২০২২ সাল বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণের ইতিহাস সৃষ্টির বছর

Uncategorized অন্যান্য

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ঃ বঙ্গীয় ব দ্বীপটিতে ২০২২ এর মত বছর হয়ত আর আসবে না। কিন্তু কেন? বিশ্ব যখন এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশ ভূখন্ডকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা নদীগুলাকে জয় করে এখনো সব অঞ্চলের নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এই ভূখন্ডে সড়ক বা রেল সংযোগ এত সহজ নয়। ইতিহাস বলে নদীর বাধায় মুঘল সহ অনেক প্রতাপশালী রাজা বাদশাহের বিশাল সৈন্যবহর রণে ভঙ্গ দিয়েছে নদী নালা খাল বিলের বাধা অতিক্রম করতে না পারায়। এই ভূখন্ডে সড়ক বা রেল অবকাঠামো করতে গেলেও কয়েক কিলোমিটারের দুরত্বে ছোট ব্রিজ, কালভার্ট বা বড় সেতু করতে হয়। এক দশক আগেও সাগরকণ্যা কুয়াকাটা সফরের অভিজ্ঞতা থাকলে জানবেন যে প্রায় ৮-১০ টা ফেরির বাধা জয় করা লাগত। দক্ষিণাঞ্চল এদেশের উপকূল। আর যেকোন দেশের অর্থনীতি কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে এই উপকূলীয় অঞ্চল। বাংলাদেশে সেটি সম্ভব হয়নি এতদিন সরাসরি সংযোগ না থাকার ফলে। এই অঞ্চলের মানুষের লঞ্চ যাত্রা ও পানিপথের যুদ্ধকেও অনেকে হাসি ঠাট্টার বিষয়ে রুপ দিয়েছেন। কিন্তু সেটি সম্ভবত পরিবর্তন হতে চলেছে। কুয়াকাটা পর্যন্ত এখন আর কোন ফেরি নেই। অবিশ্বাস্য। লেবুখালী সেতু হবার পর একমাত্র বাধা ছিল পদ্মা সেতু। ২৬ জুন থেকে সেই বাধা জয় করা সম্ভব হয়েছে। ২০২২ কে কেন বিশেষ বছর বলছি সেটির কারন হল এই বছরে সার্ভিসে এসেছে পদ্মা সেতু। ঈদের আগের তিন দিনে এই সেতুতে পার হয়েছে ৭৪ হাজার গাড়ি। মোটরসাইকেলের অনুমতি মিললে সংখ্যাটি লাখ দেড়েক হত বলে বিশ্বাস। অনিশ্চয়তায় পথেই ঈদ করার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তাদের কাছে এবারের অনূভুতি ছিল বিশেষ কিছু। কিন্তু শুধু পদ্মা সেতু নয়। ২০২২ কে বিশেষ বলার কারন এই বছরে বেশ কিছু জনগুরুত্বপূর্ন অবকাঠামো সার্ভিসে আসতে চলেছে। এগুলা নিয়ে আজকের আলোচনা।
চট্টগ্রাম বন্দরে ১৬ বছর পর নতুন টার্মিনাল পিসিটি (পতেঙ্গা ককন্টেইনার টার্মিনাল)। নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) নির্মাণের প্রায় ১৬ বছর পর নতুন কনটেইনার টার্মিনাল নির্মিত হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এই টার্মিনালে একসঙ্গে তিনটি জাহাজ বার্থিং ও বছরে সাড়ে ৪ লাখ টিইইউ’স কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। ১,২৩০ কোটি টাকায় নির্মিত পিসিটিতে ৬০০ মিটার জেটিতে একসঙ্গে ১৯০ মিটার লম্বা ও ১০ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের ৩টি কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়ানো সম্ভব হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর বা নিউমুরিং টার্মিনালের দুরত্ব সমুদ্র থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার নদীর উজানে। কিন্তু পিসিটির দূরত্ব মাত্র ৬ কিলোমিটার। এখানে ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো যাবে। আংশিকভাবে ৯.৫ মিটারের ড্রাফটের বন্দরের সক্ষমতা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেল এই প্রকল্পের মাধ্যমে।
কালনা সেতু, জাইকার সহায়তায় নির্মিত দেশের প্রথম নেলসেন লোসআর্চ প্রযুক্তির ৬ লেনের কালনা সেতুর ইম্যাক্ট কতটা সেটা কিছু তথ্য জানলে অবাক হবেন। মধুমতী নদীর উপর নির্মিত এই সেতু বেনাপোল-ঢাকা ও যশোর-ঢাকার দূরত্ব ১১৩ কিলোমিটার, খুলনা-ঢাকার দূরত্ব ১২১ কিলোমিটার এবং নড়াইল-ঢাকার দূরত্ব ১৮১ কিলোমিটার কমিয়ে দিবে। কোলকাতার সাথে দুরত্ব কমবে ২০০ কিলোমিটার! এই একটি সেতু যেটি সম্পূর্ন বিকল্প একটি রুটের সূচনা করবে। দুরত্ব কমানোর অর্থ হল গাড়ির তেল সাশ্রয়, কর্মঘন্টা সাশ্রয়, লিড টাইম বৃদ্ধি। বাংলাদেশে মনে হয়না এখন পর্যন্ত এমন কোন সেতু আছে যেটি এত বিশাল দুরত্ব কমিয়ে দিয়েছে কোন রুটে।

