নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে এখনও পর্যন্ত বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিকই আছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ ছুটি দীর্ঘায়িত হলে বাজার ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়তে পারে। আর সেক্ষেত্রে কোনও মনিটরিংই কাজে আসবে না। এ জন্য সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখায় গুরুত্বারোপ করছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একদিকে পণ্যের সংকট দেখা দেবে, অপরদিকে সংকটের অজুহাতে বাড়বে দাম। তেমনটা হলে নি¤œ আয়ের মানুষের দিন পার করা কঠিন হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
অবশ্য নিত্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচুর পরিমাণে পণ্য উৎপাদন করছে। তবে পরিবহন ও শ্রমিক সংকটে পণ্য কারখানার বাইরে নিতে পারছে না। এতে বাজারে পণ্য সরবরাহে বিঘœ ঘটছে। আর এই সুযোগটি নিচ্ছে সুযোগসন্ধানী অসাধু ব্যবসায়ীরা।
পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, ছুটি ঘোষণায় অনেকে গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। যারা আছেন, তারাও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ট্রাক চালাতে চাইছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরই মধ্যে বাজারে শিশুখাদ্যের (বিভিন্ন ব্রান্ডের দুধ) সরবরাহ কমে গেছে। কারণ, একদিকে পরিবহন সংকট, অপরদিকে শ্রমিক সংকট। এই দুই সংকটে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন ও মজুত থাকার পরও মোকাম হিসেবে খ্যাত নওগাঁ, নাটোর ও কুষ্টিয়া থেকে রাজধানীতে চাল আসছে না। এতে করে রাজধানীর বাজারগুলোয় চাল সরবরাহে সমস্যা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে বেড়েছে দাম। সরকারের লোকজন মাঠে নামিয়েও চালের দাম আগের জায়গায় নামানো যায়নি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ বাড়ানো ছাড়া চালের দাম কমানো সম্ভব নয়।
জানা গেছে, দেশের উত্তরাঞ্চলে এবার সবজি উৎপাদন হয়েছে প্রচুর। করোনার প্রভাবে সব কিছুর সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে রাজধানীতে সবজি আসাও। এতে একদিকে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অপরদিকে সবজি সরবরাহে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ফলে বাড়ছে দাম। এভাবে চলতে থাকলে দাম দিয়েও প্রয়োজনীয় সবজি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। কাজেই কৃষক ও ভোক্তা বাঁচাতে যেকোনও মূল্যে উৎপাদিত সবজির সরবরাহ বাড়ানোর পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের।
তারা বলছেন, ইতোমধ্যে নি¤œ আয়ের মানুষ, শ্রমিকরা কাজ হারিয়েছেন। জমানো পুঁজি কিছুদিন হয়তো চলতে পারবেন তারা। কিন্তু ছুটি দীর্ঘ হওয়ার সম্ভাবনায় তারা চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন। এ অবস্থায় যদি নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হয়, দাম বাড়ে তাহলে এই শ্রেণির মানুষদের দিন পার করাই কঠিন হবে।
পোল্ট্রি খামারিরা বলছেন, ব্রয়লার মুরগি বিক্রির জন্য পাইকার বা ক্রেতা পাচ্ছেন না তারা। আগে ছোট খামারিরা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে মুরগি বিক্রি করলেও এখন খুচরা ক্রেতাও পাচ্ছেন না। একদিকে ক্রেতা নেই, অপরদিকে কমেছে চাহিদাও। একই অবস্থা ডেইরি খাতেরও। চাহিদার সঙ্গে দাম কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন গরুর খামারিরা।
পরিবহন সংকটের বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি হানিফ খোকন বলেন, ‘করোনা একটি ছোঁয়াচে ভাইরাস। তাই ভাইরাস বহনকারী যে কারও ছোঁয়ায় এটি সংক্রমিত হতে পারে। মৃত্যুভয় সবারই আছে। যেকোনও জিনিসের সরবরাহ ঠিক রাখতে প্রয়োজন পরিবহনব্যবস্থা। পরিবহনববস্থা এখন প্রায় পুরোপুরি অচল।’
তিনি বলেন, ‘বন্ধের ঘোষণা পেয়েই পরিবহন শ্রমিকরা বাড়ি চলে গেছে। তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তাই রাজধানীতে পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রাক সংকট দেখা দিয়েছে। এর বাইরে নিরাপত্তার অভাব তো রয়েছেই।’
এই শ্রমিক নেতা বলেন, বিআরটিসির অনেক ট্রাক রয়েছে। এসব ট্রাক রাস্তায় নামানো গেলে জরুরি প্রয়োজনের পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতা নিরসন অনেকটাই সম্ভব। বিষয়টি ভেবে দেখার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ ট্রাক শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহাম্মদ হোসেন বলেন, আমরা ট্রাক চালানো একপ্রকার বন্ধ রেখেছি। করোনা পরিস্থিতিতে রাস্তায় নিরাপত্তা নেই। গ্যারেজ খোলা নেই। খাবার হোটেল বন্ধ। দীর্ঘসময় গাড়িতে অবস্থানকালে ট্রাকের চালক ও হেলপাররা খাবেন কোথায়? এর ওপর রয়েছে পুলিশের নানা রকমের হয়রানি। এসব কারণে আমরা গাড়ি চালাচ্ছি না। এসবের নিশ্চয়তা পেলে ভেবে দেখা যাবে, ট্রাক চালানো সম্ভব কিনা।
তিনি বলেন, এছাড়া করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয় তো রয়েছেই। নানা কারণেই রাস্তায় পণ্যবাহী ট্রাকের সংকট দেখা দিয়েছে। আর এই সংকটের কারণেই পণ্য সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সংকট মোকাবিলায় পণ্যের সরবরাহ সিস্টেম ধরে রাখতে হবে। এই মুহূর্তে যেকোনও উপায়ে সাপ্লাই চেইনের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বাজারে সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়লে বাজার ব্যবস্থাপনা গুঁড়িয়ে যাবে। তখন কঠিন সমস্যা দেখা দেবে।
তবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, যেকোনও মূল্যে বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হবে। এ জন্য আমরা কাজ করছি। বাজারে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতেও কাজ চলছে।