অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ঃ
বাংলাদেশের সঙ্গে রুপিতেই বাণিজ্য করতে চায় ভারত। বাংলাদেশের সঙ্গে পণ্য কেনাবেচার ক্ষেত্রে ডলারের পরিবর্তে ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে যাতে লেনদেন করা যায়, সেজন্য সক্রিয় উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। ভারতে আমদানি বা ভারত থেকে রফতানির ক্ষেত্রে এ দেশের ব্যবসায়ীরা যাতে রুপিতেই পেমেন্ট করতে পারেন বা নিতে পারেন, তার জন্য যাবতীয় আইনি বাধাও দূর করে দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই)।
তবে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে রুপিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে রাজি হবে কিনা, তা এখন সে দেশের সরকার ও শিল্প মহলের ওপরই নির্ভর করছে। কিন্তু ভারতের দিক থেকে তার সব প্রস্তুতিই ইতোমধ্যে সম্পন্ন।
গত সোমবার (১১ জুলাই) ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরবিআই’র চিফ জেনারেল ম্যানেজার বিবেক শ্রীবাস্তবের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংককে জানিয়ে দেওয়া হয়, এখন থেকে যেকোনও দেশের সঙ্গে ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতীয় রুপিতেই ‘সেটেলমেন্ট’ করা যাবে।
যদিও এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য হলো, রাশিয়া, ইরানের মতো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা দেশগুলোর সঙ্গে ডলারকে এড়িয়ে রুপিতে বাণিজ্য করা একই পদক্ষেপ কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
অন্যভাবে বললে, ভারত ও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের দুদেশের মধ্যে পণ্য আমদানি-রফতানির জন্য এখন যে ডলারে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খুলতে হয়, তার আর কোনও বাধ্যবাধকতা থাকবে না।
মুম্বাইতে আর্থিক ক্ষেত্রের বিশ্লেষক শুভময় ভট্টাচার্য গণমাধ্যমে বলছিলেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এখন যাতে রাশিয়া থেকে ভারতীয় কোম্পানিগুলো সহজে রুপিতে পেমেন্ট করে তেল কিনতে পারে, সেই জন্যই মূলত এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া।
কিন্তু এর ‘বাইপ্রোডাক্ট’ হিসেবে অন্য যে দেশগুলোর সঙ্গেও রুপিতে বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত হতে পারে – তার অন্যতম হলো বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা।
তিনি আরও জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু করতে ভারতের এই চেষ্টা অবশ্য নতুন নয়।
ডলার বা অন্য কোনও হার্ড কারেন্সিকে এড়িয়ে দুটো দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য চালায়, সেটাকে আর্থিক পরিভাষায় বলে ‘কারেন্সি সোয়াপ অ্যারেঞ্জমেন্ট’। বাংলাদেশের সঙ্গেও এই ধরনের ‘রুপি সোয়াপ’ করার জন্য ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক উদ্যোগ নিয়েছিল প্রায় নয় বছর আগেই।
সেটা ছিল ২০১৩-এর সেপ্টেম্বর মাস, ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির খুব কঠিন সময় যাচ্ছে। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিলেন রঘুরাম রাজন, যিনি পরিচিত ছিলেন ‘রকস্টার ইকোনমিস্ট’ হিসেবে।
গভর্নর হয়েই রুপির প্রোফাইল বাড়াতে তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যার একটা ছিল নির্দিষ্ট কিছু কিছু দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে ‘রুপি সোয়াপ’ চালু করা।
শুভময় ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘তখন বাংলাদেশ ছাড়াও ভিয়েতনাম, রাশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, তুরস্ক ও মেক্সিকো– মোট এই সাতটি দেশের সঙ্গে রুপি সোয়াপ করার নীতি ঘোষণা করেছিল ভারত। তবে ইরান ও জাপান ছাড়া আর অন্য কোনও দেশের সঙ্গেই রুপিতে বাণিজ্য করার চেষ্টা বিশেষ সফল হয়নি।’
তবে আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ হয়তো রুপিতে লেনদেন করতে নিরুৎসাহী হবে না বলেই ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা আশা করছেন।
আসামভিত্তিক সংস্থা মজুমদার অ্যাসোসিয়েটস বাংলাদেশে স্টোনচিপস, কয়লাসহ আরও নানা খনিজ দ্রব্য রফতানি করে থাকে, বাংলাদেশ থেকেও তারা নানা পণ্য ভারতে আমদানি করে।
ওই সংস্থার কর্ণধার আর মজুমদার গণমাধ্যমে বলছিলেন, ‘ডলারের দামে ওঠাপড়ার জন্য আমাদের দুদেশের ব্যবসায়ীদেরই ভুগতে হয়। ফলে আমার বিশ্বাস লেনদেনটা রুপিতে হলে তাতে দুপক্ষই উপকৃত হবে।’
তিনি একটা উদাহরণ দিয়ে বলছিলেন, ‘ধরুন ভারত থেকে পেঁয়াজ কিনতে বাংলাদেশের একটা ফার্ম এলসি খুললো, যখন ডলারের দাম ৭২/৭৩ রুপি যাচ্ছে। কিন্তু দুই মাস বাদে পেমেন্ট করার সময় ডলারের দাম বেড়ে হলো ৭৮। তখন কিন্তু তাদের অনেক বেশি পয়সা খরচ হচ্ছে, তারা এমনকি ক্ষতির মুখেও পড়ছেন। রুপিতে পেমেন্ট হলে হয়তো এই সমস্যাটা অনেকটা এড়ানো যাবে।’
দিল্লিতে ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট গগন গুপ্তাও জানাচ্ছেন, গত পাঁচ-দশ বছরে ভারতীয় রুপি আর বাংলাদেশি টাকা– দুটোর তুলনাতেই ডলারের দাম অনেকটা বেড়েছে এবং প্রচুর ভোলাটিলিটি বা ওঠাপড়া লক্ষ করা গেছে। সেই তুলনায় টাকা ও রুপির নিজেদের মধ্যে কিন্তু বেশ ভালো ‘রেজিলিয়েন্স’ দেখিয়েছে, অর্থাৎ টাকা-রুপির এক্সচেঞ্জ রেটে খুব একটা ফারাক লক্ষ করা যায়নি।
ফলে ৯ বছর আগে তেমন আগ্রহ না দেখা গেলেও এখন বাংলাদেশ রুপিতে বাণিজ্য করতে উৎসাহী হতে পারে বলেই ভারত আশা করছে। বাংলাদেশ যেহেতু ভারত থেকে অনেক বেশি পণ্য কেনে, তাই রুপি দিয়ে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কেনার মতো জিনিসেরও অভাব হবে না— এটাও যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়।