বিপ্লব নিয়োগী তন্ময় (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে মাত্র ১০ কোটি টাকায় ইজারা দেয়া বালুমহলের অতিরিক্ত ও নিয়মবহির্ভূত বালু উত্তোলনের কারনে ৭২ কোটি টাকার নদীতীর রক্ষাকারী বেড়িবাঁধ বিলীনের পথে।নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোও বিলীন হওয়ার আশংকায়!
নবীনগরে ১০ কোটি টাকার “বালু মহাল” নতুন করে ইজারা না দেয়ার দাবি এলাকাবাসির!
অনুসন্ধানে জানাযায়, নিয়ম বহির্ভূতভাবে নদী থেকে মাত্রাতিরিক্ত বালু উত্তোলনের কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলের ধরাভাঙ্গা ও বড়িকান্দি এলাকায় নদী তীরবর্তী গ্রামগুলো রক্ষায় ৭২ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত ২ হাজার ফিট দীর্ঘ একটি নদী রক্ষা বেরি বাঁধ এখন হুমকীর মুখে!
সরকারি নিয়ম নীতিকে উপেক্ষা করে বালু মহালের ইজারাদারের লোকজন অর্ধশতাধিক ড্রেজারের মাধ্যমে প্রতিদিন নদী থেকে বালু উত্তোলন অব্যাহত রাখায়, গতকাল শনিবার রাতে পাঁচ বছর আগে নির্মিত ওই বেরি বাঁধের একাংশ আকস্মিকভাবে ধ্বসে পড়ে। এ ঘটনার পর থেকে এলাকাবাসির মধ্যে চরম ভীতি, আতংক, ক্ষোভ বিরাজ করছে।
গত শনিবার রাত প্রায় সাড়ে আটটার দিকে হঠাৎ করে ওই বেরি বাঁধের ব্লক ধ্বসের খবর আশপাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ার পরপরই ভাঙন কবলিত অংশে আতঙ্কগ্রস্থ মানুষের ঢল নামে।
এলাকার লোকজন জানান, বড়িকান্দি ইউনিয়নের মেঘনা নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোকে নদী ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষা করতে বিগত ২০১৮ সালের আওয়ামীলীগ সরকার সোনা বালুয়া ঘাট থেকে এমপি টিলা পর্যন্ত দুই হাজার ফিট দীর্ঘ নদী তীরে ৭২ কোটি টাকা ব্যায়ে একটি বেরী বাঁধ নির্মাণ করে। গতকাল রাতে সেই বাঁধের এমপি টিলা এলাকায় ৫০ ফুটের মতো বাঁধের ব্লক ও মাটি আকস্মিকভাবে নদীগর্ভে পানির নিচে তলিয়ে যায়।
বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী জানান, ওই এলাকার জাফরাবাদ মৌজায় নতুন চর এলাকার মেঘনা নদীতে সর্বোচ্চ ৩২ একর দীর্ঘ একটি সুনির্দিষ্ট সীমানা থেকে বালু উত্তোলনের জন্য গত বছর জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে বার্ষিক নয় কোটি টাকার বিনিময়ে ওই বহুল আলোচিত ‘বালু মহাল’টি ইজারা পায় জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন শোভনের মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান মুন্সি এন্টারপ্রাইজ।
এলাকার লোকজনের অভিযোগ, ইজারার শর্ত অনুয়ায়ি সর্বোচ্চ ২০ টি ড্রেজারের মাধ্যমে সকাল সন্ধ্যা বালু উত্তোলনের কথা থাকলেও, ইজারাদারের লোকজন নদীতে প্রতিদিন ৫০/৬০ টি ড্রেজার লাগিয়ে সীমানা অতিক্রম করে গত ৪/৫ মাস ধরে দিনে রাতে নির্বিচারে নদী থেকে বালু উত্তোলন করছেন। ফলে নদীতে নির্ধারিত ৩২ একর জল সীমানার বাইরে গিয়েও অতিরিক্ত ড্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করায় বর্তমানে এলাকার নদী তীরবর্তী সোনাবালুয়া ঘাট, নৌকা ঘাট, এমপি টিলা ঘাট, নূরজাহানপুর গ্রাম ও ঈদগাহ এবং নদী তীররবর্তী কবরস্থানসহ নদী পাড়ের গ্রামগুলো নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
এ অবস্থায় এলাকাবাসির স্বার্থে আগামি মাসে (এপ্রিল) ইজারার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় নতুন করে কাউকে আর ইজারা না দেয়ার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসনসহ সরকারের সংষ্লিষ্ট বিভাগে এলাকাবাসি অনুরোধ জানিয়েছেন।
উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এলাকাবাসির অভিযোগের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে নবীনগরের ইউএনও তানভীর ফরহান শামীম সম্প্রতি ওই বালু মহালে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে নয়জন বালু শ্রমিককে বালু মহালের স্পট থেকে গ্রেফতার করে। পরে সেখানে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে ধৃতদেরকে কুড়ি দিন করে দন্ড প্রদান করা হয়।
