নিজস্ব প্রতিবেদক : নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির বিরুদ্ধে গত বছর ভ্রাম্যমাণ আদালত ২ হাজার ১৪৫টি মামলা দায়ের করেন। এ সময় ১২ কোটি ৪১ লাখ ৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয় ৩৯ জনকে। সিলগালা করা হয় ৪৪টি প্রতিষ্ঠান। জব্দ করা হয় প্রায় ৩২ কোটি টাকা মূল্যের নকল ওষুধ। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রায় ৪৭ কোটি টাকা মূল্যের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংস করা হয়। এটি গত বছরের নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে নেওয়া সরকারি কার্যক্রমের চিত্র। এসব পদক্ষেপের মধ্যেও থেমে নেই এ অপরাধ।
নতুন কৌশল অবলম্বন করে নকল ওষুধ বাজারে ছাড়ছে অপরাধীরা। তাদেরই একজন কেরানীগঞ্জের রাসেল। সে নিজেই কেমিস্ট, নিজেই ফার্মাসিস্ট, আবার ওষুধ কোম্পানির মালিকও। স্কয়ার, বেক্সিমকো, অপসোনিন এবং ইনসেপটার মতো নামিদামি কোম্পানির মোড়ক, বোতল হুবহু নকল করে বছরের পর বছর ধরে অনৈতিক বাণিজ্যে জড়িত রাসেল। রাসেলের মতো ঢাকার মুগদার বাদশা, মিরপুরের সালাউদ্দিন বাবু, পান্থপথের মোহাম্মদ আলী খান, পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর এমএ বারেক নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এই অপরাধে তাদের একাধিকবার জেলেও যেতে হয়েছে। জেল থেকে বেরিয়ে আবার ফিরে গেছে পুরোনো ব্যবসায়।
ছোটখাটো কয়েকটি বৈধ কোম্পানিও নকল ওষুধ উৎপাদনে জড়িত। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অবৈধ কারখানায় নকল ওষুধ তৈরি করে তা পাইকারি দোকানে বিক্রি করছে তারা। এসব দোকানের মাধ্যমেই সারাদেশে নকল ওষুধ ছড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মিটফোর্ডের ওষুধ ব্যবসায়ী, বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরির এমন ভয়ঙ্কর তথ্য পাওয়া গেছে।
মিটফোর্ডে ওষুধের দোকান আছে এমন অন্তত ১০ জন ব্যবসায়ী জানান, প্রথমে তারা মনে করতেন, বড় কোম্পানির এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা বা কর্মচারী লট চুরি করে বাজারে বিক্রি করছে। এ কারণে কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে এক ওষুধ ব্যবসায়ী জানান, স্কয়ার ফার্মার সিপ্রোসিন নামে এন্টিবায়োটিকের প্রতি পিসের পাইকারি মূল্য সাড়ে ১৩ থেকে ১৪ টাকা পড়ে, সেখানে তিনি চার থেকে পাঁচ টাকায় তিনি কেনেন। কিছুদিন পর তার ভুল ভেঙে যায়। জানতে পারেন, একটি চক্র নামিদামি কোম্পানির নকল ওষুধ উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। এরপর থেকে তিনি কোম্পানি কর্মী ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে ওষুধ কেনেন না।
অভিযোগ রয়েছে, ওষুধ ব্যবসায়ী সমিতির কয়েক নেতা এবং ঔষধ প্রশাসনের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে এসব অপকর্ম করে পার পেয়ে যাচ্ছে ভেজাল ও নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িতরা। পাইকারি মার্কেট ও ছোটখাটো ওষুধ কারখানায় ড্রাগ সুপার বা ঔষধ প্রশাসনের কর্তাদের মাঠ পর্যায়ে ড্রাগ সুপারদের অসাধুতার জন্যই ভেজাল সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা করেও আপোস করতে হচ্ছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে।
মিটফোর্ডের পাইকারি কয়েকটি মার্কেটে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, সুপরিচিত কোম্পানির নকল ওষুধ এবং অখ্যাত কোম্পানির ওষুধে সয়লাব বাজার। মোড়ক দেখে যা চেনার উপায় নেই। বিশেষ করে জরুরি প্রয়োজনের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ নকল হচ্ছে বেশি। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বড় কোম্পানির ওমিপ্রাজল গ্রুপের এক বাক্স ক্যাপসুলের দাম ৪০০ টাকা। অথচ নকল করে ওই ওষুধ পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হয় মাত্র ৭২ টাকায়। তবে খুচরা পর্যায়ে ৪শ’ টাকাতেই বিক্রি হয় এসব ওষুধ। জীবন রক্ষাকারী প্রাথমিক স্তরের প্যারসিটামল, ব্যথানাশক ডাইক্লোফেনাক, অ্যান্টিবায়োটিক এজিথ্রেমাইসিন, ফ্লুক্লোসাসিনসহ সব গ্রুপের ওষুধই নকল ও ভেজাল হচ্ছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসব ওষুধ কম দামে পেলেও সাধারণ ক্রেতারা তা প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির ওষুধের সমান দামে কিনছেন। পাইকারি