বাজারজাত হচ্ছে নিষিদ্ধ ওষুধ

অপরাধ অর্থনীতি এইমাত্র জাতীয় বানিজ্য সারাদেশ

বিশেষ প্রতিবেদক : সম্প্রতি বেশকিছু ওষুধের নিবন্ধন বাতিল করেছে সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এর মধ্যে চারটি অ্যান্টিবায়োটিক, তিনটি অ্যানোসথেটিক, পাঁচটি অ্যান্টিসাইকোটিক, ৬১টি ভিটামিন কম্বিনেশন ও নয়টি ইলেক্ট্রোলাইট কম্বিনেশন রয়েছে। কিন্তু নিবন্ধন বাতিলের পরও বেশিরভাগ ওষুধ এখনো উৎপাদন ও বাজারজাত করছে কোম্পানিগুলো।
জানা গেছে, গত ৩০ এপ্রিল ‘ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কমিটি’র ২৫০তম সভায় ৮২টি ব্র্যান্ডের ওষুধের কম্বিনেশন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সই করা ওই আদেশ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি গত ৭ মে প্রকাশ করা হয়। এতে মোট ৪১টি ওষুধ (জেনেরিক নাম অনুসারে) নিষিদ্ধ করা হয়, যার মধ্যে অন্তত ২০টি ওষুধ (জেনেরিক নাম অনুসারে) এখনো বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, এমনকি উৎপাদনও হচ্ছে। এগুলো আরও দুই থেকে তিন বছর বাজারে পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট শাখার পরিচালক নায়ার সুলতান বলেন, ‘ওষুধ প্রশাসন সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে বক্তব্য শুধু মহাপরিচালকই দিতে পারবেন আর কেউ নয়। তাই আমি কোনো কথা বলতে চাই না।’ কিন্তু মহাপরিচালক দেশে না থাকায় আবারও তার কাছে জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর নতুন করে উৎপাদন করার কথা নয়।
বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দুই মাস পরও ওষুধগুলো নতুন করে উৎপাদন করা হয়েছে, যার মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত। এ তথ্য জানার পর তিনি এ বিষয়ে খোঁজ নেবেন বলে জানান।
এসব কম্বিনেশন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, ‘যে কমিটির মাধ্যমে এসব ওষুধের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে, প্রায় ৩০ বছর আগে এ কমিটিই এসব কম্বিনেশনের অনুমোদন দিয়েছিল। তখন আমরা এর প্রতিবাদ করেছিলাম। কারণ এসব কম্বিনেশন একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ও রোগীদের চিকিৎসায় কোনো প্রয়োজন নেই।’
তিনি বলেন, ‘যেসব ভিটামিন কম্বিনেশন অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো খাওয়া ও বিপুল পরিমাণ টাকা প্রস্রাবের সঙ্গে বের করে দেওয়া একই কথা। তখন প্রশাসন আমাদের কথা আমলে না নিয়ে ওষুধ কোম্পানির মুনাফার দিকে গুরুত্ব দিয়েছিল।’
এ অধ্যাপক বলেন, যেসব ওষুধের নিবন্ধন বাতিল করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে, সেখানেও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর চতুরতার আশ্রয় নিয়েছে। কারণ সেখানে শুধু বলা হয়েছে, নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি যে, অমুক দিন থেকে এ ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করা যাবে না, কেউ করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অর্থাৎ এখানেও ওষুধ কোম্পানিগুলোকে সুযোগ করে দেওয়া হলো। কাঁচামাল রয়ে গেছে- এ অজুহাতে যেন আরও দু-এক বছর এগুলো বেচতে পারে।
জানা গেছে, ওষুধ কোম্পানিগুলো নিবন্ধন বাতিল করা এসব ওষুধ এখনো তৈরি করছে। তারা নানাভাবে এসব ওষুধের বাজার তৈরি করেছে। বিশেষ করে অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধের অপব্যবহার বেশি। এ ওষুধগুলো শরীরে ক্ষতিকারক মাদকতা সৃষ্টি করে। যদিও আইনানুসারে নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পর এসব ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত বন্ধ করতে হবে। এছাড়া যেগুলো বাজারে রয়েছে সেগুলোও দোকান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে ধ্বংস করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, এটা শুভ লক্ষণ যে অপ্রয়োজনীয় কিছু কম্বিনেশন বাতিল করা হয়েছে। এসব কম্বিনেশন উপকারী নয়। তাছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, অতি প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট দু-একটি কম্বিনেশন ছাড়া কোনো ওষুধের কম্বিনেশন করা যাবে না।
নিবন্ধন বাতিল হওয়া যেসব ওষুধ এখনো বাজারে সহজলভ্য তার মধ্যে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ভ্যাসকুরিন সাপোজিটরি, হেলথকেয়ার ফার্মার আর্থ্রোফেন, এভারেস্ট ফার্মার ডিভিসি ৫০/২০০, এপেক্স ফার্মার ডিক্সট্রা, এরিস্টো ফার্মার এর্ডন সুপার, স্কয়ার ফার্মার মাইক্লোফেনাক, জেনারেল ফার্মার মিসক্লো ৫০/২০০, একমি ল্যাবরেটরিজের মিসোফেনাক ৫০/২০০, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনালের নোপেইন এক্স ৫০, প্যাসিফিক ফার্মাসিউটিক্যালসের প্যানফ্রি পস্নাস ৫০/২০০, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রোফেনাক পস্নাস ৫০/২০০, বেক্সিমকো ফার্মার আল্ট্রাফেন পস্নাস, কেমিকো ফার্মার অ্যাপেইন এমএস, হেলথকেয়ার ফার্মার আর্থ্রোফেন, স্কয়ার ফার্মার মাইক্লোফেনাক ৭৫/২০০, জেনারেল ফার্মার মিসক্লো ৭৫/২০০, সোমাটেক ফার্মার মিসোফেন ৭৫/২০০ ও ড্রাগ ইন্টারন্যাশনালের নো পেইন এক্স ৭৫ ট্যাবলেট অন্যতম।
বিজ্ঞপ্তিতে এসব ওষুধ অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে উলেস্নখ করা হয়েছে। তবে ওষুধ-প্রযুক্তিবিদরা জানান, এগুলো মূলত ব্যথানাশক কম্বিনেশন।
অ্যানেস্থেটিক কম্বিনেশন ওষুধের মধ্যে যেগুলো বাজারে অহরহ বিক্রি হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে পপুলার ফার্মার বুপি হেভি, কেমিস্ট ল্যাবরেটরিজের বুপিকেইভ হেভি, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের স্পাইনো, হেলথকেয়ার ফার্মার ভেস্পাইভ ইনজেকশন।
অ্যান্টিসাইকোটিক কম্বিনেশন ওষুধের মধ্যে রয়েছে অ্যামিকো ল্যাবরেটরিজের অ্যামিভাল ও অ্যামিভাল এফ, অ্যালকো ফার্মার এনফ্লু, বেক্সিমকো ফার্মার অ্যাপ্রেসিন, বায়োফার্মা ল্যাবরেটরিজের ইউফোর, জেনারেল ফার্মার ফ্লুট্রিপ, নিপা ফার্মার ফ্রেশ, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালসের মুডঅন, একমি ল্যাবরেটরিজের নরফ্লু, এরিস্টোফার্মা নরজিন, অপসোনিন ফার্মার পারমিভাল, সোমাটেক ফার্মাসিউটিক্যালসের ট্রিপনর ও এসকায়েফ ফার্মা টেলাবিড ১, টেলাবিড ২, টেলাবিড ফোর্টি নামের ট্যাবলেট।
ভিটামিন কম্বিনেশনের মধ্যে রয়েছে অ্যালবিয়ন ল্যাবরেটরিজের ডায়ালেক্ট-এম, জেসন ফার্মার ফেমিক্যাপ, সুপ্রিম ফার্মার সুপ্রাফল টিআর, জেনারেল ফার্মার আইরোফল, মেডিনেট ফার্মার ফেরিগান, অ্যামিকো ল্যাবরেটরিজের ফেরো টিআর, এইক্সিম ফার্মার ফেরোফি জেডটিআর, হাডসন ফার্মার ফেরোসন টিআর, কুমদিনি ফার্মার ফেরন টিআর, বেনহাম ফার্মার হেমোফল-টিআর, ফার্মাশিয়ার আইটপ, ইবনে সিনা ফার্মার সিনাফেরন, অ্যালবিয়ন ফার্মার অ্যালফল টিআর, এপিসি ফার্মার এপিফল টিআর, সিনথো ল্যাবরেটরিজের অ্যাস্ট্রো জেড, বায়ো ফার্মা ল্যাবরেটরিজের বিরন পস্নাস, কসমিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের জিরন এফ, অ্যাপোলো ফার্মার জিমোবিন, ডিসেন্ট ফার্মার জিলিক টিআর, ইউনিমেড অ্যান্ড ইউনিহেলথ ম্যানুফ্যাকচারারের জিফা টিআর, স্কয়ার ফার্মার জিফ, দেশ ফার্মার ট্রাইফল, সিলভা ফার্মার প্রেনাটল, এফএনএফ ফার্মার নুফিজ, হাডসন ফার্মার আইরন, মাইস্টিক ফার্মার ফলিরন টিআর, হোয়াইট হর্স ফার্মার ফিজ-টিআর, ওরিয়ন ফার্মার ফেরোলিন টিআর, সেন্ট্রাল ফার্মার ফেরোফল জেড, মেডিকন ফার্মার ফিওলেট টিআর পস্নাস মেডিকন, নিপা ফার্মার ফেফা টিআর, হলমার্ক ফার্মার ফেলবি টিআর, এশিয়াটিক ফার্মার টিআর এবং মডার্ন ফার্মার এফই-জেড, একমি ল্যাবরেটরিজের এ ক্যাল ডিএক্স, হোয়াইট হর্স ফার্মার কোরালভিট-ডি, নিপ্রো জেএমআই ফার্মার স্টারক্যাল ডি ফোর্টি, ইউনিমেড অ্যান্ড ইউনিহেলথ ম্যানুফ্যাকচারারসের অসক্যাল ডি ও ওকিক্যাল-ডি, নোভেল্টা বেস্টওয়ে ফার্মার নোভাক্যাল- ডিএক্স, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ক্যালবো ফোরটি এবং ইবনে সিনা ফার্মার আইপিক্যাল-সি।
ইলেক্ট্রোলাইটের মধ্যে অপসো স্যালাইনের ডেকট্রোজ ৪.৩%+সোডিয়াম ক্লোরাইড ০.১৮% আইভি ইউনফিউশন যেটি আইডিএস নামে পরিচিত, এর উৎপাদনও অব্যাহত রয়েছে, বাজারে সরবরাহও স্বাভাবিক। এগুলোর গায়ে উৎপাদনের তারিখ লেখা জুলাই ২০১৯ ও মেয়াদ জুলাই ২০২২ পর্যন্ত। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অপসোনিন ফার্মার এরিয়া ম্যানেজার শাকিল জাহাঙ্গীর কিছু জানেন না বলে জানান।
বাজারে একই ধরনের কম্বিনেশন রয়েছে ওরিয়ন ফার্মা, পপুলার, বেক্সিমকো ও লিবরার। সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও গ্লুকোজের একটি ওরাল স্যালাইন কম্বিনেশন ইন্দোবাংলা, পপুলার, রেনেটা, ব্রিস্টাল, মেডিকন, এমিকো ল্যাবরেটারিজ বাজারজাত করছে। এছাড়া ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম ও সোডিয়ামের নিবন্ধন বাতিল করা একটি কম্বিনেশন স্যালাইন বাজারজাত করছে পপুলার ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেড।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *