নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশে আক্রান্ত বিবেচনায় কভিড-১৯ এ মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস করতে পারায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছেন। ইউরোপ, আমেরিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনা হচ্ছে। এমনকি পাশের দেশ ভারতও করোনাভাইরাস সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। ভারতে দিনে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যুও হচ্ছে প্রচুর। কিন্তু আমাদের দেশে শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুহার এখন ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। করোনায় সাধারণ মানুষের জীবন-যাত্রাকে স্বাভাবিক অবস্থানে ধরে রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। একের পর এক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করেও তিনি প্রশংসিত হয়েছেন বিশ^দরবারে।
বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে কাজ না থাকা, কাজের বা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া, আকামা বা ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় অবৈধ হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে প্রবাসী কর্মীরা দেশে ফিরে এসেছেন। অনেকে আবার বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে আউট পাশ নিয়েও দেশে ফেরত এসেছেন। গত ১ এপ্রিল থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে বিশ্বের ২৬টি দেশ থেকে ৭৮ হাজার ৪৩ জন প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মী দেশে ফিরেছেন। ফেরতদের মধ্যে ৭৩ হাজার ৩১১ জন পুরুষ এবং ৪ হাজার ৭৩২ জন নারী রয়েছেন।
জানা গেছে, বিদেশ প্রত্যাগত কর্মীদের পুনর্বাসনে ৭০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন এবং তাদেরকে পুনঃপ্রশিক্ষণের মাধ্যমে আবারো বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ জানান, করোনা পরিস্থিতিতে বিদেশ প্রত্যাগত কর্মীদের পুনর্বাসন ও প্রবাসে কর্মরতদের নিরাপদ অভিবাসনসহ তাদের সার্বিক কল্যাণে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
গত ছয় মাস ধরে অদৃশ্য এ শক্তির মোকাবিলার পাশাপাশি ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। এখন চলছে বন্যা। এসব প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে মানুষকে বাঁচাতে বহুমাত্রিক উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কর্মঘণ্টা ভুলে শক্ত হাতে একাই সামলে নিচ্ছেন সবকিছু। বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। করোনার মধ্যেও থেমে নেই মেগা প্রকল্পগুলোর নির্মাণ। দেশের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ছে। অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠায় অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় ২ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আগের অর্থবছরে যা ছিল ১ হাজার ৯০৯ ডলার। অর্থাৎ দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় এক বছরের ব্যবধানে ১৫৫ ডলার বেড়েছে। করোনা সংকটকালে বাজার পরিস্থিতিও ছিল সাধারণ মানুষের নিয়ন্ত্রণে। অর্থাৎ করোনা, আম্ফান, বন্যা ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সফলভাবে সংকট মোকাবিলা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মন্ত্রণালয় গৃহীত উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী জানান, বিপদগ্রস্ত প্রবাসী বাংলাদেশিদের জরুরি খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তার জন্য প্রায় ১০ কোটি টাকার আর্থিক সাহায্য প্রদান, কোভিড-১৯ এ মৃত প্রত্যেক প্রবাসী বাংলাদেশির পরিবারকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ৩ লাখ টাকা আর্থিক সাহায্য প্রদান; করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিদেশ ফেরৎ কর্মীদেরকে কোয়ারেন্টিন পালন শেষে নগদ ৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা; বিদেশ প্রত্যাগত অভিজ্ঞ কর্মীদের যথাযথ স্বীকৃতি ও সনদায়নের উদ্যোগ; বিদেশ ফেরত অসহায়, ক্ষতিগ্রস্ত, দরিদ্র কর্মী ও বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি কর্মীর পরিবারের সদস্যদেরকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ দেশে চলমান সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় মানবিক সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত বিদেশ ফেরত কর্মীদের পুনর্বাসনের জন্য ৭০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনসহ বিভিন্ন ধরণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এর আওতায় কোভিড-১৯ এ ক্ষতিগ্রস্ত বিদেশ ফেরত কর্মীদের ৪ শতাংশ সরল সুদে বিনিয়োগ ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। এ জন্য ২শ’ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসী কর্মীদের পুনর্বাসনে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের বিষয়ে গত ১২ জুলাই প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের সাথে ওয়েজ অর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রীর মতে, বিদেশ ফেরত কর্মীরা অভিজ্ঞতার বিবেচনায় দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে মানবতার জননী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রবাসী কর্মীদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখা ও তাদের সামগ্রিক সুরক্ষায় সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে ফেরা কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ না থাকায় সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ফিরেছেন ২৫ হাজার ৬৫৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ কর্মী ২৪ হাজার ৫৫৩ জন। আর নারী কর্মী ফিরেছেন ১১০০ জন। সৌদি আরব থেকে ১৫ হাজার ৩৮৯ জন প্রবাসী কর্মী ফেরত এসেছেন। এর মধ্যে পুরুষ ১৩ হাজার ৭৯৬ জন, আর নারী কর্মী রয়েছেন ১ হাজার ৫৯৩ জন। সৌদি ফেরত কর্মীদের মধ্যে বেশিরভাগই বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে আউটপাস নিয়ে দেশে ফিরেছেন।
করোনা ভাইরাসের প্রেক্ষিতে কাজ না থাকায় টুরিস্ট নির্ভর দেশ মালদ্বীপ থেকে ফিরেছেন ৭ হাজার ৯০৯ জন প্রবাসী কর্মী। কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ায় সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেছেন ১ হাজার ৩৮২ জন। বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে ওমান থেকে দেশে ফিরেছেন ৩ হাজার ৮৮৪ জন। ভিসার মেয়াদ না থাকায় কুয়েত থেকে দেশে ফিরেছেন ৭ হাজার ৩২৯ জন। বাহরাইন থেকে ফিরেছেন ৭৪৬ জন।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে এসেছেন ৭১ জন প্রবাসী। কাতার থেকে ফিরেছেন ৬ হাজার ৬০১ জন। মালয়েশিয়া থেকে ফিরেছেন ২ হাজার ২২৬ জন। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ফিরেছেন ১০০ জন। কাজ না থাকায় থাইল্যান্ড থেকে ফিরেছেন ২০ জন, মিয়ানমার থেকে ৩৯ জন, জর্ডান থেকে ৪৮১ জন এবং ইরাক থেকে ফিরেছেন ২ হাজার ১৩৬ জন।
কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ায় ভিয়েতনাম থেকে ফিরেছেন ১২২ জন এবং শ্রীলংকা থেকে ৮০ জন। অন্যদিকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে ইতালি থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে ১৫১ জন প্রবাসী বাংলাদেশিকে। এই ১৫১ জন প্রবাসী গত ৬ জুলাই বাংলাদেশ থেকে ইতালি গেলে তাদের ফেরত পাঠানো হয়। পরে দেশে ফিরলে সবাইকে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। এছাড়া লেবানন থেকে ৯৭৬ জন, রাশিয়া থেকে ১০০ জন, মরিশাস থেকে ২০ জন, তুরস্ক থেকে ১ হাজার ৯৪৮ জন, নেপাল থেকে ৫৫ জন, হংকং থেকে ১৬ জন, কম্বোডিয়া থেকে ৪০ জন ও জাপান থেকে ৮ জন প্রবাসীকর্মী দেশে ফেরত এসেছেন।
মানবতার নেত্রী শেখ হাসিনার মতে, ‘দেখা যাচ্ছে যে, প্রাকৃতিক পরিবেশের লালিত মানুষ এই মহামারীর সঙ্গে ভালোভাবেই লড়াই করছে। তাই আমাদের অবশ্যই দৈনন্দিন জীবনে মৌলিক প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রাখতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কভিড-১৯-পরবর্তী পরিস্থিতি বৈশি^ক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন এভাবে হতে পারে- প্রথমত উদ্বেগের কারণে সুরক্ষাবাদের নামে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে আরও নিয়ন্ত্রণ, অভিবাসন ও ভিসা নীতিমালায় আরও কঠোর হতে পারে। তবে এটি মহামারী মোকাবিলার জন্য বৈশি^ক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরে। দ্বিতীয়ত এটা পরিষ্কার যে. কভিড-১৯-এর কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি ২০০৮-২০০৯-এর অর্থনৈতিক সংকটকে ছাড়াবে। তবে নেটওয়ার্কযুক্ত অর্থায়ন ও সম্পদ সৃষ্টির নতুন মাত্রা যোগ করবে। তৃতীয়ত এরূপ অর্থনীতির ওপর এত বড় অভিঘাত গত কয়েক দশকেও দেখা যায়নি। কভিড-১৯ মহামারী সর্বত্র সরকার, প্রাইভেট সেক্টর, আন্তর্জাতিক কমিউনিটি এবং অন্য নেতৃবৃন্দের কাছে অস্বাভাবিক দাবি জানাচ্ছে। একটি সংকটের সময়ে কী ধরনের নেতৃত্ব প্রয়োজন তা পুননির্ধারিত পরিকল্পনায় হয় না বরং এ প্রক্রিয়ায় জড়িত মানুষের আচরণ ও মানসিকতায় তা গড়ে ওঠে। খাদ্যে নিরাপত্তা অর্জন, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন উন্নতি ও লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ ও নারী ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। আগামী তিন দশকে বিশ্বব্যাপী তিনটি দ্রুততম ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির একটি হিসেবে বিশ্বব্যাপী মূল্যায়ন অভিক্ষেপণ বাংলাদেশের দিকে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ২৬তম বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ২৩তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের পরেই মানুষের মনে নতুন করে সাহস সঞ্চার হয়। সবশ্রেণী পেশার মানুষ নিজ নিজ ক্ষেত্রে নতুন পরিকল্পনায় কাজ শুরু করেন। ভাঙা মন নিয়ে ফিরে আসা প্রবাসীরাও নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। স্বল্প সুদে ঋন নিয়ে অনেককেই এই অল্প সময়ের মধ্যে স্বাভলম্বি হতেও দেখা গেছে। শুধু করোনা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাই নয়, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান, বন্যা পরিস্থিতি শক্ত হাতে মোকাবিলা করছেন। আবার অর্থনীতির চাকাও সচল রেখেছেন। গণভবন থেকে সবকিছু কঠোরভাবে মনিটরিং করছেন। কিছু দোষত্রুটি ও অন্যায় হলে সেখানেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমনকি দলীয় পরিচয়েও কেউ পার পাচ্ছে না।