দাম কম হওয়ায় অসাধু ফার্মেসি মালিক বা খুচরা বিক্রেতারা এসব নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি করতে বেশি আগ্রহী। নকল কোম্পানি তাদের ওষুধ সারাদেশে ছোট ছোট ফার্মেসিতে ছড়িয়ে দিতে না পারায় রাজধানীর মিটফোর্ড, মিরপুর, নারায়ণগঞ্জ, খুলনার হেরাজ মার্কেট, চট্টগ্রামের হাজারী লেন, কুমিল্লার শাসনগাছা, রাজশাহীর সাহেববাজারের মতো ওষুধের বড় বড় পাইকারি মার্কেটের মাধ্যমে তা সারাদেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, নকল-ভেজাল ও মানহীন ওষুধ উৎপাদনের মূলে রয়েছে মিটফোর্ডে খোলাবাজারে বিক্রি হওয়া কাঁচামাল। ঔষধ প্রশাসনের অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিই কেবল বিদেশ থেকে ওষুধ তৈরির কাঁচামাল আমদানি করতে পারে। ওই কাঁচামাল খোলা বাজারে বিক্রির সুযোগ নেই। কিন্তু অনেক ওষুধ কোম্পানি চাহিদার তুলনায় অধিক পরিমাণে কাঁচামাল আমদানি করে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করে থাকে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও নকল ওষুধ বিক্রির সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেট খোলাবাজার থেকে ওই কাঁচামাল কিনে নকল ওষুধ উৎপাদন করে। রাজধানীর মিটফোর্ডে সহস্রাধিক দোকানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কাঁচামাল বিক্রি করা হয়। কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউম মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন নামে তাদের একটি সংগঠনও রয়েছে। এই সংগঠনের নেতা হাজী বেলায়েত হোসেন সমকালকে বলেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই তারা ব্যবসা করছেন। তবে কে এই যথাযথ কর্তৃপক্ষ সে বিষয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি তিনি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ দল ৭৩টি ওষুধ কোম্পানি সরেজমিন পরিদর্শন করে ২০১৪ সালের অক্টোবরে একটি প্রতিবেদন দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুকের নেতৃত্বে কমিটির প্রতিবেদনে ২৯টি কোম্পানির ওষুধের কার্যকারিতা ও উপযুক্ত মান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে এসব কোম্পানির ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ও দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ২৯ কোম্পানির ওষুধ উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দেয়। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের রয়েল ফার্মাসিউটিক্যালস, ফার্মিক ল্যাবরেটরিজ ও স্ট্যান্ডার্ড ল্যাবরেটরিজ, চুয়াডাঙ্গার এজটেক ফার্মাসিউটিক্যালস, দিনাজপুরের বেঙ্গল টেকনো ফার্মা, গাজীপুর কোনাবাড়ীর ব্রিস্টল ফার্মা, বরিশালের ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস, রাজধানীর মিরপুরের ইনোভা ফার্মাসিউটিক্যালস, এবলেশন ল্যাবরেটরিজ, বিকল্প ফার্মাসিউটিক্যালস, যাত্রাবাড়ীর ডলফিন ফার্মাসিউটিক্যালস, পোস্তগোলার মিল্লাত ফার্মাসিউটিক্যালস, শ্যামলীর ট্রপিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল ও তেজগাঁওয়ের রেমো কেমিক্যালস, নারায়ণগঞ্জের ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিজ, সাভারের সুনিপুণ ফার্মাসিউটিক্যালস ও এভার্ট ফার্মা, কেরানীগঞ্জের ইউনিক ফার্মাসিউটিক্যালস, সিরাজগঞ্জের ওয়েসিস ল্যাবরেটরিজ ও রাসা ফার্মাসিউটিক্যালস, পাবনার ইউনিভার্সাল ফার্মাসিউটিক্যালস, সিলেটের জালফা ল্যাবরেটরিজ, নওগাঁর নর্থ বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যালস, বরিশালের প্যারাডাইস ফার্মা, কুষ্টিয়ার কোয়ালিটি ফার্মাসিউটিক্যালস, ফরিদপুরের বেলসেন ফার্মাসিউটিক্যালস, ময়মনসিংহের স্পার্ক ফার্মাসিউটিক্যালস ও সেভ ফার্মাসিউটিক্যালসের বিরুদ্ধে নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরির অভিযোগ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সনদ বাতিলের পরও তারা উচ্চ আদালতে রিট করে ওষুধ উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) রুহুল আমিন বলেন, ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে অভিযান আরও জোরালো করা হয়েছে। নকল-ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারী কোনো কারখানা বা দোকানের সন্ধান পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে অভিযান চালানো হবে।