রোহিঙ্গাদের এনআইডি বানিয়ে দিয়ে কোটিপতি!

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক : মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে মূল গলদ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভেতরেই পাচ্ছেন খোদ তাদের কর্মকর্তারাই। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রদান কার্যক্রমের শুরু থেকে কেন্দ্রীয় সার্ভার অরক্ষিত থাকা, নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ ও সার্ভারে পাঠানোর পদ্ধতিতে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের সম্পৃক্ত করা, খোয়া যাওয়া লাইসেন্সকৃত ল্যাপটপ উদ্ধারকে বিশেষ গুরুত্ব না দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণ উঠে আসছে তদন্তে।


বিজ্ঞাপন

এর ফলে নির্বাচন কার্যালয়ের একশ্রেণির কর্মচারীর যোগসাজশে গড়ে ওঠা চক্র রোহিঙ্গাদের কাছে অবাধে সরবরাহ করেছে এনআইডি। রোহিঙ্গাদের কাছে ৫০-৬০ হাজার টাকা এনআইডি বিক্রির তথ্য পেয়েছে পুলিশ।


বিজ্ঞাপন

সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাতে চট্টগ্রাম নগরীর ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদিনসহ তিনজনকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন জেলা নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তারা। জয়নালকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এবং নির্বাচন কমিশনের গঠিত বিশেষ টিমের তদন্তে উঠে এসেছে নানা তথ্য।

জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের একটি ল্যাপটপ চুরি করে ওই ল্যাপটপের মাধ্যমে জয়নাল রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতেন বলে জানিয়েছেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসাইন।

অবৈধভাবে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে জয়নাল এই বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন বলে জানাচ্ছেন এলাকাবাসী। তবে তার পরিবারের দাবি, ওমান প্রবাসী ভাইয়ের উপার্জনে তাদের এই বিত্তবৈভব।

অথচ দুই বছর আগে তিন কক্ষের থাকতেন জয়নাল আবেদিন ও তার পরিবার। কিন্তু দুই বছর পার না হতেই তিনি এখন কোটিপতি! বাঁশখালী পৌরসভার দক্ষিণ আসকরিয়াপাড়ায় তিন গন্ডা (১ গন্ডা সমান ১.৯৮ শতাংশ) জায়গা কিনে সেখানে গড়ে তুলছেন পাঁচ তলা ভবন। ছোট ভাই জসিম উদ্দিনের নামে কেনা হয়েছে আরও সাড়ে তিন গন্ডা জায়গা।

২০০৪ সালে নির্বাচন কমিশনে অফিস সহায়ক পদে নিয়োগ পাওয়া জয়নাল আবেদীনের এত উত্থানের পেছনে ছিল নির্বাচন কমিশনের এই ল্যাপটপ। এটি ব্যবহার করেই তিনি বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন বলে মনে করছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। জয়নাল একা নন, এই চক্রের সঙ্গে রয়েছেন আরও কয়েকজন। নির্বাচন কমিশনের ঢাকাসহ বিভিন্ন অফিসে জয়নালের অন্তত ১০ স্বজন কর্মরত রয়েছেন। এলাকার অনেকের অভিযোগ, রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশে পাঠাতেন জয়নাল ও তাঁর ভাই জসিম উদ্দিন চৌধুরী।

গত ১৮ আগস্ট লাকী আক্তার নামে এক রোহিঙ্গা নারী স্মার্টকার্ড নিতে গিয়ে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে আটক হয়। এরপর ইসির গঠিত তদন্ত কমিটি চট্টগ্রামে ৪৬ জন রোহিঙ্গা নাগরিকের সন্ধান পায়। এরা এনআইডি কার্ড পেয়েছে ও তাদের সব তথ্য কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষিত আছে। এরপর তিন সদস্যের একটি বিশেষ তদন্ত টিম গঠন করে ইসি, যার দায়িত্বে আছেন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের (এনআইডি উইং) উপ-পরিচালক ইকবাল হোসেন। ১১ সেপ্টেম্বর থেকে এই টিম কক্সবাজারে কাজ শুরু করে। প্রথমে দুজন রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করা হয়, যাদের এনআইডি কার্ড আছে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দুজন রোহিঙ্গা দালালসহ আরও পাঁচজনকে আটক করা হয়।

আটক তিনজনসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালী থানায় মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) মামলা করেন ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কর্মকর্তা পল্লবী চাকমা। মামলায় আটক জয়নাল আবেদিন ও তার ল্যাপটপ হেফাজতে রাখা বিজয় দাশ এবং সুমি দাশ ওরফে সুমাইয়া আক্তারের সঙ্গে আরও দুজনকে আসামি করা হয়। এরা হলেন- সাগর (৩৭) ও সত্যসুন্দর দে (৩৮)।

কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন জানান, জয়নালকে জিজ্ঞাসাবাদে সাগর ও সত্যসুন্দরের তথ্য পাওয়া গেছে। দুজনই ২০০৮ সালে এনআইডি শাখায় কর্মরত ছিল। সাগর এনআইডি সার্ভারে আপলোড করত। তার কাছে দেশের সব উপজেলার এনআইডি আপলোডের পাসওয়ার্ড আছে। বর্তমানে সে বিআরটিএতে কর্মরত আছে।

সত্যসুন্দর ডাটা এন্ট্রি এক্সপার্ট। এনআইডি সার্ভারে অনুপ্রবেশের দায়ে তাকে ইসি থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। তবে এরপরও টাকার বিনিময়ে সে বিভিন্ন উপজেলায় গিয়ে এনআইডির জন্য ডাটা এন্ট্রির কাজ করত। বর্তমানে সে ঢাকার মিরপুর এলাকায় কাজ করছে।

ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, সাগর এনআইডি সার্ভারে তথ্য আপলোড করতেন। তার কাছে দেশের সব উপজেলার এনআইডি আপলোডের পাসওয়ার্ড আছে। বর্তমানে তিনি বিআরটিএতে কর্মরত। সত্য সুন্দর ডেটা এন্ট্রি এক্সপার্ট। ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় একটি এনআইডি করে দিতেন। মামলাটি কাউন্টার টেররিজম ইউনিট তদন্ত করছে বলে জানান ওসি মহসীন।

কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘জয়নাল প্রথমে এনআইডিতে ভুল সংশোধন করে দিত। এ জন্য সে লোকজনের কাছ থেকে ৮-১০ হাজার থেকে ৫০-৬০ হাজার পর্যন্ত নিয়েছে বলে আমাদের জানিয়েছে। তার সঙ্গে সাগর ও সত্যসুন্দরের যোগাযোগ আছে। জয়নালের কাছে যে ল্যাপটপ পাওয়া গেছে সেটি ১০ হাজার টাকায় সে সাগরের কাছ থেকে কিনেছিল।’

‘সাপ্তাহিক বন্ধের আগের দিন সে অফিস থেকে ওয়েবক্যাম, ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়ার যন্ত্র, স্ক্যানার, সিগনেচার প্যাড বাসায় নিয়ে যেত। রোহিঙ্গাদের এনআইডির জন্য ছবি, আঙুলের ছাপসহ আনুষঙ্গিক সব তথ্য নিয়ে ঢাকায় সাগরের কাছে পাঠাত। সাগর উপজেলার পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে এনআইডি তৈরি করত এবং সেন্ট্রাল সার্ভারে ইনপুট দিত। পরে সেই এনআইডি এস এ পরিবহনের মাধ্যমে জয়নালের কাছে পাঠাত। সত্যসুন্দরও একই প্রক্রিয়ায় সার্ভারে ঢুকে এনআইডি তৈরি করে জয়নালকে সরবরাহ করত।’

ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যে তথ্য পেয়েছি, এটা একটা অর্গানাইজড ক্রাইম। বড় চক্র জড়িত বলে আমাদের ধারণা। মামলাটি কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট তদন্ত করছে। আশা করি, সব তথ্য উদঘাটন হবে।’

সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাতে জয়নাল আবেদিনের কাছ থেকে যে ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছে সেখানে আরও ৫১ জন রোহিঙ্গার তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ইসির গঠিত বিশেষ তদন্ত টিমের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন। তিনি বলেন, ‘২০০৭-০৮ সালে ইসি যখন প্রথম এনআইডি তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়, তখন মাঠপর্যায়ে যেসব ল্যাপটপ পাঠানো হয়েছিল, ২০১৪ সালে তার থেকে ২টি ল্যাপটপ হারিয়ে যায়। আমাদের ধারণা, জয়নালের কাছে যে ল্যাপটপটি পাওয়া গেছে সেটি ওই হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটপের একটি। আমরা যখন কাজ শুরু করি, তখন জয়নাল ল্যাপটপ থেকে অনেক তথ্য সরিয়ে ফেলেছে। তবে ৫১ জনের তথ্য আমরা পেয়েছি, যাদের সবাই রোহিঙ্গা। কিন্তু তারা এনআইডি পেয়েছে কি না সেটা আমরা এখনও জানি না। সেটার তদন্ত করছি।’

