বিশেষ প্রতিবেদক : গুটি কয়েক বড় সড়ক ছাড়া রাজধানীসহ সারা দেশের আর সব সড়কে এখন রাজত্ব চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশার। তার কোনোটি সনাতন রিকশায় মোটর সংযোজন করা, কোনোটি স্টিল বড়ি রিকশা, আর অন্যটি অটোরিকশার আদলে ইজি বাইক। দিনে দিনে বেড়ে দেশের পথঘাট সয়লাব এসব অনুমোদনহীন রিকশায়। রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরে এসব রিকশা চলাচলে কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের ছত্রছায়ায় দেদার চলছে বিভিন্ন সড়কে। দ্রুতগতির এসব হালকা বাহনে ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। বিদ্যুৎ অপচয় তো আছেই।
রাজধানীর কেন্দ্রে দেখা না গেলেও আশপাশের অনেক মূল সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। পাড়া-মহল্লার ছোট-বড় সব গলিতে ছুটছে হরণ বাজাতে বাজাতে। অনেক জায়গায় অনুমোদিত পায়েচালিত রিকশা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে এসব অটোরিকশার দাপটে। রাজধানীতে এসব অটোরিকশার কোনো পরিসংখ্যান নেই।
তবে সিটি করপোরেশনের অনুমোদিত পায়েচালিত রিকশার পরিসংখ্যান আছে। তাতে দেখা যায়, রাজধানীতে পায়েচালিত বৈধ রিকশার চেয়ে অবৈধ রিকশার পরিমাণ প্রায় ১০ গুণ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, তাদের কাছে নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। আর দক্ষিণ সিটিতে সেই সংখ্যা প্রায় ৫২ হাজার। দুই সিটি মিলিয়ে বৈধ রিকশা ৭৯ হাজার ৫৪৭টি।
তবে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি গবেষণা বলছে, রাজধানীতে চলাচলকারী রিকশার সংখ্যা ১১ লাখের বেশি। প্রায় ১০ লাখ অবৈধ রিকশা চলছে রাজধানীতে।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা যেভাবে বেড়েছে তাতে ওই পরিসংখ্যান এখন আর হয়তো মিলবে না। কেননা অনেক এলাকাতে ব্যাটারি রিকশার দাপটে পায়েচালিত রিকশা কমে গেছে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন রিকশামালিক ও চালকরা। আবার ১০ লাখ অবৈধ রিকশা নিয়ন্ত্রণণ করছে যে সংগঠনগুলো, তাদের বাণিজ্যেও টান পড়েছে ব্যাটারি রিকশার কারণে। ফলে তারা ব্যাটারি রিকশার বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন।
রাজধানীতে অনুমোদিত কিন্তু লাইসেন্সবিহীন রিকশার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন নামের অন্তত অর্ধশতাধিক সংগঠন। তাদের মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিভাগ রিকশা ও ভ্যান মালিক সমিতি, বাংলাদেশ রিকশা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশন, মহানগর রিকশা মালিক লীগ, রিকশা ও ভ্যান মালিক শ্রমিক লীগ, মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ রিকশা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশন, জাতীয় রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগ ও বাংলাদেশ রিকশা মালিক লীগ, রিকশায় এবং শ্রমিক-মালিক লীগ, ঢাকা সিটি মুক্তিযোদ্ধা রিকশা-ভ্যান মালিক কল্যাণ সোসাইটি ইত্যাদি।
বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান চালক শ্রমিক ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আর এ জামান বলেন, পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় ব্যাটারিচালিত রিকশা রাজধানীতে দিনে দিনে বাড়ছেই। দ্রুতগতির কারণে মানুষও এসব বাহনে চড়ছে বেশি। আর তাতে ক্ষতির মুখে পড়েছে সাধারণ রিকশাচালক ও মালিকরা।
রাজধানীর শনিরআখড়া এলাকার এই রিকশামালিক জানান, তাদের এলাকায় ১০ হাজারের বেশি অটোরিকশা চলছে। পায়েচালিত রিকশার চেয়ে পাঁচ-ছয়গুণ বেশি অটোরিকশা। নেতা ও পুলিশ তাদের থেকে টাকা নেয়, তারাই অনুমতি দিয়া রাখছে।
গত জুলাইয়ে মূল সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধে তোড়জোড় শুরু করে সিটি করপোরেশন। কিন্তু রাজধানীতে এসব অটোরিকশা চলছেই। কীভাবে চলছে?
শনিরআখড়া এলাকায় অটোরিকশা চালাতে হলে নির্দিষ্ট স্থান থেকে একটি কার্ড নিতে হয়। এ জন্য গুনতে হয় ৬০০ থেকে ১ হাজার টাকা। এই কার্ডের মেয়াদ এক মাস। এরপর নতুন মাসের জন্য নতুন কার্ড। কার্ড ছাড়া রিকশা নিয়ে বের হলে তা আটকে দেন স্থানীয় লাইনম্যানরা (মূল চাঁদাবাজের স্থানীয় প্রতিনিধি)।
রাজধানীর অন্যান্য এলাকাতেও একই অবস্থা। উত্তরখান, দক্ষিণখান, খিলক্ষেত, কুড়িল, ভাটারা, জুরাইন, রামপুরা, বনশ্রী, মুগদা, বাসাবো, মিরপুর, গাবতলি, মোহাম্মদপুর এলাকায় রয়েছে অসংখ্য ব্যাটারিচালিত রিকশা। তবে এসব এলাকায় কত সংখ্যক রিকশা রয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই কারও কাছে।
দক্ষিণ খানে মাসিক ভিত্তিতে টাকা দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে টোকেনের মাধ্যমে চলাচল করে অটোরিকশা। এগুলো উত্তরার রেললাইন পর্যন্ত আসতে পারে। একই অবস্থা খিলক্ষেতে। ইছাপুরা-খিলেক্ষেত মূল সড়কে চলাচল করে হাজারখানেক অটোরিকশা। প্রতিটি থেকে দিনে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের লাইন চার্জ নেওয়া হয়। এই টাকার একটা অংশ যায় স্থানীয় নেতা ও থানায়।
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পায়েচালিত রিকশার গ্যারেজেই দেখা মিলেছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার। সাধারণ রিকশা মালিকরা বাড়তি আয়ের জন্য ঝুঁকছেন ব্যাটারিচালিত রিকশার প্রতি। সাধারণ রিকশায় এক দিনে রিকশামালিকের জমা ১০০ থেকে ১২০ টাকা। ব্যাটারিচালিত রিকশার ক্ষেত্রে এই আয় প্রায় তিন গুণ।
রিকশামালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি সাধারণ রিকশা তৈরিতে খরচ হয় ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এরপর লাইসেন্স নিতে খরচ হয় প্রায় একই রকম। কিন্তু ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে তৈরি করা যায় একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা। তাতে নেই লাইসেন্স নেয়ার ঝামেলা। সহজে চালানো যায়। তাই অনেক সাধারণ মানুষও এসব রিকশা কিনে কারও হাতে ধরিয়ে দিয়ে পথে নামাচ্ছেন।
এসব রিকশা সাধারণত ট্রাফিক পয়েন্টগুলো এড়িয়ে চলে। ট্রাফিক পুলিশের কাছে ধরা পড়লে এক থেকে দেড় হাজার টাকা খরচ হয় ছাড়িয়ে আনতে। অন্য এলাকার পুলিশ ধরলেও একই খরচ। তবে এলাকাভিত্তিক খরচের ভিন্নতা রয়েছে।
এসব অটোরিকশার সবচেয়ে ভীতিকর দিক হলো দ্রুত ছুটে চলা। শিশু-কিশোরদেরও দেখা যায় এসব রিকশা চালাতে। কোনো ধরনের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না বলে যে কেউ যখন-তখন নেমে পড়ে ব্যাটারি রিকশা নিয়ে। আর ‘মোটরগাড়ি’ পেয়ে অল্পবয়সী চালকরা বাউলি কেটে ছুটে চলে অটোরিকশা নিয়ে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে নিয়মিত।
গাবতলি এলাকার বাসিন্দা সজিব সরকার বলেন, আমি বেড়িবাঁধ দিয়ে বাইক নিয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে বাস-ট্রাক নিয়ে যতটা চিন্তায় থাকি, তার চাইতে বেশি চিন্তা হয় এই রিকশা নিয়ে। এরা খুব দ্রুত চলে। হুটহাট পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায় ঘেঁষে আসে।
কামরাঙ্গীরচর, গাবতলি, মোহাম্মদপুর এলাকায় অটোরিকশার দুর্ঘটনা এখন নিয়মিত। কামরাঙ্গীরচরের ভুক্তভোগী দেলোয়ার হোসেন বলেন, এলাকার সরু রাস্তার মধ্যে এরা যেভাবে চালায়, তা খুব ভয়ানক। মাস খানেক আগে আমি বাজার থেকে ফেরার পথে, হুট করে পেছন থেকে মেরে দেয় আমাকে।
পথচারীদের ওপর রিকশা তুলে দেয়ার পাশাপাশি অন্য গাড়ি ও রিকশার সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাও হামেশাই ঘটছে এই অটোরিকশার।