কাজলার নব্যমাদক ব্যবসায়ী
নাজমুল ধরা ছোয়ার বাহিরে
নিজস্ব প্রতিবেদক : সম্প্রতি ৪৪ জন কোটিপতি মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে দু’জন ইতিমধ্যেই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। বাকি ৪২ জনকে ধরতে শিগগিরই সমন্বিত অভিযান চালাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা তালিকাটি তৈরি করে। এরপর সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তা যাচাই করা হয়। পরে তালিকায় থাকা মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে নির্দেশ দেয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ সংক্রান্ত গোয়েন্দা প্রতিবেদনের একটি কপি আমাদের হাতে এসেছে।
তালিকায় থাকা কোটিপতি মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে আছেন- মোহাম্মদপুরের মো. ইসতিয়াক ওরফে কামরুল হাসান, বংশালের নাছির উদ্দিন, উত্তরার ফজলুল করিম, বাড্ডার রিয়াদউল্লাহ, ভাটারার ছাব্বির হোসেন ওরফে সোনা মিয়া, আনোয়ারা ওরফে আনু, আসমা আহম্মেদ ডালিয়া ও রবিউল ইসলাম দম্পতি, ওয়ারীর কামাল হোসেন, যাত্রাবাড়ীর মোবারক হোসেন বাবু, কলাবাগানের শামীম আহম্মেদ পাখানী, শামসুর রহমান পাখানি, ফারজানা ইসলাম স্বপ্না, গেণ্ডারিয়ার রহিমা বেগম, মুগদার পারভীন, উত্তর মাণ্ডার শফিকুল ইসলাম, দক্ষিণ মাণ্ডার আলম, ডেমরার রাজু আহমেদ, মতিঝিলের লিটন, চকবাজারের দুই ভাই ওমর ফারুক, সুমন, লাল মিয়া, কলাবাগানের নাজমুস সাকিব, কামরাঙ্গীরচরের খুরশিদা ওরফে খুশী প্রমুখ।মাদকের ভয়াবহতা রোধে ২০১৮ সালের মে মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সমন্বয়ে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হয়। অভিযানের প্রথম কয়েক দিন ব্যাপক সাড়া জাগালেও সম্প্রতিক সময়ে সে ধরনের অভিযান চোখে পড়ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, আমরা মাদকবিরোধী যে অভিযানে ২০১৮ সালে শুরু করেছিলাম তা থামেনি। ওই বছরের ৩ মে থেকে এ পর্যন্ত ৬৯৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকার মাদক দ্রব্য উদ্ধার করেছি। এ সময়ের মধ্যে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ১৩৬ মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন।
র্যাব পরিচালক বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আমরা অভিযানের কৌশল পরিবর্তন করেছি। এ কারণে অভিযান সেভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। আমরা মাদকের খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না। যারা মাদকের গডফাদার, যারা মাদক বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, তাদের ধরতে চাই। সাম্প্রতিক সময়ে মাদক উদ্ধারের পাশপাশি বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীদের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী তালিকা হয়েছে। তালিকা নিয়ে অন্যান্য সম্পূরক সংস্থার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। একই ছায়াতলে থেকে অভিযান শুরু হবে। নতুন কৌশলে যে অভিযান শুরু হবে তাতে অনেক বেশি সফলতা আসবে বলে মনে করি। রাজধানীর তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনা গেলে মাদক সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব থাকবে না।
জানতে চাইলে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মাদক বিক্রি করে যারা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তাদের তালিকা আমাদের হাতে রয়েছে। তাদের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ চলছে। তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ শেষে তাদের নামে মামলা করা হবে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কোটিপতি মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকার এক নম্বরে রয়েছেন ইসতিয়াক ওরফে কামরুল হাসানের নাম। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে- ৫ বছর আগেও মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের খুচরা মাদক ব্যবসায়ী ছিল হাসান। এখন সে ইয়াবার পাইকারি ব্যবসায়ী। মাদক বিক্রির টাকায় সে মালয়েশিয়ায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। আশুলিয়া ও সাভারে বানিয়েছে তিনটি বাড়ি। এসবের মধ্যে আশুলিয়ার ব্যারন বাসস্ট্যান্ড ও গাজীরচট মধ্যপাড়ার পুকুর রোডে ২টি ও সাভারের মাদ্রাসা রোডে একটি বাড়ি রয়েছে। এছাড়াও মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের ‘বি’ ব্লকের ১৬২ নম্বর বাড়িটিও তার দখলে রয়েছে। এ বাড়িটি মূলত সে মাদক ব্যবসার কাজে ব্যবহার করে। তার আশুলিয়া ও সাভারের বাড়িতেও ইয়াবা মজুদ রাখা হয়। তালিকার ২ নম্বরে থাকা নাদিম এরই মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। পুলিশের তালিকায় ইয়াবার পাইকারি ব্যবসায়ী নাদিম মোহাম্পুর জেনেভা ক্যাম্পে থাকত। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বংশালের ইয়াবা ব্যবসায়ী নাছির উদ্দিনের বাড়ি চট্টগ্রাম সাতকাউনিয়ায়। এক সময় খালি হাতে রাজধানীতে এলেও পাইকারি ইয়াবা ব্যবসা করে এখন একটি ডেভেলপার কোম্পানির পার্টনার বনে গেছেন। তার রয়েছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কানেকশন। বিপদে পড়লে ওইসব কানেকশনের লোকজন তার পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। তালিকার তৃতীয় নম্বরে থাকা ফজলুল করিম সম্পর্কে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তার মূল ব্যবসা ইয়াবা ও লুপিজেসিক ইনজেকশন। উত্তরার বিভিন্ন থানায় তার নামে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। মাদক ব্যবসা করে সে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা রেখেছেন। বাড্ডার রিয়াদউল্লাহকে ইয়াবার ডিলার উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর বাড্ডাসহ বিভিন্ন থানায় তার নামে মাদকের মামলা আছে। তার বাবার নাম মৃত আহসান উল্লাহ। মায়ের নাম বেগম লুৎফুন নেসা। সে বাড্ডার আফতাবনগর ‘সি’ ব্লকে থাকে। গ্রামের বাড়ির মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার সমসপুরে।
গোয়েন্দা তালিকায় থাকা ছাব্বির হোসেন ওরফে সোনা মিয়াকে ভাসমান ইয়াবা ডিলার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের টেকনাফে। ইয়াবার ব্যবসা করে হাতিরপুলে একটি স্যানিটারি দোকান ও এলিফ্যান্ট রোডে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন আসমা আহম্মেদ ডালিয়া ও রবিউল ইসলাম দম্পতি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাদক মামলায় রবিউল এবং ডালিয়া দু’জনই গ্রেফতার হয়ে জেলে গেছেন। এরই মধ্যে ডালিয়া ছাড়া পেয়েছেন। তালিকায় থাকা কামাল হোসেনকে পাইকারি গাঁজা ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তার নামে ওয়ারী থানাসহ রাজধানীর কয়েকটি থানায় মামলা আছে। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে। মাদকবিরোধী জোরালো অভিযানের মুখে সে গা ঢাকা দেয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইয়াবার ডিলার মোবারক হোসেন বাবু মাদকের টাকায় যাত্রাবাড়ীর দনিয়ায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। তার বাড়ি নোয়াখালীর সুধারামপুর থানার কমিরপুর গ্রামে। ইয়াবা ডিলার আনোয়ারা ওরফে আনু ভাটারা এলাকায় মাদক সরবরাহ করেন। ভাটারা থানাসহ রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার নামে মাদকের মামলা আছে। তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গইলের ভুয়াপুরে। ভাটারা এলাকার অপর ইয়াবা ব্যবসায়ী নারগিস ওরফে মামি ওরফে সকার বউ। তিনি ভাটারার নূরের চালা এলাকায় থাকেন। ২০১৭ সালের নভেম্বরে ইয়াবার বড় চালানসহ তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন।
ইয়াবা ও হেরোইন ডিলার শামীম আহম্মেদ পাখানী ও তার স্ত্রী ফারজানা ইসলাম স্বপ্নার বাড়ি বেনাপোলের কাগজপুকুর এলাকায়। তারা কলাবাগানের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গেণ্ডারিয়ার রহিমা বেগম হেরোইন, ইয়াবা ও লুপিজেসিক ইনজেকশন ব্যবসায়ী হিসেবে চিহ্নিত। গেণ্ডারিয়া থানাসহ বেশ কয়েকটি থানায় তার নামে মামলা আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- গুলশান-বনানী এলাকায় বিদেশি মদ, বিয়ার ও ইয়াবার ব্যবসা করে হুমায়ুন কবির ওরফে কবির গাজী মোটা অংকের টাকার মালিক হয়েছেন। তিনি বসবাস করেন গুলশান ২ নম্বর এলাকার একটি অভিজাত ফ্ল্যাটে। দামি গাড়িতে করে মাদক দ্রব্য সরবরাহ করেন। মাদকবিরোধী অভিযান জোরালো হলে গা ঢাকা দেন।
জোয়ারসাহারা এলাকার ইয়াবার পাইকারি ব্যবসায়ী ইতি বেগমকে মাদক ব্যবসায় তার মা ফিরোজা, মেয়ে এ্যানি ও ছেলে প্রমি সহযোগিতা করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কোটিপতি মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় আরও যাদের নাম আছে তাদের মধ্যে আছেন- মুগদার পারভীন, উত্তর মাণ্ডার শফিকুল ইসলাম, দক্ষিণ মাণ্ডার আলম, ডেমরার রাজু আহমেদ, কাজলা নয়ানগর এলাকার নাজমুল(নতুন ব্যবসায়ী) ,মতিঝিলের লিটন, চকবাজারের দুই ভাই ওমর ফারুক ও সুমন, একই এলাকার লাল মিয়া, কলাবাগানের নাজমুস সাকিব, কামরাঙ্গীরচরের খুরশিদা ওরফে খুশী। এদের সবাইকে ইয়াবার ডিলার ও গাঁজার পাইকারি ব্যবসায়ী হিসেবে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কোটিপতি মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকায় অন্য যাদের নাম আছে তাদের মধ্যে আছেন- উত্তর বাড্ডার শরিফ ভূঁইয়া, উত্তরা পশ্চিম এলাকার এনায়েতুল করিম, উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরের গোলাম সামদানী, শাহবাগের শামীম শিকদার, মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের শহীদুজ্জামান ওরফে নাবিদ, নাজিমউদ্দিন রোডের পারভীন আক্তার, নিমতলীর নার্গিস আক্তার, বংশালের কাশেম, মো. সেলিম, কারওয়ান বাজারের মিনা বেগম, মাহমুদা খাতুন, মিনা বেগম, মহাখালী ওয়্যারলেস এলাকার রিমন সরদার, দক্ষিণ বাড্ডার আক্কাস আলী, জুরাইন ওয়াসা রোডের বাপ্পা, হাজীর মাজার এলাকার বাচ্চু মিয়া, ভাটারা নূরের চালার এলাকার ফতেহ, মিরপুর ২ এলাকার দুলাল ওরফে বাদল এবং মিরপুর পীরেরবাগ আমতলা এলাকার সজিব ওরফে কবিরাজ।