নিজস্ব প্রতিবেদক : জলবায়ু-সংক্রান্ত সবগুলো প্রকল্পেই বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র পেয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এ-সংক্রান্ত সাতটি প্রকল্পের ওপর গবেষণা করে এমন তথ্য পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সবগুলো প্রকল্পই রাজনৈতিক সুপারিশের ভিত্তিতে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি প্রকল্পের অনুমোদনে সাবেক একজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীকে ১০ শতাংশ প্রকল্পের অর্থ অগ্রিম ঘুষ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
একটি প্রকল্পের আওতায় ৬৫০ কিলোওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলেও ভোক্তা পর্যায়ে দৈনিক মাত্র ৫০ কিলোওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহের নির্বাহী আদেশ না থাকায় বিদ্যুতের অপচয় করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন, অর্থায়ন ও প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্পের আওতায় উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করার সুযোগ না থাকায় অবমুক্তকরণের নামে ২০১৭ সাল থেকে প্রতি বছর প্রায় ১৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের অপচয় করা হচ্ছে। সড়কবাতি-সংক্রান্ত দুটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যথাযথভাবে যাচাই না করেই অতিরিক্ত ব্যয় প্রাক্কলনসহ অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়, একই সময়ে একই ধরনের সক্ষমতার প্রকল্প দুটি অনুমোদিত হলেও প্রকল্প দুটির আওতায় উত্থাপিত সড়কবাতির ইউনিটপ্রতি মূল্যের পার্থক্য প্রায় এক লাখ এক হাজার টাকা। এই দুটি প্রকল্পের মধ্যে যে প্রকল্পে সড়কবাতির ইউনিট মূল্য সবচেয়ে বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে, সেই প্রকল্পটির প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রণয়ন, অনুমোদন, বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদার নির্বাচনে এক মন্ত্রীর সাবেক সহকারী প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই প্রকল্পের প্রায় অর্ধেক সড়কবাতি অকার্যকর হয়ে গেছে।
টিআইবির তথ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে প্রাক্কলিত প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা জোগানের পরিকল্পনার বিপরীতে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই অর্থের মাত্র ৬% (১২,৬৯৯.৭০ কোটি টাকা) তহবিল আন্তর্জাতিক উৎস থেকে প্রদান করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় উৎস থেকে ২০২০ সাল নাগাদ যথাক্রমে ৬০৮.৬২ কোটি এবং ১২,০৯১.০৮ কোটি টাকা অর্থায়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের (বিসিসিটিএফ) মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে অর্থায়ন করা হয়েছে এবং গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ), স্পেসিফিক ইনভেস্টমেন্ট লোন (এসআইএল), ক্লাইমেট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (সিআইএফ), গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ), বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্স ফান্ডের (বিসিসিআরএফ) মাধ্যমে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে প্রশমন কার্যক্রমে তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রশমন কার্যক্রমে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অর্থায়নের অনুপাত যথাক্রমে ৫:৯৫।
বাংলাদেশে প্রশমন অর্থায়নের সিংহভাগ আন্তর্জাতিক উৎস থেকে সংগ্রহ করা হলেও এই আন্তর্জাতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থায়নের মাত্র ৬৭% অর্থ শুধু প্রশমন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে ব্যয় করা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে অনুদানভিত্তিক অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে ২০১৯ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে প্রদত্ত প্রশমন অর্থায়নের প্রায় ১২,০৯১.০৮ কোটি টাকার মাত্র ১৫% অনুদান হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রশমন কার্যক্রম/প্রকল্প বাস্তবায়নরত জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে কোনো কার্যকর সমন্বয় ও আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ না থাকায় এনডিসির প্রশমন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ সম্ভাব্য উৎস থেকে প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহে যথাযথ কৌশল গ্রহণ এবং সম্ভাব্য উৎস থেকে প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহে এখনো আশানুরূপ সাফল্য অর্জনে এখনো আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।
টিআইবি বলছে, জাতীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে কার্যকর অবদান রাখতে বিসিসিএসএপিতে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা ও গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে একটি কৌশলগত জ্বালানি পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। বাস্তবে বিগত ১১ বছরেও জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে সময়াবদ্ধ সুর্নিদিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক রোডম্যাপ তৈরি হয়নি। ফলশ্রুতিতে, নবায়নযোগ্য খাত থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিক বিনিয়োগ/অর্থায়নের বিষয়ে কোনো কৌশলগত দিকনির্দেশনা না থাকায় সহজেই পরিবেশ বিধ্বংসী কয়লা ও এলএনজিতে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এনডিসিতে বাংলাদেশের প্রশমন বিষয়ক প্রতিশ্রুতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুবিদ্যুৎ ৪০০ এবং সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ১০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা। অথচ দেশি-বিদেশি লবির স্বার্থে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিবর্তে বাংলাদেশ এই লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত মাত্র ২.৯ মেগাওয়াট (০.০০৭%) বায়ুবিদ্যুৎ এবং ৩৩৮.৬৫ মেগাওয়াট (৩৩.৯%) সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করেছে, যা প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম।
পরিবহন খাতেও ২০১৫ সালের তুলনায় ১৫ শতাংশ গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও কীভাবে এই হার কমানো হবে, সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা করা হয়নি।
‘গবেষণাধীন সাতটি প্রকল্পের প্রস্তাবনায় সুনির্দিষ্ট প্রত্যাশিত ফলাফলে উল্লেখের বাইরে যদি প্রকল্পে প্রস্তাবিত কার্যক্রমের কথা বিবেচনা করা হয়, তবে দেখা যায় সাতটি প্রকল্পের মধ্যে চারটির ক্ষেত্রে বনায়ন, তিনটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংক্রান্ত কার্যক্রম করা হয়েছে। অনুমোদিত প্রকল্প প্রস্তাবনার সঙ্গে বাস্তবায়নের সামঞ্জস্যতা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, একটি প্রকল্প ব্যতীত বাকি ছয়টি প্রকল্পেই প্রস্তাবনার সঙ্গে বাস্তবায়নে বিভিন্ন ধরন ও মাত্রার অসামঞ্জস্যতা রয়েছে।’
বনায়নের প্রকল্পগুলোর মধ্যে দুটি প্রকল্পে আংশিক বনায়ন করে প্রকল্প কার্যক্রম সমাপ্ত করা হয়েছে এবং অপর দুটি প্রকল্পে প্রস্তাবিত গাছের প্রজাতি বৈচিত্র্য রক্ষা করা হয়নি।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির তিনটি প্রকল্পের দুটি সড়কবাতি সংক্রান্ত প্রকল্প। যেখানে একটি প্রকল্পে প্রস্তাবনার উল্লেখিত রাস্তায় সড়কবাতি স্থাপন না করে অন্য স্থানে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার ইচ্ছামতো সড়কবাতি স্থাপন করা হয়েছে। অপর যে প্রকল্পের আওতায় সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে, সেখানেও প্রস্তাবনায় উল্লেখিত ৬৫০ কিলোওয়াট লক্ষ্যমাত্রা বিপরীতে ভোক্তা পর্যায়ে মাত্র ৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
টিআইবির গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, নির্বাচিত সাতটি প্রকল্পের মধ্যে পাঁচটি প্রকল্পের স্থানীয় বাস্তবায়ন কার্যালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তার উপস্থিতি এবং চাহিদাভিত্তিক তথ্য প্রদানের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সাতটি প্রকল্পের মধ্যে পাঁচটিতে তথ্য বোর্ড থাকলেও তথ্য বোর্ডে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলীর ঘাটতি রয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে জনদৃষ্টির আড়ালে নামসর্বস্ব তথ্য বোর্ডগুলো বসানো হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী সমন্বিত তথ্য বোর্ড না থাকলেও স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য প্রকল্প এলাকার বিভিন্ন স্থানে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় তথ্য বাতায়নে অঞ্চল এবং প্রতিষ্ঠানভিত্তিক তথ্য প্রকাশ ও হালনাগাদের সুযোগ রাখা হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে অঞ্চলভিত্তিক তথ্য বাতায়নে তথ্য হালনাগাদের বিষয়টি অনুপস্থিত।
এসব অনিয়ম দূর করতে একাধিক সুপারিশ করেছে টিআইবি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-
>> জলবায়ু প্রশমন অর্থায়ন ও নীতি/কৌশল/অঙ্গীকার বাস্তবায়নে অবিলম্বে প্যারিস চুক্তিতে প্রতিশ্রুত অনুদানভিত্তিক প্রশমন অর্থায়ন নিশ্চিতকরণে উন্নত রাষ্ট্রসমূহের ওপর বাংলাদেশের নেতৃত্বে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের ঐক্যবদ্ধ কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
>> জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের সবুজ জলবায়ু তহবিলসহ আন্তর্জাতিক তহবিলসমূহে অভিগম্যতা অর্জনে আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যকর পথ নকশা প্রণয়ন করতে হবে।
>> কয়লা ও এলএনজির মতো জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক শক্তিতে বিনিয়োগ বন্ধ করে নবায়নযোগ্য খাতে বিনিয়োগ ও অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
>> নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের অযৌক্তিক ব্যয় কমিয়ে সুলভে উৎপাদনে সরকারি প্রকল্পের ন্যায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগকারীদেরও একই ধরনের প্রণোদনা (কর অব্যাহতি এবং ক্যাপাসিটি চার্জ মুক্ত) প্রদান করতে হবে।
>> বনায়ন ও বন্যপ্রাণী আবাস সংরক্ষণসহ বন ব্যবস্থাপনায় অগ্রাধিকারমূলক প্রশমন অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
>> তথ্য বোর্ডে আবশ্যকীয় উল্লেখিত বিষয় সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন প্রণয়ন সাপেক্ষে সকল প্রকল্প এলাকায় তথ্য বোর্ড উপস্থানসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
>> প্রকল্প তদারকি, নিরীক্ষা ও মূল্যায়ন প্রতিবেদন জনগণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে এবং প্রকল্পের সকল পর্যায়ে জন অংশগ্রহণসহ তৃতীয় পক্ষের স্বাধীন তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। এবং
>> ‘জলবায়ু ট্রাস্ট তহবিল ব্যবহার নীতিমালা, ২০১২’ লঙ্ঘনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধানসহ নীতিমালা সংশোধন করতে হবে।