বিশেষ প্রতিবেদক : ভয়েস কল ও ইন্টারনেট সেবা নিয়ে মোবাইল-ফোনের অপারেটরগুলোর বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগের শেষ নেই। কল ড্রপ, নেটওয়ার্ক সমস্যা, ইন্টারনেটের গতি ঠিক মতো না পাওয়া, ডাটা দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা হরহামেশা ঘটলেও কোম্পানিগুলো বিভিন্ন সূচক ও আদর্শমানের কথা বলে পার পেয়ে যাচ্ছে। সেবা-দানে ফাঁকির বিষয়টি গ্রাহকরা বুঝতে পারলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের কিছু করার থাকে না, সূচক ও মান মাপার যন্ত্র তাদের হাতে না থাকায়। এবার এসব সমস্যা দূর করতে টেলিকম মনিটরিং সিস্টেম (টিএমএস) স্থাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি)।
বর্তমানে অপারেটরগুলোর প্রতিবেদন থেকেই বিটিআরসি জানতে পারছে টেলিকম সেবার চিত্র। টিএমএস চালু হলে বিটিআরসিকে আর অপারেটরগুলোর প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করতে হবে না। বিটিআরসি সার্বক্ষণিক টিএমএস’র সঙ্গে যুক্ত থেকে দেখতে পারবে— সেবার মান, নেটওয়ার্কের সার্বিক চিত্র, ভয়েস ও ইন্টারনেটে গ্রাহককে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে কিনা।
জানা গেছে, টিএমএস নামের প্রকল্পটি বিটিআরসি’র ২১২তম কমিশন সভায় নীতিগত অনুমোদন পায়। এজন্য প্রয়োজনীয় বাজেটও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই সিস্টেমটি দুই পর্যায়-বিশিষ্ট দরপত্রের মাধ্যমে কেনা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রথম পর্যায়ে শেষ হয়েছে। দরপত্রের প্রথম পর্যায়ে অংশ নেয় ১৭টি প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্য থেকে সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে কারিগরি, আর্থিকসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে চূড়ান্তভাবে একটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন করা হবে।
টিএমএস ব্যবস্থা চালু হলে প্রাথমিকভাবে মোবাইল অপারেটরদের সংযুক্ত করা হবে। পরে অন্যান্য অপারেটরগুলোকে (আইজিডাব্লিউ, আইআইজি, আইসিএক্স ইত্যাদি) যুক্ত করা হবে। এই ব্যবস্থার দুটি অংশ রয়েছে। একটি বিটিআরসিতে স্থাপিত মনিটরিং এবং তথ্য ব্যবস্থাপনা করবে। এতে অপারেটরদের নেটওয়ার্ক এবং ট্রাফিক সম্পর্কিত তথ্য পর্যবেক্ষণ করা যাবে এবং রাজস্ব ও বিভিন্ন নির্দেশক সম্পর্কিত তথ্য গ্রহণ ও প্রতিবেদন তৈরি হবে। আর অন্য অংশটি বসানো হবে অপারেটরগুলোর কার্যালয়ে। সেটি তাদের বিভিন্ন নেটওয়ার্ক পয়েন্টে যুক্ত থাকবে। এটা হবে একটি কমপ্লায়েন্স মনিটরিং সিস্টেম— যা প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে বিটিআরসিতে পাঠাবে। একইসঙ্গে রাজস্ব সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ করে বিটিআরসিতে প্রতিবেদন পাঠানো হবে।
জানা গেছে, এই মনিটরিং সিস্টেম বসালে মোবাইল অপারেটরদের নেটওয়ার্কের লাইভ মনিটরিং সম্ভব হবে। নেটওয়ার্কের সেবার মান আরও সুচারুভাবে যাচাই করা যাবে এবং গ্রাহক সেবার প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে। সরকারের রাজস্ব ভাগাভাগির শেয়ারিংয়ের পরিমাণ সম্পর্কে দৈনিক-ভিত্তিতে একটি স্বচ্ছ ধারণা লাভ করা যাবে। বিটিআরসি নিয়মিত এবং স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কারিগরি এবং সিস্টেম অডিট সম্পন্ন করতে পারবে। ফলে বর্তমানে অডিট প্রক্রিয়া নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে মুক্ত থাকা যাবে।
এছাড়া, এর ফলে অপারেটররা বাস্তবে যেসব ট্যারিফ (সেবা বা প্যাকেজের মূল্য) বাস্তবায়ন করছে এবং এসব ট্যারিফ প্যাকেজে বিটিআরসি’র অনুমোদন আছে কিনা— তাও যাচাই করা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে অভিযোগের নিষ্পত্তিও কার্যকরভাবে সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, টিএমএস স্থাপনের ফলে টেলিযোগাযোগ সম্পর্কিত সব সূচক ও প্রতিবেদন স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হবে। এতে করে সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে কার্যকরভাবে প্রতিবেদন পাঠানো এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ আরও দ্রুত হবে। নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা, অথবা কোনও এলাকায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে কিনা— যা তাৎক্ষণিকভাবে জেনে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, যতক্ষণ আমার হাতে কলম আছে, কাজ ম্যানুয়ালি হচ্ছে, ততক্ষণ কোনও ফাঁকি ধরা সম্ভব নয়। ডিজিটাল পদ্ধতিতে কোনও ফাঁকি দেওয়া যায় না। ফলে আমরা ডিজিটালাইজেশনের দিকে যাচ্ছি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এটির কাজ শুরু হয়েছে। যেগুলো বাকি আছে সেগুলোও পর্যায়ক্রমে ডিজিটাল করা হবে।
মন্ত্রী আরও বলেন, আমরা একটি অবস্থানে পৌঁছাতে চাই, যেখানে গেলে অপারেটরগুলোর ফাঁকি, সেবার মান, নেটওয়ার্কের অবস্থা যন্ত্রের মাধ্যমে জানা যাবে। এতে অপারটেরগুলোর কোনও সহযোগিতা লাগবে না। বিটিআরসি সরাসরিই এসব মনিটর করতে পারবে। মানে কোনও হেরফের হলে তাৎক্ষণিকভাবে ধরতে পারবে।