এদিকে স্থানীয় বাসিন্দা, জেলা পরিষদের সাবেক সদস্যা ও নবীনগর উপজেলা মহিলা আওয়ামীলীগের আহবায়ক অধ্যাপক নুরুন্নাহার বেগম বলেন,’এই বালু মহালটি এখন এলাকাবাসির জন্য গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের নিয়ম নীতি ও শর্ত ভঙ্গ করে প্রতিদিন ৬০/৭০ টি ড্রেজার লাগিয়ে দিনে রাতে সমানে নদী থেকে বালু উত্তলোন করার কারণে গোটা এলাকার নদী তীরবর্তী গ্রামগুলো যেকোন সময় চরম ভাঙ্গনের কবলে পড়তে পারে! যার আলামত গতকাল শনিবার রাতে কিছুটা আমরা দেখলাম। তাই নতুন করে আর কাউকে বালু মহালটি যেন ইজারা দেয়া না হয়, সেজন্য জেলা প্রশাসনের কাছে আমরা জার দাবি জানাচ্ছি।’
তিনি আরও জানান,ইতিমধ্যে নতুন করে বালু মহালের ইজারা বন্ধের দাবি জানিয়ে এলাকায় একাধিকবার মানববন্ধনও করেছে এলাকাবাসি। কিন্তু আমরা এর কোন প্রতিকারই পাচ্ছিনা।’
এদিকে এলাকার একাধিক সূত্র জানায়, প্রতিদিন এই বিশাল বালু মহাল থেকে প্রায় কোটি টাকার বালু উত্তোলন করা হয়। আর সেই আয় থেকে নবীনগরের প্রভাবশালী বড় বড় রাঘব বোয়ালদেরকে প্রতি মাসে ইজারাদারদেরকে মাসিক ‘বখরা’ দিতে হয়। ফলে নির্বিঘ্নে ওই বালু মহালে ২০টির বদলে ৬০/৭০টি ড্রেজার প্রতিদিন চালালেও কেউ বাঁধা দেয় না।’
এ বিষয়ে বালু মহালের ইজারাদার মুন্সি এন্টারপ্রাইজের মালিক জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন শোভন আজ রবিবার বিকেলে জানান, ‘বালু মহালটি ইজারা পাওয়ার পর থেকে আমার জানামতে, বালু উত্তোলনের সময় সরকারের নিয়ম নীতি ও শর্তের সামান্যতমও লংঘন করা হচ্ছে না। প্রায় সাড়ে নয় কোটি টাকার বিনিময়ে পাওয়া এই বালু মহাল থেকে যেসব শর্তে আমাদেরকে সরকার বালু তুলতে নির্দেশনা দিয়েছেন, আমরা সেই শর্ত মোতাবেকই বালু তুলছি। বালু তোলার সময় আমরা ৩২ একরের বাইরে এক চুল পরিমানও অন্যত্র যাচ্ছিনা।’
তবে ছাত্রলীগ নেতা কিছুটা স্বীকার করে বলেন,’আমার সাথে এই বালু ব্যবসায় শতাধিক পার্টনার থাকায়, সরকারের বেঁধে দেয়া নদীতে ড্রেজার ব্যবহারের সর্বোচ্চ ২০টি সংখ্যা হয়তো আমরা সবসময় মেনটেইন করতে পারছিনা।’
ছাত্রলীগের এই নেতা আরও জানান, আগামি ১৪ এপ্রিল বালু মহালের মেয়াদ শেষ হবে। আর আগামি ২ এপ্রিল আবার ইজারার জন্য ইতিমধ্যে নতুন দরপত্র আহবান করেছে জেলা প্রশাসন। ইনশাল্লাহ এবারও বালু মহাল’টির ইজারা পেলে, সরকারের সকল শর্ত শতভাগ মেনেই বালু উত্তোলন করবো।”
তবে এক প্রশ্নের জবাবে জেলার তুমুল জনপ্রিয় এই ছাত্রলীগ নেতা শাহাদৎ হোসেন শোভন বলেন,’এই বালু ব্যবসা করতে গিয়ে হাতে গুণা কয়েকজন ছাড়া এলাকার বাঘা বাঘা প্রায় অনেককেই আমাকে নানা ‘সুযোগ সুবিধা’ দিতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে যাদেরকে চাহিদার তুলনায় সুযোগ সুবিধা ও চাহিদা মোতাবেক মোটা অংক দিতে পারি নাই, তারাই মূলত আমাদের বিরুদ্ধে সাজানো মানববন্ধনসহ নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে।”
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন’গতকাল রাতে কেন বালু মহাল এলাকায় হঠাৎ ধ্বস নামলো, সেটি তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে ইতিমধ্যে নবীনগরের ইউএনওকে নির্দেশ দিয়েছি। আর বালু মহাল ইজারা বন্ধ করার এখন আর তেমন কোন সুযোগ নেই। কারণ ইতিমধ্যে আগামি ২ এপ্রিল বালু মহালটি ইজারার দরপত্র ডাকা হয়ে গেছে।’ ,
এ বিষয়ে নবীনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর ফরহাদ শামীম বলেন,’বালু মহালের কাছে গতকালের আকস্মিক ধ্বস, মূলত বালু উত্তোলনের কারণে ঘটেনি। এটি মূলত ওই ঘাট এলাকায় অন্য একটি কারণে ঘটেছে। সেটি ইতিমধ্যেই বন্ধ করা হয়েছে।’
আর বালু মহাল এলাকায় নদীতে শর্তের বাইরে অতিরিক্তি ড্রেজার মেশিন পাওয়া যাওয়ায়, সম্প্রতি ইতিমধ্যে ইজারাদারের নয় জন লোককে গ্রেপ্তার করে জেল জরিমানাও করেছি”।
এরপরও সরকারের কাছে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর দুটি প্রশ্ন-এক. সরকারের কাছে নয় কোটি টাকার রাজস্ব আদায়-ই বড়? দুই. নাকি এমপি টিলাসহ নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোকে এখন রক্ষা করাটা-ই হবে সরকারে জনস্বার্থে কর্তব্য!! সুতরাং এলাকাবাসির এই দুটি প্রশ্নের কোনটিকে এখন বেছে নেবে জেলা প্রশাসন, সেটি জানতে হলে আমাদেরকে আগামি ২ এপ্রিল ২০২৪ এই বালু মহালের দরপত্র ইজারার দিন পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করতেই হবে!