বিশেষ প্রতিনিধি : সিলেটের সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রে সপরিবারে গত শনিবার ঘুরতে গিয়েছিলেন ঢাকার বাসিন্দা সোহেল রানা। কিন্তু সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের মূল স্পটে গিয়ে তিনি হতাশ। সোহেল রানা বলেন, আট মাস আগেও সাদা পাথরে এসেছিলাম। তখন যে পরিমাণ পাথর দেখে গিয়েছিলাম তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ পাথরও এখন এখানে নেই। নৌকা থেকে নেমে প্রায় ২০০ মিটার জায়গা জুড়ে থাকা পাথরের স্তূপের ওপর হেঁটে মূল স্পটে গিয়েছিলাম তখন। আর এবার নৌকা থেকে নেমে কোনো পাথর পাইনি। প্রায় ৫০০ মিটার বালুপথ হেঁটে গিয়ে মূল স্পটে দেখি সামান্য কিছু পাথর। যে পাথরের জন্য এই জায়গা বিখ্যাত, সেই পাথরই যদি না থাকে তা হলে তো লুটের আঁচড় ছাড়া কিছুই দেখা যাবে না।
পাহাড়, পাথর, পানি ও মেঘের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সারা বছরই পর্যটকে মুখর থাকে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্টের সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ধলাই নদের উৎসমুখে ২০১৭ সালে পাথর জমা হয়। সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল লুংলংপুঞ্জি ও শিলংয়ের চেরাপুঞ্জি থেকে ধলাই নদে সারা বছর পানি প্রবাহমান থাকে। বৃষ্টিবহুল চেরাপুঞ্জির পাদদেশ থেকে বর্ষায় ঢলের পানির সঙ্গে পাহাড় থেকে পাথরখণ্ড এপারে নেমে আসে। ভেসে আসা এসব পাথর উত্তোলিত পাথরের চেয়ে দামি। এটির কদরও বেশি। ব্যবহৃত হয় স্থাপত্যকাজে। দেখতে ধূসর ও সাদা হওয়ায় স্থানটির নাম হয় ‘সাদা পাথর’।
যাতায়াতের সুব্যবস্থায় খুব তাড়াতাড়ি দেশে ও বিদেশে জনপ্রিয় হয়ে যায় সিলেটের এই প্রাকৃতিক পর্যটন কেন্দ্রটি। প্রধান আকর্ষণ পাথর। কিন্তু গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর গণ-অভ্যুত্থানের দিন থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী না থাকার সুযোগে পর্যটন কেন্দ্র থেকে লুট হয়েছে অসংখ্য পাথর। সরকারি হিসাবে অন্তত ২০ কোটি টাকার পাথর লুট নিরূপণ করা হলেও বাস্তবে শত গুণ বেশি পাথর লুট হয়েছে বলে একাধিকবার সেখানে যাওয়া পর্যটকরা বলছেন। লুটপাটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পর্যটন কেন্দ্রটি সহসাই আকর্ষণ হারা হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাথর লুটপাট সম্পর্কে স্থানীয় লোকজন সবিস্তারে কথা বলতে খুব একটা আগ্রহী নন। একাধিকবার চেষ্টার পর কয়েকজন কথা বলেন। তাদের ভাষ্য, ৫ আগস্ট থেকে টানা সাদা পাথরে স্তূপীকৃত পাথর লুট করছে পাথরখেকো ও দুর্বৃত্তরা। ওই দিন বিকেল থেকে শত শত বারকি ও স্টিলবডি নৌকা দিয়ে পাথর লুট শুরু হয়। রাতে কয়েক হাজার নৌকা নিয়ে চলে লুটপাট। এক পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা ও সেনাবাহিনী এসে লুটকারীদের তাড়িয়ে দিলেও তারা চলে যাওয়ার পর ফের শুরু হয় পাথর লুটের মহোৎসব। লুটকৃত এসব পাথর সেখানকার বিভিন্ন ক্রাশার মিলে সঙ্গে সঙ্গে ভাঙা হয়। বেশির ভাগ পাথর নদীপথে সুনামগঞ্জের ছাতক ও সড়কপথে বিমানবন্দরের পাশের ধোপাগুল এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ৫ আগস্ট থেকে সাদা পাথর ও আশপাশের এলাকা থেকে পাথর লুটের ঘটনায় মামলা হয়েছে। পাশাপাশি লুটের ঘটনার একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন পরবর্তী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় বর্তমানে পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে, লিজ বহির্ভূত জায়গা থেকে বালু উত্তোলন বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত আছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবিদা সুলতানার নেতৃত্বে গত ১১ ও ২৩ সেপ্টেম্বর, ১, ৩ ও ৭ অক্টোবর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। এসব অভিযানে লক্ষাধিক টাকা অর্থদণ্ড, মেশিন ও বাহন জব্দ করে বিনষ্ট করা হয়েছে।
সম্প্রতি সাদা পাথর এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেট অঞ্চলের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে পাথরখেকো চক্র আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এখন পাথরের সঙ্গে দিনরাত সমান তালে চলছে বালু উত্তোলন। লিজ বহির্ভূত জায়গা থেকেও প্রতিনিয়ত বালু উত্তোলন চলছে। এসব বন্ধ করতে প্রশাসনের ভূমিকা নেই বললেই চলে। এসব দুর্বৃত্তায়ন দ্রুত বন্ধ না করলে সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্র ধ্বংসের পাশাপাশি এই এলাকার পরিবেশও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
৫ আগস্ট থেকে সাদা পাথর ও আশপাশের এলাকা থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকার পাথর লুটের বিষয়টি সরকারি হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আবিদা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘আমাদের নৌকা ঘাট, স্থলবন্দর এলাকা, উপজেলা অফিসসহ বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। এসব বিস্তারিত তথ্য আমরা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। মামলাও হয়েছে। বর্তমানে পাথর ও বালু উত্তোলন বন্ধে আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি।