিশ।
এ বছর ১৯ জানুয়ারির পর থেকে এসব মামলার বিচার চলছে ঢাকার ৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত, মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত এবং শিশু আদালতের বিচারিক নিবন্ধন খাতার তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে সব মিলিয়ে ঢাকায় ৯৯ খুনের মামলায় তিনশর বেশি কিশোর জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে গত দেড় বছরেই ঘটেছে ১৩টি খুন। এতে জড়িত অন্তত ১২০ জন কিশোর। এদের মধ্যে ২৭ জনকে আদালতের মাধ্যমে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।
রোমাঞ্চে পড়ে কিশোরীদের মধ্যেও ঝোঁক : অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কিশোরদের মধ্যে ছোট-বড় দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার, প্রেমসংক্রান্ত বিরোধ এবং মাদক এই হত্যাকান্ডের মূল কারণ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার কিশোর গ্যাংগুলিতে শুধু কিশোরই নয়, কিশোরীরাও জড়িয়ে পড়ছে এসব গ্যাংয়ে। মূলত কিশোরীদের সাথে এসকল কিশোরদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
স্থানীয়ভাবে নিজেদের প্রকাশ করতে এসব কিশোরীরাও জড়িয়ে পড়ছে ধূমপান, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে একজন কিশোরিকে নিয়ে একই গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্বের জন্ম নেয়। কখনো কখনো এই দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পরে পার্শবর্তী গ্যাং এর সাথে। ফলে নিজেদের শক্তি প্রমাণে মারামারি, হামলা এমনকি ঘটে চলেছে হত্যাকান্ড।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : একই বয়সের কয়েকজন কিশোরের একই ধরনের ভাবনা এবং তাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার আগ্রহ কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার কারণ বলে মনে করেন সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যান এবং গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষকের দৃষ্টিতে, চোখের সামনে কোনও কিশোর অপরাধমূলক কাজ করলে বয়োজ্যেষ্ঠ তাদের তাৎক্ষনিক শাসন করতেন। যা অপরাধ নির্মূলে সহায়ক ভূমিকা পালন করত। কিন্তু বর্তমানে এধরণের ঘটনা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণে কিশোর অপরাধ বেড়ে চলেছে।
তিনি বলেন, যখন কতিপয় কিশোর কিছু একটা করতে চায়, তখন ভাবনার মধ্যে মিল থাকার কারণে তাদের সংঘ গড়ে ওঠে। তাদেরকে গ্যাং বলতে চাই না, কারণ তারা কিশোর। তারা (কিশোররা) এখন রাজনৈতিক। এখন ৮০ শতাংশ গ্যাং রাজনৈতিক দল বা সংঘ দ্বারা পুষ্ট। তারা রাজনৈতিক ছত্রছায়া পায়। অন্য যারা আছে (বাকী ২০ শতাংশ), তারা মাদক গ্রহণ করছে। এটা একটা বড় প্রেক্ষাপট। সামাজিক প্রেক্ষাপটের অনেক বড় একটা ঘাটতি।
ঢাকায় শতাধিক এবং সারাদেশে দুই হাজারের বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রশাসন, রাজনৈতিকদের মদদে তারা গড়ে উঠছে। তারা সমাজের মধ্যে থেকে সমাজবিরোধী কাজ করছে। যা আইনের চোখে অপরাধ। তারা যে ধরনের অপরাধ করছে তা দেখে মনে হয় না যে, তারা এটা না বুঝে করছে। সমাধানের পথ প্রসঙ্গে তৌহিদুল বলেন, সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার সক্রিয়তা কি? তা অভিভাবকদের দেখতে হবে। এছাড়া তাদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক এবং সহনশীল অবস্থায় থেকে কিশোরদের ক্ষেত্রে সহনশীল ভাবে কাজ করতে হবে।
অন্যদিকে কিশোরদের মধ্যে এ ধরনের অপরাধ প্রবনতাকে সংস্কৃতি উপজাত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান। তিনি বলেন, কিশোর অপরাধ একটি উপ-সংস্কৃতি। এর মধ্যে ভাল দিকও আছে, খারাপ দিকও আছে। এটি হচ্ছে আধুনিক সমাজের যে ধরনের নিয়ামক আমাদের সমাজের মধ্যে প্রবেশ করেছে। বিশেষ করে আমাদের এই সামাজিকতার সাথে সাথে আমাদের যে সামাজিক অনুশাসন তার একটি ছন্দপতন করেছে। জিয়া হায়দারের মতে, খেলাধুলা জায়গা এবং সামাজিক পরিবেশের অভাব, কিশোরদের এই দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের পরিবার, আমাদের স্কুল, আমাদের শৈশব যেখানে একটি সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, একই সাথে সামাজিকীকরণ, মানুষের চরিত্র গঠন, ব্যক্তিত্ব গঠন এই জায়গা ছিল। যা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ফলে আমাদের যে বর্তমান তরুন সমাজ, তারা সামাজিক নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। জিয়া হায়দার বলেন, আমাদের উঠতি প্রজন্ম যেহেতু পরিবর্তনের ধারক-বাহক। তাই তাদের ওপর এর প্রভাব বেশি পড়ে। ছেলেমেয়েরা নতুন দিকে প্রবেশ করছে যা হয়তো বাবা-মায়েরা বুঝে উঠতে পারছে না।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *