গরীবের ওষুধ চোরের হাতে

অপরাধ জাতীয় স্বাস্থ্য

করোনায় ওষুধ চোরদের পোয়াবারো

পাড়া মহল্লার দোকানে সরকারি ওষুধ

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) রোগীর ওষুধও যাচ্ছে চোরের পকেটে। আবার ওষুধ না পেয়ে অনেক রোগি মারা যাচ্ছেন। অথচ গরীব ও সাধারণ রোগীর ওষুধ রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপালের পাশের ফার্মেসিতে প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধগুলো কৌশলে নগরীর চানখাঁরপুল, মিটফোর্ড রোডসহ অলিগলির ফার্মেসিতে বিক্রি করে ওই চক্র।
সরেজমিনে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, ঢামেক হাসপাতালে ওষুধ চুরির শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট জড়িত রয়েছে। হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মচারী, কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি ও ডাক্তারদের যোগসাজশে ওই চক্রটি এ কাজ করে যাচ্ছে। অথচ রোগীরা প্রাণরক্ষার প্রয়োজনীয় ওষুধ পাচ্ছেন না। এই ওষুধ চোর চক্রের সদস্যরা হাসপাতালের বিভিন্ন পদে কর্মরত। তাদের হাসপাতালে ব্যাপক আধিপত্য। এদের অনেকেই সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আবার কেউ জড়িত বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে। এরা একদিকে যেমন সরকারি চাকরিজীবী, অন্যদিকে আবার রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। ঢামেকে দীর্ঘদিন ধরেই ওষুধ চোরচক্র সক্রিয়। কখনো কখনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছু ব্যবস্থা নিলেও পুনরায় আবারো একই ব্যবসায় নিয়োজিত হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢামেক’র শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ওষুধ চুরি করে এক সিনিয়র স্টাফ নার্স ধরা পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল গেটের সামনে থেকে ওষুধসহ ওই নার্সকে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এর হাতে আটক করে।
জানা গছে, বার্ন ইউনিটের রোগীদের বিনামূল্যে প্রদানের জন্য দেওয়া ওষুধ চুরি করে দীর্ঘদিন ধরেই খোলা বাজারে বিক্রি করে আসছিল একটি চক্র। এদের ধরতে বেশকিছু দিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে আসছিল গোয়েন্দা সংস্থা। তারই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহীদুল্লাহ হল গেটের সামনে থেকে আটক করা হয় সিনিয়র নার্স তপন কুমার বিশ্বাসকে। এসময় তার কাছ থেকে প্রায় ২৫ হাজার টাকা মূল্যের ওষুধ উদ্ধার করা হয়। এ ওষুধগুলো বার্ন ইনস্টিটিউটের রোগীদের বিনামূল্যে সরবরাহের কথা ছিল। আটক নার্সকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। সিন্ডিকেটের সদস্যরা চুরি করা ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রেখে দিচ্ছে। ওইসব ওষুধ কৌশলে নিরীহ ও দরিদ্র রাগীদেও দেয়া হয়। এতে রোগীর প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে।
শুধু ঢাকা মেডিকেলই নয়, নগরীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে রোগীদের জন্য বরাদ্দ মূল্যবান ওষুধ সামগ্রী চুরি করা হচ্ছে। হাসপাতালের কতিপয় নার্স, স্টাফ ও বহিরাগত দালালদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সিন্ডিকেট এ ওষুধ চুরির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
সম্প্রতি হাসপাতাল থেকে ওষুধ চুরি করার সময় ব্যাগভর্তি ওষুধসহ একজনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হলে চুরির মূল হোতা হাসপাতালের একজন সিনিয়র স্টাফ নার্সের নাম আসে। কিন্তু তাকে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। উল্টো ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, সরকারি অর্থ ব্যয়ে নয়শ’ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটিতে রোগীদের জন্য বছরে ৭ থেকে ১০ কোটি টাকার ওষুধ ও সার্জিক্যাল সামগ্রী ক্রয় করা হয়। এর সিংহভাগ ওষুধ ও সার্জিক্যাল সামগ্রী চুরি হয়ে যায়। প্রতিদিন সেন্ট্রাল স্টোর থেকে নির্ধারিত ইনডেন্টের (চাহিদাপত্র) মাধ্যমে দায়িত্বপ্রাপ্ত ইনচার্জ নার্সরা অপারেশন থিয়েটার ও আন্তঃবিভাগে নিয়ে যায়। এরপর ওইসব জায়গা থেকে বিভিন্ন মাধ্যম বেহাত হচ্ছে মূল্যবান ওষুধ ও সার্জিক্যাল সামগ্রী। আবার কখনও এসব ওষুধের ক্রেতারাও সরাসরি হাসপাতালে এসে ওষুধ ও সার্জিক্যাল সামগ্রী সিন্ডিকেটের সদস্যদের কাছ থেকে ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি আটক হওয়া এক ব্যক্তি মিরপুর ১১ নম্বরে অবস্থিত মুন্নি মেডিকেল হল নামে একটি ফার্মেসির মালিক। ২১ জানুয়ারি সব সময়ের মতো ফার্মেসির মালিক রফিকুল ইসলাম গ্রাহকের অর্ডার পেয়ে মিটফোর্ডে এসে ওষুধ সংগ্রহ করে বের হওয়ার সময় হাসপাতালের একজন ওয়ার্ড মাস্টার তাকে চ্যালেঞ্জ করেন। এসময় তিনি দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে তাকে আটকের পর তার ব্যাগ তল্লাশি চালিয়ে ৫০টি ক্যাটরোলাক ইনজেকশন, ৬টি ম্যাক্সিপার আইভি আয়রন ইনজেকশন, ৬টি ডিল্যাক লেকটোলোজ ওরাল সলিউশন ও ১০টি ক্যাথেডার উদ্ধার করা হয়। এসময় জিজ্ঞাসাবাদে ওষুধগুলো একজন সিনিয়র স্টাফ নার্সের কাছ থেকে সংগ্রহ করার কথা স্বীকার করেন। কিন্তু সুকৌশলে ওই নার্সের নাম মামলার এজাহার থেকে বাদ দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। ঘটনার দিনে কোতোয়ালি থানায় চুরির মামলা করে আসামিকে মালামালসহ পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকলে কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানান, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ওষুধ চুরির ঘটনায় আটক সিনিয়র স্টাফ নার্সকে শাহবাগ থানা সোপর্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সরকারি ওষুধ বিক্রিকালে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের ফার্মাসিস্ট আটক : রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিটিউটে অভিযান পরিচালনা করে সরকারি ওষুধ বিক্রির সময় হাতেনাতে দুই ফার্মাসিস্টকে আটক করেছে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)। জব্দ করা হয়েছে সরকারি দামি সব ইনজেকশন। যার বাজার মূল্য প্রায় দেড় লাখ টাকা।
এনএসআই সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধভাবে সরকারি ওষুধ বিক্রি করে আসছিল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কয়েকজন কর্মচারী।
বুধবার দুপুরে গোপনে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে অবস্থান নেয় এনএসআইয়ের একটি দল। সরকারি দেড় লাখ টাকার ওষুধ বিক্রির সময় হাতেনাতে আটক করা হয় ইনস্টিটিউটের ফার্মাসিস্ট নির্মল সরকারকে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে সহযোগী হিসেবে উঠে আসে স্টোর ইনচার্জ বশির উদ্দিন আহমেদের নামও। পরে তাকেও আটক করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ২০০ পিস (ক্লাক্সো৬০ ইনজেকশন) ৩০ বক্স (ক্লন্ট ৭৫) ওষুধ তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে। যার বাজার মূল্য আনুমানিক দেড় লাখ টাকা। কিন্তু সেসব ওষুধ বাইরে মাত্র ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছিল।
আটকদের শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এনএসআইয়ের অভিযান পরিচালনাকারী বিশেষ দল।
এ ব্যাপারে শেরেবাংলা নগর থানার ওসি জানে আলম মুন্সি জানান, বিষয়টি আমরা অবগত। একটু পরেই তাদের থানায় সোপর্দ করা হবে। এরপরই পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।


বিজ্ঞাপন