বিশেষ প্রতিবেদক : কোনো কারণ ছাড়াই সারা বছর ধরে বাড়ে ওষুধের দাম। ওষুধ কোম্পানিগুলো মনমতো উৎপাদন ব্যয়ভারের নানা খোঁড়া অজুহাত দিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম বাড়িয়েই চলেছে। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরাও ওষুধের খুচরা ব্যবসায়ীদের উচ্চমূল্যে ওষুধ বিক্রির কায়দা-কানুনও বাতলে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।জানা যায়, প্রায় ২৪ বছর আগের একটি নির্দেশনার বলে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছেমতো বাড়াচ্ছে ওষুধের দাম। বিধি অনুযায়ী দাম বাড়ানোর বিষয়টি ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে জানানোর কথা। কিন্তু কোনো ওষুধের দাম বেড়েছে কিনা এমন তথ্য নেই প্রশাসনের কাছে। এমনকি প্রশাসনের ওয়েবসাইটে যে টেবিলে ওষুধের মূল্য সম্পর্কিত তথ্য থাকার কথা সেখানে নেই এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য। এভাবে কারণ ছাড়া ওষুধের দাম বাড়ায় ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ রোগীরা। চিকিৎসায় ব্যয় বাড়ে।
২৬৯টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ উৎপাদনকারী বেসরকারি কোম্পানি প্রায় ২৫ হাজার আইটেমের ওষুধ উৎপাদন করে থাকে। সরকারিভাবে উৎপাদিত ১১৭ ধরনের ওষুধ রয়েছে, যার দাম নির্ধারণ করে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। অধিদফতরের কাছে কোম্পানিগুলো নিজেদের চাহিদামতো দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করে, যা পরে অধিদফতরের অনুমোদন সাপেক্ষে বাজারে ছাড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধিদফতর কোম্পানির প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক সৈকত কুমার কর বলেন, সম্প্রতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ওষুধের দাম বাড়ানো হয়নি। বিভিন্ন কোম্পানির দাম বৃদ্ধির কিছু আবেদন থাকলেও সেগুলোর অনুমোদন দেয়া হয়নি। দোকানিরা দাম বাড়িয়ে থাকলে বিষয়টি প্রশাসনের জানা নেই। এমনকী তাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। প্রশাসনের কাজ চালাতে প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকায় দেশের সব ওষুধের দোকানে নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হয় না।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা না থাকায়ই ওষুধের দাম বাড়ে। ১৯৯৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারিতে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনায় বলা হয়েছে- অত্যাবশ্যকীয় তালিকাবহির্ভূত ওষুধের দাম নিজ নিজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করবে। ২৪ বছর আগের সেই নির্দেশনা বলে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ায় কোম্পানিগুলো। অথচ ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশে যে কোনো ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের ছিল। ১১৭টি ওষুধ সরকারের কাছে রেখে বাকি ওষুধগুলোর মূল্য নির্ধারণ করবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো- এমন প্রজ্ঞাপনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই সোমবার হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে এ রিট আবেদন করা হয়। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। সেসময় তিনি বলেছিলেন, দ্য ড্রাগস (কন্ট্রোল) অর্ডিন্যান্স-১৯৮২ মতে, ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করবে সরকার। যেখানে মাত্র ১১৭টি ওষুধের মূল্য নির্ধারণ সরকারের কাছে রাখে। বাকি ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি। এটা আইনের ব্যত্যয়।
রাজধানীর কলেজ গেট, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর ও গুলশানের বিভিন্ন ফার্মেসি থেকে জানা গেছে, বেক্সিমকো, ইবনে সিনা, স্কয়ার, অপসোনিন, ইনসেপটা ও রেনেটাসহ বেশকিছু কোম্পানির প্রায় ২৫ ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে গত দুই মাসে। এসব হলো- গ্যাস্ট্রিক, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরলসহ বিভিন্ন রোগের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ। যেমন- বাইজোরান ৩/২০ ও ৩/৪০, এসিফিক্স ২০ এমজি, ফিনিক্স ২০ এমজি, ফ্লেক্সি, মোটিগার্ট, মোনাস, অমিডন, ডন, মুডঅন প্রভৃতি।
সম্প্রতি মোহাম্মপুর টাউন হল এলাকার একটি ফার্মেসিতে পেটের ব্যাথা উপশমের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ৫০ টাকা মূল্যের এলজিন ওষুধের দাম চাওয়া হলো ৮০ টাকা। কয়েকজন ওষুধ দোকানি জানালেন, তারা আগে এ ওষুধ ৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন। মাঝে দাম বেড়ে ৬০ টাকা হয়। সপ্তাহখানেক আগে কোম্পানির প্রতিনিধিরা ৮০ টাকার কমে বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন।
গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অপসোনিন কোম্পানির প্রতি পিস ফিনিক্স ট্যাবলেট ৫ টাকায় বিক্রি হতো। দুই সপ্তাহ আগে কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা জানান, এ ওষুধের দাম ৭ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসায় ব্যবহৃত বেক্সিমকোর তৈরি এক পাতায় ১০টি অ্যাসিফিক্স ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০ টাকা, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ প্রতি পিস ১০ টাকা মূল্যের বাইজোরান ৫/২০ ১২ টাকায় এবং বাইজোরান ৫/৪০ ১৫ টাকার পরিবর্তে ১৮ টাকা হয়েছে। একইভাবে ৫ টাকার রেডিপস্নাজল ২০ এমজি ৭ টাকা, একমি কোম্পানির ১৫০ টাকা মূল্যের এক পাতা মোনাস-১০ এমজি ১৬০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। প্রেসারের ওষুধ ক্যামলোসার্ট ৮০ টাকা থেকে ১২০ টাকা ও শিশুদের জ্বরের জন্য বেক্সিমকোর তৈরি ১৪ টাকার নাপা ড্রপ ২০ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে। দুশ্চিন্তা ও রক্তচাপের চিকিৎসার জন্য ইবনে সিনার তৈরি মুডঅন নামের ১০ টাকার ওষুধ ৬০ টাকা করে এক পাতা, এরিস্টোফার্মার নরজিন ট্যাবলেট ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০ টাকা ও ৫৫ টাকার টোফেন সিরাপ ১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৫ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, এমনিতেই কেউ অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিতে গেলে ব্যক্তির পকেটের ৬৭ শতাংশ ব্যয় করতে হচ্ছে। এর ওপর বাজেটে ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব ছাড়াই দাম বাড়ানোটা অযৌক্তিক। এতে দরিদ্র রোগীরা বিপাকে পড়বে। ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের নাগালে রাখতে সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে। এজন্য ওষুধ নীতিমালা বাস্তবায়ন ও দেশে ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে নজর দিতে হবে।
ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এসএম সফিউজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি তাকে।
সমিতির মধ্যম সারির একজন নেতার ভাষ্য- বিশ্ব বাজারে ওষুধের কাঁচামালের দাম বেড়ে ৩০ ডলার থেকে ৭০ ডলারের মতো হয়েছে। তাই কিছু ওষুধের দাম বেড়েছে।এ ব্যাপারে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক ও মুখপাত্র রুহুল আমিনের বক্তব্য জানার জন্য মোবাইল ফোনে কয়েকদফা চেষ্টা করা হয়। এরপর কয়েকদিন অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সহসভাপতি আবদুল হাই বলেন, সারা বছরই কিছু কিছু ওষুদের দাম বেড়েছে। তবে মে-জুন মাসের দিকে বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো সব ধরনের ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক, হার্টের ওষুধ, প্রেসারের ওষুধ, ভিটামিন কিছুই বাদ যায়নি। তিনি বলেন, একটি কোম্পানি কোনো ওষুধের দাম বাড়ালে সবাই লাগাতারভাবে বাড়াতে থাকে।