নিজস্ব প্রতিবেদক : স্বৈরাচার ফ্যাসিবাদী আওয়ামী শাসনের দীর্ঘ ছায়ায় দুর্নীতির আরেক কুশীলব হিসেবে উঠে এসেছে ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ ফখরুল ইসলামের নাম। সাবেক বিতর্কিত এমডি তাকসিম এ. খানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এই প্রকৌশলী এখন “টক অব দ্যা ঢাকা ওয়াসা”— অনিয়ম, টেন্ডার বাণিজ্য ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মধ্য দিয়ে গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদের সাম্রাজ্য।

তাকসিমের ছায়াতলে ফখরুল : তাকসিম এ. খানের সময় থেকেই ফখরুল ছিলেন সুবিধাভোগীদের প্রথম সারিতে। সরকারের পরিবর্তন হলেও অদৃশ্য শক্তির জোরে আজও তিনি বহাল তবিয়তে দাপটের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।
বর্তমানে ফখরুল ইসলাম একাই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের পরিচালক—পূর্বাচলে পানির লাইন স্থাপন প্রকল্প ওয়ার্ল্ড ব্যাংক অর্থায়িত ক্লাইমেট রেজিলেন্ট প্রকল্পের ফোকাল পার্সন। গ্রাউন্ড ওয়াটার একুফায়ার রিচার্জ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক।

ওয়াসার অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা যেখানে কাজের অভাবে অলস, সেখানে ফখরুলের হাতে একাই তিন প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ— যা শুধু প্রশ্নই তোলে না, বরং গভীর সংশয়ও তৈরি করে।

এর আগে তিনি ছিলেন NIP প্রকল্পের উপ-পরিচালক ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পানি সরবরাহ প্রকল্পের পরিচালক— যেখানে অনিয়মের অভিযোগও কম শোনা যায়নি।
কোটি টাকার রাজ্যের মালিক : ওয়াসার এই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বর্তমানে রাজধানীতে তিনটি ১০ তলা ভবনের মালিক। মোহাম্মদপুর নবীনগর হাউজিংয়ের ৫ নম্বর সড়কে ৬ কাঠার ওপর ১০ তলা ভবন। ঢাকা উদ্যানের ২ নম্বর সড়কে ৬ কাঠার ওপর নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবন, একই প্রকল্পের ৩ নম্বর সড়কে ৪ কাঠার ওপর আরেকটি অত্যাধুনিক ১০ তলা ভবন, লালমাটিয়ার ‘সি’ ব্লকের ২/৮ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৫ তলায় রয়েছে তার স্ত্রী নাদিরা ইয়াসমিন মুক্তা’র নামে একটি দোতলা সমমানের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। নবীনগর হাউজিংয়ের ১ নম্বর রোডে আরও একটি ৪ কাঠা প্লটও কেনা হয়েছে তার স্ত্রীর নামে— যেখানে টিনশেড ঘর ভাড়া দিয়ে আয় চলছে নিয়মিত।
এছাড়াও তিনি ‘অনিতা ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামের রিয়েল এস্টেট কোম্পানির পরোক্ষ মালিক, যার মাধ্যমে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় জমি ও ফ্ল্যাট কেনাবেচার ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বিদেশে অর্থ পাচার ও পারিবারিক সম্পৃক্ততা : বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ফখরুল তার ছোট ভাইয়ের নামে কম্বোডিয়ায় কৃষি খামারের ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। ২০২৩ সালের জুনে বড় ছেলে অরিত্র ইসলামকে অস্ট্রেলিয়ার UTS ইউনিভার্সিটিতে পাঠানো হয়েছে উচ্চশিক্ষার নামে— খরচের উৎস অজানা। অথচ ফখরুল ইসলামের সরকারি বেতন সর্বোচ্চ ৯০ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
তার নামে, স্ত্রীর নামে, ভায়রা-ভাই এমনকি শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের নামেও সম্পদ ক্রয়ের প্রমাণ মিলেছে। ব্যাংক একাউন্টে কোটি টাকার এফডিআর, দামি ব্যক্তিগত গাড়ি, আর সরকারি গাড়ি ব্যক্তিগত ব্যবহারের অভিযোগ তো আছেই।
অজানা আশ্রয়দাতা ও দুদকের নীরবতা : দুর্নীতিবিরোধী কমিশনের (দুদক) নিকট ওয়াসার এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ জমা পড়লেও কার্যত কোনো তদন্ত হয়নি। insiders সূত্রে জানা গেছে, ফখরুল ইসলাম এখনো প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়ায় নিরাপদে রয়েছেন।
দুদকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “তাকসিম খানের আমলে ওয়াসার কিছু কর্মকর্তা এমন এক দুর্নীতির চক্র তৈরি করেছিলেন, যাদের ক্ষমতার পরিধি ছিল মন্ত্রণালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। ফখরুল ইসলাম সেই চক্রের অন্যতম মুখ।”
সরকারের পরিবর্তনের পরও অজানা ছায়া : নতুন সরকারের আগমনে ওয়াসায় অনেক রদবদল হলেও ফখরুল ইসলামের অবস্থান অটুট। insiders বলছেন, তার পেছনে “একজন প্রভাবশালী সাবেক আমলা ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক” রয়েছেন, যার কারণে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না।
প্রশ্ন একটাই — দুদক কি জেগে উঠবে? ওয়াসার প্রকৌশলী ফখরুল ইসলামের অঢেল সম্পদের গল্প এখন অফিস থেকে ক্যাফে— সর্বত্রই আলোচিত। সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করছে—“৯০ হাজার টাকার বেতনে কোটি টাকার সম্পদ কোথা থেকে আসে?”
দুর্নীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে গাঁথা ওয়াসা যদি সত্যিকার অর্থে সংস্কার চায়, তবে এমন প্রকৌশলীদের জবাবদিহির আওতায় আনা ছাড়া বিকল্প নেই।
শেষ কথা : ঢাকা ওয়াসার এই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর সম্পদের পাহাড় শুধু এক ব্যক্তির নয়, এটি একটি ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি— যেখানে ক্ষমতার ছায়াতলে দুর্নীতি হয়েছে নিয়মে পরিণত। এখন দেখার বিষয়, দুদক ও প্রশাসন এই প্রেতাত্মার কবল থেকে কতটা মুক্তি দিতে পারে জনগণের প্রতিষ্ঠান ওয়াসাকে।