বরগুনা প্রতিনিধি
তরমুজের এখন ভরা মৌসুম। এখনই সময় ট্রাক ভরে খেত থেকে তরমুজ বাজারে নেয়ার। বাজারে তরমুজের পসরা সাজিয়ে বসার কথা খুচরা বিক্রেতাদের। কিন্তু সারাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বন্ধ রয়েছে সকল প্রকার যান চলাচল। এর ফলে চাষিদের কাছে আসতে পারছেন না পাইকাররা। ফলে খেতেই পচতে শুরু করেছে তরমুজ।
বরগুনার আমতলী উপজেলার আঠারো গাছিয়া, হলদিয়া এবং চাওড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল ঘুরে ও তরমুজ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এতে লাভ তো দূরের কথা নিঃস্ব হয়ে পথে বসার উপক্রম দেখা দিয়েছে বরগুনার তরমুজ চাষিদের।
বরগুনার আমতলী উপজেলার হলুদিয়া ইউনিয়ের তক্তাবুনিয়া গ্রামের তরমুজ চাষি জহিরুল খলিফা বলেন, প্রতিবছর এমন সময় আমাদের এলাকা তরমুজের পাইকারদের পদচারণায় মুখর থাকে। কিন্তু এবছর এখন পর্যন্ত কোনো পাইকার আসেনি গ্রামে। আমাদের আবাদ করা তরমুজ পরিপক্ক হয়েছে। কিছু কিছু তরমুজ পচাও শুরু হয়েছে। কিন্তু গাড়ি চলাচল না করায় তরমুজ কেনার জন্য কোনো পাইকার আসছে না। তরমুজ নিয়ে আমরা ভীষণ চিন্তিত।
একই এলাকার তরমুজ চাষি সোহেল খলিফা বলেন, আট একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। খেতজুড়ে তরমুজ পচা শুরু করেছে। কিন্তু পাইকারের দেখা নেই। দুই একজন পাইকার আসলেও যে দাম বলছে, তাতে খরচের টাকাই উঠবে না। গাড়ি চলাচল করছে না। রাস্তায় মানুষ নেই। এজন্য তরমুজের প্রতি পাইকারদের আগ্রহ নেই বলেও জানান তিনি।
ছবির গাজি বলেন, ধারদেনা করে প্রায় ১২ বিঘা জমিতে তরমুজের চাষ করেছিলাম। সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো তরমুজ হয়েছে খেতে। এখন সেসব তরমুজ বাজারে নেয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। যদি তরমুজ বিক্রি করতে না পারি তাহলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে, ধারদেনা শোধ করা তো দূরের কথা।
হলদিয়া ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য আবু সালেহ (৪০) বলেন, আমতলীর তিনটি ইউনিয়ন বিশেষ করে হলদিয়া, আঠারোগাছিয়া এবং চাওড়া ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামে তিন থেকে চার হাজার তরমুজ চাষি রয়েছেন। সকল চাষিরই একই অবস্থা।
তিনি বলেন, আগামী দু’এক সপ্তাহের মধ্যে যদি করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হয় তাহলেও তরমুজ চাষিরা বেঁচে যাবেন। আর যদি তা না হয় তাহলে খেতের তরমুজ খেতেই পচে যাবে।
আমতলীর কৃষি বিভাগের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিখিল রায় জানান, বর্তমানে তরমুজ বাজারজাত করার পরিপূর্ণ সময়। তরমুজ চাষিরা তিন চার মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে অপেক্ষায় থাকেন এই সময়ের। এই সময়ে বাজার ঠিকভাবে ধরতে পারলে কৃষকরা তরমুজের ভালো দাম পান। কিন্তু দেশের যে পরিস্থিতি তাতে যদি অবস্থার উন্নতি না ঘটে তাহলে এবার তরমুজ চাষিরা হয়ত বড় রকমের একটি লোকসানে পড়ে যাবেন।
তিনি আরও বলেন, অনেক দরিদ্র চাষি আছেন যারা সম্পূর্ণ সার বাকিতে দোকান থেকে কিনে আনেন। ফসল বিক্রি করে তারপর শোধ করেন। অনেকে আছেন বিভিন্ন এনজিও থেকে লোন এনে তরমুজ চাষ করেন। এইসব দরিদ্র চাষিদের জন্য এবার একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে তরমুজ বাজারজাত করা।
তরমুজের পাইকার মো. মনির বলেন, অনেক দূর থেকে তরমুজ কিনতে বরগুনার কৃষকের কাছে এসেছি। করোনা ভাইরাসের কারণে কোনো গাড়ি চলছে না। এজন্য এখানে এসে বিপাকে পড়েছি। তরমুজ পরিবহনতো দূরের কথা আমি নিজেই এখন ফিরতে পারছি না।
তিনি বলেন, তরমুজ হচ্ছে কাঁচামাল। এটা সংরক্ষণ করা যায় না। অল্পতেই পচে যায়। কাঁচামাল পরিবহনের জন্য সরকার যদি দৃষ্টি দিতো, তাহলে আমরাও বাঁচতাম এবং কৃষকও বাঁচতো।
তরমুজে চিট্রুলিন (পরঃৎঁষষরহব) নামে একটি অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে যেটি শরীরে নাইট্রিক অক্সাইড বাড়াতে সহায়তা করে। নাইট্রিক অক্সাইড উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ফলে এটি হার্টের অসুখ থেকে আমাদের দূরে রাখতে পারে। এছাড়া তরমুজে রয়েছে ভিটামিন এ, বি৬, সি, ম্যাগনেশিয়াম ও পটাশিয়াম যেগুলো হার্টের জন্য উপকারী হিসেবে চিহ্নিত। তাই করোনা ভাইরাসের এই মহামারির সময় তরমুজ খেয়ে নিজেদের সুস্থ্য থাকতে পরামর্শ দিচ্ছেন বরগুনার সিভিল সার্জন ডা. হুমায়ুন শাহিন খান।
এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, দু’এক দিনের মধ্যেই তরমুজ চাষিদের সঙ্গে আমরা মতে বিনিময় করবো। এই সংকটকালীন সময়ে যে যে পদক্ষেপ নিলে তাদের জন্য ভালো হবে, তা আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন করব।