নিজস্ব প্রতিবেদক : নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অবস্থিত যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ডিপোতে এক ভয়াবহ জালিয়াতি কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। সম্প্রতি এ ডিপো থেকে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ১৬৮ লিটার ডিজেল চুরি হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করলেও অভিযোগ রয়েছে—মূল হোতা জয়নাল আবেদীন টুটুল ও তার সিন্ডিকেটকে রক্ষার জন্য চলছে কোটি টাকার মিশন।

তদন্তেও অনিয়মের গন্ধ : ঘটনার পর যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু শুরুর দিকেই দেখা যাচ্ছে তদন্তে স্বচ্ছতার অভাব। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ক্যালিব্রেশন বা পরিমাপ ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে এ বিশাল জালিয়াতিকে ধামাচাপা দেওয়া হবে।
যমুনার একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত না করলে সঠিক তদন্ত সম্ভব নয়। অভ্যন্তরীণ কমিটিগুলো বরাবরই দায়মুক্তির কৌশল অবলম্বন করে।”

তেল টুটুল: ফতুল্লা ডিপোর গডফাদার : অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন জয়নাল আবেদীন টুটুল, পদবিতে অপারেটর (গ্রেজার)। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ফতুল্লা ডিপোর তিনটি গ্রেজার পদের দায়িত্ব একাই পালন করছেন টুটুল—সতেরো বছর ধরে। তেল পরিমাপের একমাত্র নিয়ন্ত্রক হওয়ায় পুরো চোরাই সিন্ডিকেট কার্যক্রম তার হাতের মুঠোয়।

টুটুলের বিরুদ্ধে রয়েছে তিনটি হত্যা মামলা। কালো গ্লাসের গাড়িতে এসে ডিপোর কর্মচারীদের হুমকি দেওয়াই তার স্বাভাবিক রুটিন। স্থানীয় সূত্র জানায়, ৪ অক্টোবর পূজার ছুটির দিনে টুটুল প্রকাশ্যে ডিপোতে প্রবেশ করে কর্মচারীদের হুমকি দেন—“উপরের মহল ম্যানেজ হয়ে গেছে, কেউ যেন মুখ না খোলে।”
সিন্ডিকেটের পেছনে প্রভাবশালী কর্মকর্তারা : টুটুল একা নন। অভিযোগ রয়েছে, তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছেন যমুনা অয়েলের উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা—হেলাল উদ্দিন, ডিজিএম অপারেশন, শেখ জাহিদ আহমেদ, এজিএম ডিপো অপারেশন, আসলাম খান আবু উলায়ী, ফতুল্লা ডিপো ইনচার্জ, নুরুল হক, ক্যালিব্রেটর কর্মকর্তা।
অভিযোগ অনুসারে, এদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া এত বিশাল পরিমাণ তেল পাচার সম্ভব নয়। insiders বলছে, বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়মিত মাসোহারা যায় এই চক্র থেকে।
দুদকের অভিযান : অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে দুদক মাঠে নেমেছে। ৮ অক্টোবর দুপুরে দুদকের সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এর সহকারী পরিচালক সাইদ মোহাম্মদ ইমরানের নেতৃত্বে যমুনা অয়েলের পতেঙ্গা টার্মিনাল অফিসে অভিযান চালানো হয়।
টার্মিনালের এজিএম (টার্মিনাল) মোহাম্মদ মাকছুদুর রহমানকে তেল সরবরাহ সংক্রান্ত সকল রেকর্ডপত্র জমা দিতে বলা হয়। পরে যমুনা অয়েলের আগ্রাবাদ প্রধান কার্যালয় থেকেও নথিপত্র তলব করা হয়। দুদকের উপ-পরিচালক মো: সুবেল আহমেদ গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন—“প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে, কমিশন পর্যালোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।”
যমুনা অয়েলের অতীত অনিয়ম : যমুনা অয়েল দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। পূর্বে চট্টগ্রাম টার্মিনালে জ্বালানি পাচার, ঠিকাদারি দুর্নীতি, টেন্ডার সিন্ডিকেটসহ একাধিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। তবে প্রতিবারই প্রভাবশালী চক্রের ছত্রছায়ায় অপরাধীরা পার পেয়ে গেছে। এবারও আশঙ্কা করা হচ্ছে একই চিত্রের পুনরাবৃত্তি।
প্রশ্ন রয়ে গেলো : এত বিশাল পরিমাণ ডিজেল চুরি হলো, অথচ এতদিন কেউ জানলো না—কীভাবে ? তদন্ত কমিটিতে অভিযুক্তদের অন্তর্ভুক্ত করার মানে কি তদন্তকে ‘ম্যানেজ’ করা ? দুদকের অভিযান কি শেষ পর্যন্ত দায়মুক্তির নাটকে রূপ নেবে, নাকি ফাঁসবে তেল টুটুল সিন্ডিকেট?
ফতুল্লা ডিপোর ডিজেল চুরি কেলেঙ্কারি এখন শুধু যমুনা অয়েল নয়, দেশের জ্বালানি খাতেরই বড় প্রশ্নবিদ্ধ অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা যাক, এবার সত্যিই বিচার হয়, নাকি আবারও ধামাচাপা পড়ে যায় কোটি টাকার এই চোরাই কারবার।