কে এই জয়নাল

২০০৪ সালে তার মামা তৎকালীন নির্বাচন কমিশন সচিব স ম জাকারিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন অফিসে অফিস সহায়ক (চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী) হিসেবে যোগদান করেন জয়নাল আবেদিন। দীর্ঘদিন রাঙামাটি নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে কাজ করার পর ২০১৭ সালের দিকে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে আসেন। অভিযোগ রয়েছে, এরপরই জাল জালিয়াতির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কাজ শুরু করেন। রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র পাইয়ে দিয়ে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। স্থানীয়দের ধারণা ওই টাকা দিয়েই জয়নাল নিজ এলাকায় জায়গা কেনাসহ পাঁচ তলা ভবন তৈরি করছেন।

মোস্তফা আলী নামে এক প্রতিবেশী বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে জয়নালের পরিবার চলতো। কোনোমতে দিনে এনে দিনে খেতো। কিন্তু রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার পর থেকেই তাদের পরিবারের ভাগ্য খুলতে শুরু করে। ৬/৭ মাসের ব্যবধানে প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচ করে দুই খণ্ড জমি কিনে ফেলে। এর মধ্যে পৌরসভার দক্ষিণ আসকরিয়াপাড়া এলাকায় নির্মাণ করছে পাঁচ তলা ভবন। ছয় মাস আগে নির্মাণ কাজ শুরু হওয়া ওই ভবনের তিন তলার কাজ শেষ ইতোমধ্যে চার তলার ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে।’

বাঁশখালী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ হারুন বলেন, ‘জয়নাল আবেদিনের বাবা মোনাফ মাঝি খুবই গরিব ছিল। ২০ বছর আগে তিন কড়া জমির ওপর শুধু একটি মাটির বসত ঘর ছিল। এখন তাদের অনেক টাকা পয়সা। এলাকার লোকজন বলাবলি করে, জয়নাল রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এসব টাকা কামিয়েছেন। আসকরিয়াপাড়ায় নতুন বাড়ি তৈরি করতেছে। পাঁচ মাসে পাঁচ তলা ভবনের চার তলা পর্যন্ত ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। ব্যাংকেও নাকি প্রচুর টাকা আছে।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে জয়নালের মা দিলদার বেগম বলেন, আমার ছোট ছেলে ওমান থাকে। তার টাকায় ওই বিল্ডিং তৈরি করছি। ছোট ছেলের ওমানে দোকান আছে, সেই টাকাগুলো পাঠিয়েছে। জসিমের নামে সাড়ে তিন গন্ডা জায়গা কেনার বিষয়ে তিনি বলেন, জায়গাটা আমার ভাই আমাকে দিয়েছে। ওদের বাবা এটা জসিমের নামে রেজিস্ট্রি করেছেন।

ছোট ছেলের নামে জায়গা থাকার পরও জসিম কেন জয়নালের নামে থাকা জায়গায় ভবন নির্মাণ করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই জায়গাটা রাস্তা থেকে একটু দূরে। তাই আমার ছোট ছেলে বলেছে ওখানে বাড়ি না করে এই জায়গায় বাড়ি করে দুই ভাই একসঙ্গে থাকবে। তাই দুই ভাই মিলে বাড়িটি করছে।

জায়গা কেনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের থাকার জায়গা নেই। তাই ঘর করার জন্য জায়গা কিনতে হয়েছে। পুরনো বাড়িতে টিনের চাল, আর চারপাশে মাটির দেয়াল থাকা ছোট একটা ঘর আছে।

জয়নালের ছোট ভাই জসিম উদ্দিন বলেন, আমার ওমানে দোকান আছে। আমি ওই দোকানের ইনকাম দিয়ে জায়গা কিনেছি। পাঁচ তলা এই বিল্ডিং তৈরি করছি। আমি ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েছি। আপনারা চাইলে আমার ব্যাংক হিসাব চেক করে দেখতে পারবেন।

একাধিক স্বজন কমিশনে

জয়নালের অন্তত ১০ স্বজন নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন পদে চাকরি করেন। জয়নালের মতোই ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম নির্বাচন কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে যোগ দেন তাঁর বোনের জামাই নূর আহমদ। রোববার দুদকের দলটি চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে গিয়ে এই দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক জাফর সাদেক বলেন, তাঁদের অনেক স্বজন ঢাকাসহ বিভিন্ন কার্যালয়ে কাজ করেন। এটা একটা চক্র। এই চক্রের সন্ধানে কাজ চলছে।

জয়নালের খালাতো ভাই মো. মোজাফফর কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ে অফিস সহকারী পদে রয়েছেন। আরেক স্বজন মোহাম্মদ আলী রাঙামাটি জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে উচ্চমান সহকারী। আরেক স্বজন ওসমান গনি চৌধুরী রয়েছেন ঢাকায় নির্বাচন কমিশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে। তাঁরা ২০০৪ সালে নিয়োগ পান।

জয়নালের বোনের জামাই নূর আহমদ বলেন, ‘জয়নালের কারণে আমাকে সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আমি এসবে জড়িত নই।’


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *