সুমন হোসেন, যশোর ঃ
‘ধন্য জীবন তাহারি, যে জন নিজে বিচারিয়া নিজের তরে নীতি ও নিয়ম করি প্রণয়ন, আমরণ তাহা পালন করে’।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এই উক্তিটি আমরণ পালন করার লক্ষ্যে যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার পায়রা ইউনিয়নের কাদিরপাড়া গ্রামের কৃতী সন্তান হিসেবে সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন সুরাইয়া। তার জীবন থেকে নেওয়া এবং বিবাহিত নারী হয়েও সংগ্রামের মাধ্যমে স্বপ্নপূরণ ও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার গল্প শুনালেন।
তিনি এবারের ১৪তম বিজেএস (বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস) এ সহকারী জজ (জুডিশিয়াল) পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। সদ্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে অভয়নগরের ১ম নারী জর্জ হিসাবে তার অনুভূতি এবং জজ হওয়ার পিছনে দীর্ঘ পথচলার অভিজ্ঞতাগুলো সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন আজকের দেশ পত্রিকার যশোর ব্যুরো প্রধান সুমন হোসেন।
আজকের দেশঃ আপনি অভয়নগর থানা থেকে প্রথম সুপারিশপ্রাপ্ত নারী জর্জ। আপনাকে নিয়ে আপনার পরিবার, আত্মীয়স্বজন এমনকি এলাকার মানুষের অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। তাদের উদ্দ্যেশে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।
সুরাইয়াঃ আলহামদুলিল্লাহ। আমি নিজের ও পরিবারের সবার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি। আমার এলাকার মানুষের মাঝে আমাকে নিয়ে যে উচ্ছ্বাস দেখেছি, তা আমাকে আরও অনেক বেশি আনন্দিত করেছে এবং তাদের প্রতি আমার দ্বয়িত্ববোধ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আজকের দেশঃ একজন সহকারী জর্জ মনোনিত হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনার কাছে জানতে চাই?
সুরাইয়াঃ একজন সহকারী জর্জ মনোনিত হওয়ার প্রক্রিয়া হলো অনেকটা বিসিএস পরীক্ষার মতো। শুরুতে প্রিলিমিনিয়ারী পরিক্ষা। এই পরিক্ষায় উত্তীর্ণদের জন্য লিখিত পরীক্ষা। এই লিখিত পরীক্ষায় যারা ভালো রেজাল্ট করে, তাদের জর্জ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এরপর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ভাইভা পরিক্ষায় ডাকা হয়। ভাইভাতে উত্তীর্ণদের মধ্যে থেকে চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এই মনোনীত প্রার্থীরা সরকারের প্রঙ্গাপনের মাধ্যমে সহকারী জুডিশিয়াল (প্রবেশ) পদে নিয়োগ পায়।
আজকের দেশঃ শুনেছি, আপন হাতেখড়ি থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত আপনার পড়াশোনার ভিত্তি গড়ে উঠেছে গ্রামের মাদ্রাসা থেকে।
আপনি হয়তো জানেন, এখনও অধিকাংশ মানুষ মনে করেন মাদ্রাসায় পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী আর জেনারেল লাইনে পড়ুয়া আরেকজন শিক্ষার্থীর লেবেল একই হয় না। এক্ষেত্রে আপনি মাদ্রাসা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার প্রতি মানুষের গোঁড়ামি ভেঙ্গে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। এটা করা আপনার পক্ষে কতটা কঠিন ছিল? এবং কিভাবে এটি করতে সক্ষম হলেন ?
সুরাইয়াঃ কিছু ভাবনা দিয়ে তো আর জীবনযাপন হয় না, তবে আমি নিজে এটা কখনও সম্মুখীন হইনি । আমাকে কেউ মাদ্রাসার শিক্ষার্থী বলে আলাদা করে দেখেননি। আর সমাজের ইতিবাচক দিকগুলো আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে।
আজকের দেশঃ লক্ষ্যবিহীন জীবন, আর নোঙ্গরবিহীন নৌকা, দুটোই অর্থহীন বিষয়। লক্ষ্য ছাড়া মানুষের জীবন প্রদীপ অন্ধকারে মুড়ানো। তাই তো, জীবনকে অর্থবহ করতে আপনিও বিচারক হওয়ার লক্ষ্য করেছিলেন। কার অনুপ্রেরণা এবং উৎসাহে আইনে ভর্তি হয়ে বিচারক হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন?
সুরাইয়াঃ আসলেই লক্ষ্য ছাড়া সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব না। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমাকে এমন একজন বড় ভাই দিয়েছেন। যিনি আমাদের ভাই -বোনদের কান্ডারী। উনার অনুপ্রেরণাই আমাদের চলার পাথেয় ছিল। আমি যখন মাদ্রাসায় পড়তাম তখন জানতাম না উচ্চশিক্ষার প্রকৃত অর্থ। তিনিই আমাকে ঢাবিতে ল পড়ে জজ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ।
আজকের দেশঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার পাশ করার পর বেশ একটা দীর্ঘ বিরতির পরও আপনি, আপনার স্বপ্ন পূরণ করেছেন। এর মধ্যে আপনি একটি সন্তানের জননীও হয়েছেন। এক্ষেত্রে সংসার-বাচ্চা এগুলো সামলিয়ে আপনার স্বপ্ন পূরণের যাত্রাটা কেমন ছিল আর কতটা মসৃণ ছিল?
সুরাইয়াঃ আমার মেয়ে সালওয়া আমার জীবনের সেরা উপহার। আমি ঢাবিতে পড়াকালীন ওর জন্ম হওয়াতে, নিজের শারীরিক কারণে একাডেমিক একটা গ্যাপ পড়ে যায়। তারপর বাচ্চাকে ভালভাবে সময় দেয়া এবং নিজেকে গুছিয়ে আবার পড়াশোনা শুরু করতে অনেকটা সময় লেগে যায়। তবে এক্ষেত্রে আমার স্বামী, বাবা-মা,ভাইবোন আমার পাশে ছিলেন সবসময়। তারা আমাকে বারবার সাহস দিয়েছেন, আমার জন্য দোয়া করেছেন। আমি অনুরোধ করব এভাবে অন্য মেয়েদের পরিবার বিশেষভাবে বিয়ের পর স্বামী ও তার পরিবারের লোকেরা যেন মেয়েদের পাশে থাকে।
আজকের দেশঃ জর্জ হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া কালে সব থেকে স্মরণীয় কিংবা কঠিন কোন পরিস্থিতি পার করছেন ? যেটি আপনাকে আরও বেশি সাহসী করেছে জর্জ হওয়ার ক্ষেত্রে। সেরকম কিছু অভিজ্ঞতা শুনতে চাই।
সুরাইয়াঃ বেশ লম্বা বিরতির পর থেকে ১৪তম জুডিসিয়ারি পর্যন্ত এই লম্বা সময়ে আমি কোচিং, গ্রুপ স্ট্যাডি সবই করেছি। পাশাপাশি দুটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে কাজে যোগদানও করেছিলাম। তবে ঘরে বাইরে যেখানেই আমি যাই করি না কেন, আমার মেয়ে ছিল আমার সবচেয়ে বড় শক্তি ও অনুপ্রেরণা।
আজকের দেশঃ সবেমাত্র জীবনের সমীকরণ থেকে একটি স্বপ্ন পূরণ করলেন। এরপর আপনার পরবর্তী উদ্দেশ্য কি ?
সুরাইয়াঃ প্রথমত এই পেশায় থেকে সততার সঙ্গে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চাই। বৃহৎ পরিসরে এলাকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষ বিশেষ করে নারী এবং দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু করতে চাই।
আজকের দেশঃ নিজের এলাকা এবং দেশের উন্নয়নে নিজের কাজের জায়গাগুলো কিভাবে সঠিক রাখবেন ?
সুরাইয়াঃ উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমার মনে হয় খুব বেশি একটা করা দরকার হয় না । প্রত্যেকে সততার সঙ্গে নিজের কাজটা করলেই, আমরা- আমাদের পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারি । আমিও সেভাবেই একজন কন্যা-জায়া-জননী এবং পেশাজীবী মানুষ হতে চাই।
আজকের দেশঃ সর্বোপরি নিজের কাজের প্রতি বেশি যত্নশীল হয়ে কিভাবে আপনার প্রতি চেয়ে থাকা অভয়নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করবেন ?
সুরাইয়াঃ হ্যাঁ, এলাকার সন্তান হিসাবে পুরো এলাকাবাসীর প্রতি নিজের পারিবারিক বন্ধন অনুভব করি, সে জায়গা থেকে আমি সর্বদা আমার পরিবারের সদস্যদের মতো তাদের পাশে থকবো, ইনশাআল্লাহ।সুরাইয়াঃ অভয়নগর বাসীর প্রত্যাশা পূরনে অবশ্যই আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবো। নিজের এলাকা হিসেবে সুখে-দুঃখে তাদের পাশ্বে থাকতে চাই।
আজকের দেশঃ আপনি তারুণ্যের গর্ব। তাদের (নতুন প্রজন্ম)- এর জন্য আপনার মুল্যবান মতামত আমরা শুনতে চাই?
সুরাইয়াঃ তারুণ্য সব সময় নতুনকে স্বাগত জানায়। নর্তমান সময়ে ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল প্লাটফর্মের ভালো দিক গুলো, তারা যেন গ্রহন করে। তাদেরকে নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাসটি চর্চা করতে হবে। জীবনে নির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য নিয়ে সামনের এগোতে হবে। সর্বপরি সকলের জন্য শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইলো। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি যেন গরীব-দুঃখী, নির্যাতিত, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি।