হাইব্রিডদের চেয়ার নড়বড়ে

এইমাত্র জাতীয় রাজনীতি

প্রতিটি স্তরে পরিচ্ছন্ন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ঢেলে সাজানো হচ্ছে আ’লীগ

বিশেষ প্রতিবেদক : দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলকারী, অনুপ্রবেশকারী, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসায়ীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সম্মেলনের আগেই তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে পরিচ্ছন্ন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি। ইতোমধ্যে এ লক্ষ্যে বেশকিছু নির্দেশনা দলের সিনিয়র নেতাদের দিয়েছেন।
আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সম্মেলনের আগেই আওয়ামী লীগের তিন সহযোগী ও এক ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সম্মেলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী ২ নভেম্বর কৃষক লীগ, ৯ নভেম্বর আওয়ামী যুবলীগ, ১৬ নভেম্বর স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ২৩ নভেম্বর জাতীয় শ্রমিক লীগের সম্মেলনের প্রাথমিক তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতে চার দিনের সফরে যাওয়ার আগের দিন রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সিদ্ধান্ত দিয়ে যান বলে দলের একাধিক নীতিনির্ধারকসূত্রে জানা গেছে।
বুধবারের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগেই যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের সম্মেলনের তারিখ ঠিক করে দেন। বৈঠকে চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি। নেতাদের সতর্ক করে শেখ হাসিনা বলেন, কাউকে বাঁচানোর জন্য তদবির করতে আসবেন না। কোনো অস্ত্রবাজ-চাঁদাবাজকে শেল্টার দেবেন না। সবার আমলনামা আমার হাতে রয়েছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা বলছেন, দলকে জনপ্রিয় করতে এবং ঢেলে সাজাতে এবার কঠোর হয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি চান পরীক্ষিত ও দলের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ব্যক্তিরাই দলের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকুন। সে কারণে আগাছা-পরগাছা পরিষ্কার করতে দলের সম্মেলন করার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। এজন্য ৩০ নভেম্বরের মধ্যেই যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের সম্মেলন করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ৩০ নভেম্বরের মধ্যেই যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের সম্মেলন হবে। নেত্রীর সঙ্গে আলাপকালে যা বুঝেছি, তা হচ্ছে ক্লিন ইমেজ, উজ্জ্বল ভাবমূর্তি যার রয়েছে তারাই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটিতে আসবেন। নাম প্রকাশ না করে আওয়ামী লীগ সম্পাদকমন্ডলীর একজন সদস্য বলেন, প্রাথমিক খসড়া অনুযায়ী ২ নভেম্বর কৃষক লীগ, ৯ নভেম্বর যুবলীগ, ১৬ নভেম্বর স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ২৩ নভেম্বর জাতীয় শ্রমিক লীগের সম্মেলন হবে। এটা খসড়া। প্রধানমন্ত্রী সময় দিলেই উক্ত সময়ে সংগঠনগুলোর সম্মেলন হবে।
আরেকটি সূত্র জানায়, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষকলীগ ও শ্রমিকলীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অবৈধ পন্থায় বিত্তশালী হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে জামায়াত-বিএনপি থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের সহযোগী সংগঠনগুলোতে স্থান দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ সংক্রান্ত অভিযোগের তালিকা ও গোয়েন্দা রিপোর্ট রয়েছে। অভিযুক্তদের আগামীতে দায়িত্বে রাখা হবে না।
সূত্র মতে, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মধ্যদিয়ে টানা তৃতীয় মেয়েদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সরকার। ক্ষমতার এই দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের জন্য আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করেছে জামায়াত-বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা। যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, কৃষকলীগ ও শ্রমিকলীগসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনে বেশি অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অনুপ্রবেশকারীরা একশ্রেণির নেতার হাত ধরে বাগিয়ে নেন দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি। বিশেষ করে রাজধানীতে চারটি সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও দুই মহানগর নেতার ছড়াছড়ি। কোনো ধরনের অতীত যাচাই-বাছাই না করেই অর্থের বিনিময়ে ভিন্ন দলের অন্তত ১০ হাজার নেতা এখন এ চার সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতা। ফুটপাতের হকার থেকে শুরু করে ছিনতাইকারীদের পদে আনা হয়েছে।
যুবলীগের বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক পদে মো. হারুনুর রশিদ দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১২ সালের ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে তাদের দায়িত্ব দেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিয়ম অনুযায়ী তিন বছর পরপর কাউন্সিলের কথা থাকলেও বর্তমান মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তারা। ২০০৩ সালে যুবলীগের সভাপতিম-লীর সদস্য হন মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী। ২০০৯ সালে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আর ২০১২ সালে হন চেয়ারম্যান। যুবলীগে নিয়ন্ত্রক তিনিই।
সূত্রে জানা যায়, যুবলীগের রাজনীতি মানেই ক্ষমতা আর অর্থ। তাই সংগঠনটির একশ্রেণির নেতার ছত্রচ্ছায়ায় অনুপ্রবেশকারীর তালিকার শীর্ষে রয়েছে সংগঠনটি। কেন্দ্রীয় কমিটিসহ ঢাকার দুই মহানগর কমিটিতে হাইব্রিড খ্যাত নেতাদের ছড়াছড়ি। কেন্দ্রীয় মূল কমিটি ছাড়াও সহ-সম্পাদক পদের তালিকা কত হবে তা নিশ্চিত করতে পারেনি কেউ।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসার দুই বছরের মধ্যেই রাজধানীতে একক আধিপত্য বিস্তার করে যুবলীগ। বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ে যুবদলের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো প্রথমেই আয়ত্তে নেয় যুবলীগ। এরপর সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে যুবলীগের আয়ত্ত। বিশেষ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় যুবলীগের রাজনীতি মানে রাতারাতি বিত্তশালী বনে যাওয়া। গোটা এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ড নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন যুব সংগঠনটির নেতারা।
ফুটপাত থেকে শুরু অফিস, রেস্তোরাঁ, নতুন ভবন নির্মাণ, চাঁদাবাজি, জুয়া, ক্যাসিনো-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ করেন তারা। যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর আস্থাভাজন পরিচয়ে এসব নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। উত্তর-দক্ষিণ দুই মহানগরে তার সমান দাপট।
আর সম্রাটের হাত ধরেই দক্ষিণ মহানগর ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক পদে সবচে বেশি ভিন্নপন্থির অনুপ্রবেশ ঘটে। ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজিসহ নানা অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূইয়া, কেন্দ্রী নেতা দাবিকারী জিকে শামীম, সেলিম প্রধান, লোকমান হোসেন— এরা সকলেই অনুপ্রবেশকারী।
সম্রাট ছাড়া গ্রেপ্তার আতঙ্কে গাঢাকা দেওয়াদের মধ্যে কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান, যুবলীগ নেতা কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ, এনামুল হক আরমান, শফিকুল ইসলাম, সোহরাব হোসেন, গাজী সরোয়ার বাবু, মোরসালিন আহমেদ, মাকসুদুর রহমান, হাসান উদ্দিন জামাল, ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের নেতা আক্তার, মাসুদ— এরা সকলেই অনুপ্রবেশকারী। গত ৫ বছরের আগে এদের রাজধানীতে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না।
আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের আগে যুবলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে অভিযুক্ত অনেক নেতার কপাল পুড়তে পারে। যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হারুনুর রশিদ বলেন, যুবলীগের কাউন্সিলের জন্য ইতোমধ্যে আমরা নেত্রীর নির্দেশনা পেয়েছি। কাউন্সিলের জন্য আমরা প্রস্তুত আছি। তিনি বলেন, কাউন্সিলের জন্য এখনো কোনো দিনক্ষণ ঠিক করা হয়নি। নেত্রীর সাথে কথা বলে তারিখ ঠিক হলেই আমরা পুরোদমে কাজ শুরু করবো।
শ্রমিকলীগের বর্তমান কমিটির সভাপতি শুক্কুর মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম। তারা দুজনই সংগঠনের দায়িত্ব পেয়েছিলেন ২০১২ সালের জুলাই মাসে। এরপর ওই নেতৃত্বের হাত ধরেই শ্রমিকলীগের রাজনীতি চলছে। নেতৃত্বের দীর্ঘ এই সময়ে সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কয়েক নেতার ছত্রচ্ছাত্রায় সদরঘাট, গাবতলী, মতিঝিল, গুলিস্তানসহ একাধিক এলাকায় ফুটপাত দখলসহ চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১২ সালের ১১ জুলাই। সেই সম্মেলনে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতির দায়িত্বপান অ্যাডভোকেট মোল্লা আবু কাওছার ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান পঙ্কজ দেবনাথ এমপি। কাওছার ও পঙ্কজের নেতৃত্বে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে।
তবে তারা দুইজনে দীর্ঘ এই সময়ে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের নতুন কমিটি করতে পারেননি। সম্প্রতি অভিযানে মতিঝিলের আরামবাগে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে প্রচুর মাদকদ্রব্য ও ক্যাসিনোর সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। ক্লাবটির মালিকানার পাশাপাশি সভাপতি মোল্লা আবু কাওছারের ক্যাসিনো ব্যবসার সাথে জড়িত থাকা নিয়ে সমালোচনা ওঠে। যদিও তিনি বিষয়টি জানতেন না বলে সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *