নিজস্ব প্রতিবেদক : সাড়ে পনেরো বছর টানা ক্ষমতায় থেকে উন্নয়ন, অগ্রগতি আর স্থিতিশীলতার বড়াই করা শেখ হাসিনা অবশেষে দেশ ছাড়লেন এক পরাজিত শাসকের মতো। ২০০৯ সালে শুরু হওয়া তার টানা শাসনের অবসান ঘটলো ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট, ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে।

যে সরকার নিজেকে “উন্নয়নের রোল মডেল” বলে দাবি করেছিল, সেই সরকারের পতনের পেছনে লুকিয়ে আছে একের পর এক রাজনৈতিক অন্ধত্ব, দম্ভ, ভয় ও দমননীতির নির্মম অধ্যায়।
কোটা থেকে গণঅভ্যুত্থান : এক স্ফুলিঙ্গের আগুন, সবকিছু শুরু হয়েছিল হাইকোর্টের এক রায় থেকে—যেখানে ২০১৮ সালের কোটা বাতিল প্রজ্ঞাপন খারিজ করা হয়। তখন কেউ কল্পনাও করেনি, এই রায় হবে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক টার্নিং পয়েন্ট।

শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকার গুলি চালায়, শত শত শিক্ষার্থী নিহত হয়। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, গ্রাম পর্যন্ত। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ এটিকে বলেছেন ‘গণবিদ্রোহ’—একটি দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বিস্ফোরণ।

“মানুষ বহু বছর ধরে রোষে ফুঁসছিল, শুধু দরকার ছিল একটা কারণ। কোটা আন্দোলন সেই স্ফুলিঙ্গটা জ্বালিয়ে দিয়েছিল,”
— অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এমিরেটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
দমননীতি ও ভয়ের সংস্কৃতি : ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে শেখ হাসিনা কার্যত একটি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। নির্বাচনী প্রহসন, বিরোধীদের গুম-খুন, ভুয়া মামলা, বাকস্বাধীনতার শ্বাসরোধ—সবকিছুই সেই দমননীতির প্রতিফলন।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশ করা ছিল প্রায় অসম্ভব। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার আইন আর পুলিশি নজরদারির মাধ্যমে মানুষকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা হয়।
“বাংলাদেশে এক ভয়ভীতির সমাজ গড়ে তোলা হয়েছিল। মানুষ মুখ খুলতে ভয় পেত।” — অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
এমনকি বিচার বিভাগ পর্যন্ত সরকার নিয়ন্ত্রণ করতো। যেসব মামলায় জামিন হয়নি, সরকার পতনের পর এক রাতেই সেসব মামলায় মুক্তি পান শত শত রাজনৈতিক কর্মী।
ভোটবিহীন ক্ষমতার আসন : ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই আওয়ামী লীগ ক্রমান্বয়ে গণতন্ত্রহীন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। ২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল একতরফা, আর ২০১৮ সালের ভোটের আগেই ব্যালটে ভোট পড়ে যায়—যা ‘রাতের নির্বাচন’ নামে কুখ্যাত। মানুষের ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা—সবকিছু কেড়ে নিয়ে সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
“স্বাধীনতা এ দেশের মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য হয়েছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগ সেই অধিকারটিই কেড়ে নিয়েছিল।”
— ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি।
দুর্নীতির রাজত্ব ও বেগমপাড়া : শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, যা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগরিটি (GFI)-এর হিসাবে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা।
বিদেশে তৈরি হয় কুখ্যাত ‘বেগমপাড়া’, যেখানে মন্ত্রী, এমপি ও আমলাদের পরিবার স্থায়ী হয়েছে পাচার করা টাকায়।
সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তাদের বিলাসী সম্পদের খবর সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে উস্কে দেয়।
“দুর্নীতি নিয়ে মানুষের ভয় বা লজ্জা উঠে গিয়েছিল। তারা দুর্নীতিকে সংস্কৃতি বানিয়ে ফেলেছিল।” — অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
অর্থনীতি: উন্নয়নের মোড়কে শ্বাসরুদ্ধ বাস্তবতা : পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, টানেল—সব প্রকল্পই ছিল ‘দেখানোর উন্নয়ন’।
কিন্তু বাস্তবে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, ডলার সংকট, ব্যাংকিং কেলেঙ্কারি, বেকারত্ব—সব মিলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর ড. মোস্তাফিজুর রহমানের ভাষায়, “সরকারি চাকরি পেতে ঘুষ দিতে হয়েছে, বেসরকারি খাতে সুযোগ কমেছে—মানুষ হতাশ, ক্ষুব্ধ ও ক্লান্ত।”অর্থনৈতিক বৈষম্য চরমে ওঠে। শাসকগোষ্ঠী বিলাসে মত্ত, সাধারণ মানুষ হতাশায় নিঃস্ব।
পুলিশ-আমলা নির্ভর ক্ষমতার বুদবুদ : দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ একটি “আমলা-পুলিশ নির্ভর রাজনৈতিক কাঠামো” তৈরি করেছিল। যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। থানার ওসি থেকে সচিব—সব পদেই দলীয় লোক বসানো হয়। ফলে প্রশাসনের ভেতরেও ক্ষোভ জমে।
সরকার পতনের পর পুলিশের এক বিজ্ঞপ্তিতে লেখা হয়—- “উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রাজনৈতিক স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করেছেন। আমরা বাধ্য ছিলাম নির্দেশ মানতে।” এই অভ্যন্তরীণ ক্ষোভও সরকারের পতন ত্বরান্বিত করে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
কোটা আন্দোলনে সরকারের আত্মঘাতী ভুল : কোটা আন্দোলনের শুরু থেকেই শেখ হাসিনা সরকারের আচরণ ছিল আত্মঘাতী। শিক্ষার্থীদের দাবিকে অবজ্ঞা করে তিনি প্রশ্ন ছুঁড়েছিলেন— “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না? তাহলে কি রাজাকারেরা পাবে?” এর জবাবে দেশজুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়—“তুমি কে, আমি কে—রাজাকার রাজাকার!” আওয়ামী লীগ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংলাপের বদলে ছাত্রলীগ ও পুলিশকে মাঠে নামায়। গুলিবর্ষণ, কারফিউ, ইন্টারনেট বন্ধ, গণগ্রেপ্তার—সব মিলিয়ে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকার নিজেই নিজের কফিনে পেরেক ঠোকে।
“তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। দমননীতি দিয়ে আন্দোলন থামানো যায় না—এটাই শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় ভুল।” — ড. ইফতেখারুজ্জামান।
ভারতের প্রতি অতিনির্ভরতা : রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে ভারতের প্রতি অতিনির্ভরতা জনগণের ক্ষোভ আরও বাড়ায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হওয়া দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলোর বেশিরভাগই ছিল ভারতের পক্ষে।
“ভারতের স্বার্থে তারা জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছে—এটা অনেকের কাছে অসম্মানজনক ছিল।”— অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
শেষ অধ্যায়: পতনের রাত্রি : গত বছরের ৪ আগস্ট রাতে ঢাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে গুজব—প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে গেছেন। পরদিন সকালে দেখা যায়, গণভবন দখল করেছে জনতা। সেনা বাহিনীর গাড়ি ঘিরে জনতার উল্লাস, পতাকার ঢেউ। শেখ হাসিনা তখন আর বাংলাদেশে নেই—গোপনে বিমানে দেশত্যাগ করেছেন।
“দল, প্রশাসন, বাহিনী—সব মিলিয়ে যে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তারা তৈরি করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত সেই দানবই তাদের গ্রাস করেছে।” — ড. ইফতেখারুজ্জামান।
উপসংহার : শেখ হাসিনার পতন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এটি দীর্ঘ এক দশকের অন্যায়, দমননীতি, দুর্নীতি ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন রাজনীতির পরিণতি।
বাংলাদেশের মানুষ আর ভয় মানেনি—তারা রুখে দাঁড়িয়েছে।
কোটা আন্দোলন ছিল কেবল সূচনা; শেষ পর্যন্ত তা হয়ে উঠেছে জনতার মুক্তির আন্দোলন।