আজিজুন্নাহার আঁখি ঃ ১৯৭১ সাল ১০ জুন আকাশে কালো মেঘে ঢাকা অনবরত বজ্রপাত হচ্ছে। হেলেনা মাটির উনুনে কচু শাক রান্না করছে। এদিকে ঝড়বৃষ্টি এলো বলে। ঘর থেকে হেলেনার শাশুড়ির ডাক বউ ও বউ তাড়াতাড়ি ঘরে আসো। আম্মা এই তো আইতেছি।
হেলেনার রান্নাঘর বলতে সুপারি গাছের পাতার একটুখানি চালের মতো। বৃষ্টি এলেই সব ভিজে যায়। দুই এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তেই হেলেনা রান্নাঘর থেকে ভাত আর কচু শাক নিয়ে ঘরে চলে এলো।
একটা ছনের ঘরে হেলেনা তার স্বামী নজর আলী আর শাশুড়ি থাকে। ঘরের মাঝখানে শুধু একটা মাচা যেখানে মাটির হাড়ি পাতিল সাজানো আছে। অভাবের সংসারে আরেকটা ঘর তোলার অর্থ তাদের নেই।
নজর আলী তার একমাত্র গাভীকে মাঠ থেকে আনতে গেছে কিন্তু আকাশের এই অবস্থা দেখে শাশুড়ি বউ দুজনেই চিন্তায় পড়ে যায়। এদিকে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আধভেজা হয়ে নজর আলী গাভীটাকে নিয়ে বাড়ি চলে এলো। হেলেনার আঁচল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলে ইস একটুর জন্য ভিজা গেছি।
নজর আলী বেশির ভাগ সময় মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে কিন্তু আজ এই বৃষ্টির মধ্যে মসজিদে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই ঘরেই নামাজ পড়লো। তারপর নজর আলী হেলেনাকে বলে ও বউ আমারে ভাত দাও। সন্ধ্যা ৭ টার সময় সোহেল গো বাড়ি যাইতে অইবো। ও গো বাড়িতে রেডিওতে যুদ্ধের খবর শুনি। হেলেনা কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। একখান খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে খেতে দেয়। নজর আলী ভাত খেয়ে গামছায় হাত মুছতে মুছতে বের হওয়ার সময় হেলেনা স্বামীর দিকে লাজুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে এই শুনেন আমাগো, কথা শেষ করার আগেই নজর আলী বুঝে যায় যে তাদের গাভী বাচ্চা দিবে সেই কথাই হেলেনা বলতে চাইছে। কিন্তু হেলেনা তো তাদের সন্তান হওয়ার কথা বলতে চাইছিল। আজ দিনে ভেবে রাখছে রাতে স্বামীকে এই খুশির খবর দিবে। ওদের বিয়ে হইছে ৬ বছর কিন্তু এতো দিন সন্তান না হওয়ায় পাড়াপড়শি অনেক বাজে কথা হেলেনাকে বলেছে। কিন্তু হেলেনা আজই বুঝতে পারলো তার গর্ভে নতুন প্রাণ সঞ্চার হয়েছে।
নজর আলী বের হতে হতে মাকে বলে মা ও মা আমি সোহেল গো বাড়ি গেলাম তোমরা ভাত খাইয়া শুইয়া পইরো। আমি খবর শুইনাই চইলা আসুম।
প্রতিরাতেই নজর আলী সোহেলদের বাড়ি যায় খবর শুনে রাতেই ফিরে আসে কিন্তু ঐ দিন আর ফিরলো না। হেলেনা সারারাত দু চোখের পাতা এক করতে পারে নাই। ভোর বেলায় গোয়াল থেকে গাভীটিকে বাইরে নিয়ে খড় খেতে দেয়। হেলেনা শাশুড়িকে বলে তার ছেলের খবর নিতে।
ছেলের খবর নিতে সোহেলদের বাড়ির দিকে যাওয়ার পথে শিউলির সাথে দেখা। শিউলি সোহেলের ছোট বোন। শিউলি নজরের মাকে বলে চাচী কই যাও। আমি তো তোমাগো বাড়ি যাইতাছি। কাইল হাঁজের সুময় নজর সোহেলের কাছে গেছে এতো বেলা অইলো পোলাডা তো ফিরল না। শিউলি নজরের মাকে বলে চাচী ও চাচী নজর ভাই তো আমার মিয়া ভাইয়ের সাথে রাইতেই কই যেন গেছে। পূব পাড়ার কাশেম ভাই,নুরু চাচা, আলম চাচা,জামাল ভাই, তাজুল চাচা হগলে মিলা কই যেন গেছে। আমার মনে অয় ওরা যুদ্ধে গেছে। চল তোমাগো বাড়ি চলো। এ কথা শুনে নজরের মা মাটিতে ধপাস করে বসে পরলো। শিউলি চাচীকে ধরে নজর ভাইদের বাড়ি এনে হেলেনাকে ডাকতে থাকে ভাবী ও ভাবী । হেলেনা গোয়াল ঘর পরিষ্কার করতে ছিলো। শিউলির ডাকে বাইরে এসে দেখে তার শাশুড়ি কান্না করতেছে। আম্মা ও আম্মা কান্দেন ক্যা? আপনার পোলার কি হইছে? নজরের মা কেঁদেই চলছে। শিউলি বলে ভাবী শোনো নজর ভাই আমার মিয়া ভাইয়ের লগে যুদ্ধে গেছে। এ কথা শোনার সাথে সাথে হেলেনার মাথায় বাজ পড়ল। সে যেনো কিছুই দেখছে না। শাশুড়িকে ধরে সে কান্না করতে থাকলো।শিউলি তাদের দুজনকে বুঝাতে থাকলো এই কথা যেনো কাকপক্ষীও জানতে না পারে।
অভাবের সংসার কিভাবে হেলেনা চালাবে? কিন্তু স্বামীর কাছে যুদ্ধের কথা সে প্রতি রাতেই শুনে তাই নিজেকে শক্ত করে শাশুড়িকে নিয়ে ঘরে যায়। রাতের অল্প কিছু ভাত ছিলো তাই পানি দিয়ে শাশুড়িকে খেতে দিয়ে ঘরের বাইরে যাইতেই শাশুড়ি ডাকে বউ ও বউ তুমি কি খাইবা? হেলেনা মিথ্যা বলে যে সে আগেই খাইছে। সারারাত বৃষ্টির পরে আজ খুব কড়া রোদ উঠেছে।
সুর্য মাথার উপরে একদিকে হেলেনা কিছু খায়নি অন্যদিকে সে পোয়াতি। হটাৎ করেই উঠোনে মাথা ঘুরিয়ে পরে যায়। আম্বিয়া ঘর থেকে হেলেনাকে পরতে দেখে বউয়ের কাছে এসে ধরে। চোখে মুখে পানির ছিটে দেওয়ায় হেলেনা চোখ মেলে তাকায়। শোয়া থেকে বসতে যাবে তখন হেলেনা বমি করতে উদ্ধত হয়।বারবার বমি করতে দেখে আম্বিয়া বেগম বুঝে ফেলে যে তার বউমা পোয়াতি। বউকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। হেলেনাকে জিজ্ঞেস করে কতদিন হলো লাজুক চেহারায় বলে ৩ মাস অইবো। কিন্তু আপনার পোলা এই খবর জানে না।
নজর আলী যে যুদ্ধে গেছে এটা কেউ জানে না। সোহেল মাত্র কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। এতোদিন যে তার ঘরে গ্রামের সাধারণ মানুষদের নিয়ে যুদ্ধে যাবার পরিকল্পনা চলছিল সে কথা কেউ টের পায়নি।
শিউলি এসে মাঝে মাঝে হেলেনার সাথে গল্প করে যায়। কিন্তু নজর আলীর কোনো খবর পায় না। তবে এই অলিপুর গ্রামে এখনো পাক মেলেটারি আসেনি। গ্রামটা নদীর ওপারে তাই যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না। এভাবেই মাস দুয়েক চলে গেল। হেলেনা এ বাড়ির ও বাড়ির ছোটো খাটো কাজ করে কোনো মতে শাশুড়ি বউ মিলে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।
নজর আলী বন্দরে কুলি গিরি করে যা রোজগার করতো তাই দিয়ে তাদের সংসার চলতো। প্রথমে কয়েকদিন হেলেনা খুব কান্নাকাটি করছে। আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নিয়ে পরের বার ফরমায়েশ খেটে দিন পার করছে।
নজর আলীর বাড়ি চকের মধ্যে আশে পাশে বাড়ি নাই তাই কেউ জানতেও পারেনি যে সে যুদ্ধে গেছে। কিন্তু সেদিন নদীতে গোসল করতে যাওয়ার সময় পশ্চিম পাড়ার জরিনা বু হেলেনার কাছে তার স্বামীর খবর জিজ্ঞেস করে।
তখন হেলেনা বলে আপনের দেওর ঐখানে ভালো কাম পাইছে তাই বাড়ি আসে না।এভাবেই ২ মাস পার হয়ে গেলো।
আগস্টের ১২ তারিখে গভীর রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে নজর আলী নদী সাঁতরে চুপিচুপি বাড়ি এসে মৃদু কণ্ঠে ডাকতে থাকে বউ ও বউ
(চলবে)