নড়াইল সবসময় অবহেলিত জেলা ছিল। এখন নড়াইল, মাগুরা, ঝিনাইদহ, যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরায় ইকোনমিক এক্টিভিটি বৃদ্ধি পাবে। বিনিয়োগ উপযোগী হবে। সেই সাথে শিল্প কলকারখানার বিকেন্দ্রীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই সেতু। এই বছরে সেপ্টেম্বর /অক্টোবর মাসে সার্ভিসে আসতে পারে এই সেতু। ছয় লেনের এ সেতু হবে এশিয়ান হাইওয়ের অংশ। সেতুটির দৈর্ঘ্য হবে ৬৯০ মিটার এবং প্রস্থ ২৭.১০ মিটার। বর্ষায় পানি থেকে সেতুর উচ্চতা ৭.৬২ মিটার। উভয় পাশে সংযোগ সড়ক হবে ৪.২৭৩ কিলোমিটার, যার প্রস্থ ৩০.৫০ মিটার। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হচ্ছে ৯৫৯.৮৫ কোটি টাকা। কালনা সেতুটি জাপানের ৩৭৪৫ কোটি টাকা সহায়তায় নির্মিত ১৭ টি ব্রিজের একটি।
অষ্টম বাংলাদেশ চীন মৈত্রি সেতু/বেকুটিয়া সেতু, খরস্রোতা কচা নদীর উপর ৮৯৪ কোটি টাকার এই সেতুতে চীনের অনুদান ৬৫৪ কোটি টাকা। আর এর মাধ্যমে সেতুটির নাম হয়েছে অষ্টম চীন মৈত্রি সেতু। ভৌত কাজ ২০১৮ সালে শুরু হয়ে এখন সেতুটির কাজ সম্পূর্ন শেষ। এটি বাংলাদেশের অন্যতম দীর্ঘ সেতু। মূল সেতু ১৪৯৩ মিটার এবং ভায়াডাক্ট ৪৯৫ মিটার। ভায়াডাক্ট সহ এটি প্রায় দুই কিলোমিটারের সেতু।
এই সেতুর প্রধান ইকোনমিক ইম্প্যাক্ট হল সেতুটি খুলনা বিভাগ ও বরিশাল বিভাগকে সংযূক্ত করবে। পাশাপাশি বিভাব হওয়া সত্ত্বেও এই দুটি বিভাগ এতদিন বিচ্ছিন্ন ছিল সেতুর অভাবে। ফলে মংলা, বেনাপোল, ভোমরা, নোয়াপাড়া, পায়রা বন্দরগুলি ইন্টারকানেক্টেড হবে যেটি এই অঞ্চলের শিল্প বিপ্লবে ভূমিকা রাখতে পারবে।
তৃতীয় শীতলক্ষা সেতু, নারায়নগঞ্জ, ১২৩৪.৫
মিটারের সেতু এবং ৮৩৪.৫ মিটারের ভায়াডাক্টের ৪ লেনের এই সেতু বন্দর উপজেলাকে নারায়নগঞ্জ এর সদরের সাথে সংযুক্ত করবে। এতে দুরত্ব কমবে ৩০ কিলোমিটার। এই সেতুর মূল ইম্প্যাক্ট হল সেতুয়ি জাতীয় মহাসড়ক N-8 (ঢাকা মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে) কে N-1 বা ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ের সাথে যুক্ত করবে। ফলে ঢাকায় প্রবেশ না করে বাইপাস করে চলে যেতে পারবে গাড়ি। এই দুটি মহাসড়ক দেশের সমুদ্রবন্দরগুলির সাথে যুক্ত। এই দুটি মহাসড়কের বাইপাস সংযোগ এজন্যই এত গুরুত্বপূর্ণ। এই সেতুও ২০২২ এ সার্ভিসে আসবে।
এময়ারটি-৬ : আংশিক মেট্রোরেল MRT-6 ও সবঠিক থাকলে ২০২২ সালেই সার্ভিসে আসবে। কর্ণফুলী টানেল: টানেলের আপডেট আমার কাছে নেই। তবে আমার ধারনা হয়ত টানেল এবছর সার্ভিসে আসতে পারে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বছরে এত বড় বড় অবকাঠামো সার্ভিসে আসেনি। আর এজন্যই ২০২২ সাল বাংলাদেশের অবকাঠামোর ক্ষেত্রে একটি ইতিহাস রচনা করবে। এতদিন ধরে মেগাপ্রকল্প গুলির কাজ চলমান ছিল। ছিল ভোগান্তি। ২০২২ সালের থেকে মেগাপ্রকল্পগুলি সার্ভিসে আসা শুরু করছে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *