নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রায় ১১ বছর আগের কথা। ২০১০ সালে রাজধানী ঢাকার নির্ধারিত কিছু এলাকায় যেখানে দুই রুমের বাসা ভাড়া ছিল ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা; সেই বাসার ভাড়া বর্তমানে ১৪ থেকে ১৬ হাজার টাকা। ইংরেজি বছর শেষ হওয়ার সাথে সাথে বাড়িওয়ালারাও বাড়িয়ে দেন তাদের বাসার ভাড়া। লাগামহীনভাবে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধিতে প্রতিনিয়ত ভোগান্তি পোহাচ্ছেন রাজধানী ঢাকা শহরের ভাড়াটিয়ারা। নি¤œবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যবিত্ত সবাই বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির কাছে অসহায়। মাসে মাসে মোটা অংকের বাড়ি ভাড়া গুনতে গুনতে দিশেহারা হয়ে পড়েন ভাড়াটিয়ারা। চাকুরিজীবিদের বেতনের সিংহভাগই ব্যয় হয়ে যায় বাড়ি ভাড়া খ্যাতে। বাড়ি ভাড়া দিয়ে যে টাকা থাকে, তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছে অনেকেই। আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে দুই রুমের একটি বাসায় মাত্র তিন হাজার টাকায় ভাড়া ওঠেন এক চাকুরিজীবি। শুরুতে দুই রুমের ওই বাসার ভাড়া ছিল তিন হাজার টাকা থাকেলেও এখন ওই বাসার গুণতে হচ্ছে মাসে সাড়ে ৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ গত ১০ বছরে এই বাসার ভাড়া বেড়েছে ১৯৭ শতাংশ। দীর্ঘদিন ধরে সেই একই বাড়িতে আছেন তিনি। বাড়ির মালিকও পরিচিত, সম্পর্কও ভালো। তাই অন্যত্র চলে যায়নি। কিন্তু প্রতিবছরই জানুয়ারি মাসে ভাড়া বেড়েছে। তবে করোনার কারণে এবার (২০২১) ভাড়া বাড়েনি। শুধু এই বাসায় নয়, রাজধানীর সব বাসারই ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা শহরজুড়েই গত কয়েক বছরে এভাবে বাড়িভাড়া বেড়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জরিপ অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল এই সময়ের মধ্যে ঢাকায় দুই রুমের পাকা বাসার ভাড়া ১১৮ শতাংশ, আধাপাকা (টিন শেডের) বাসা ভাড়া ৯৫ শতাংশ, মেস বাড়ির ভাড়া ১০২ শতাংশ এবং বস্তিতে ভাড়া বেড়েছে ১৭৪ শতাংশ।
এদিকে, ছোট এই ঢাকা শহরে দুই কোটির ওপরে মানুষের বসবাস। এর মধ্যে কত সংখ্যক মানুষ ভাড়া বাসায় থাকেন এবং কত সংখ্যক মানুষ নিজস্ব বাড়িতে থাকেন, সে সংক্রান্ত কোনো জরিপ কারো কাছে নেই। তবে ধারণা করা হয়, ঢাকায় বসবাসকারীদের ৮০ শতাংশের ওপরে ভাড়াটিয়া।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৫টি ওয়ার্ডে দুই লাখ ৫১ হাজার ৩০২টি হোল্ডিং (আবাসিক এবং বাণিজ্যক) রয়েছে। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪টি ওয়ার্ডে হোল্ডিং রয়েছে তিন লাখ ৩৮ হাজার। সে হিসাবে দুই সিটিতে হোল্ডিং আছে পাঁচ লাখ ৮৯ হাজার।
ঢাকা শহরে ভাড়াটিয়ার সংখ্য কত- তার তথ্য না থাকলেও ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে দুই কক্ষের পাকা বাসার গড় ভাড়া ছিল ১১ হাজার ৩০০ টাকা। বছর বছর বেড়ে ২০১৯ সালে তা ২৪ হাজার ৫৯০ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ এই সময়ে পাকা বাসার গড় ভাড়া বেড়েছে ১৩ হাজার ২৯০ টাকা। আধাপাকা (টিন শেড) বাড়ির দুই কক্ষের ভাড়া ২০১০ সালে ছিল ৬ হাজার ৮০০ টাকা, যা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১৯ সালে ১৩ হাজার ২০০ টাকা হয়েছে।
একইভাবে বেড়েছে মেস ও বস্তির বাড়ি ভাড়া। ২০১০ সালে দুই কক্ষের মেসের গড় ভাড়া ছিল ১১ হাজার ৫০০ টাকা, যা বেড়ে ২০১৯ সালে হয় ২৩ হাজার ২০০ টাকা। এ হিসাবে গড়ে মেসভাড়া বেড়েছে ১১ হাজার ৭০০ টাকা। আর ২০১০ সালে বস্তির দুই কক্ষের ভাড়া ছিল তিন হাজার ৯০০ টাকা, যা বছর বছর বেড়ে ২০১৯ সালে হয় ১০ হাজার ৭০০ টাকা। অর্থাৎ বস্তির দুই কক্ষের গড় ভাড়া বেড়েছে ছয় হাজার ৮০০ টাকা।
এ থেকে দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক বছরে ঢাকার সব শ্রেণির বাড়ি ভাড়া বেড়েছে। তবে অন্যদের তুলনায় নি¤œ আয়ের মানুষ বা যারা টিনশেড বাড়িতে ভাড়া থাকেন তাদের ওপর চাপ বেশি পড়েছে। কারণ গত কয়েক বছরে ঢাকার টিনশেড বাড়ির ভাড়া বেড়েছে সবথেকে বেশি।
এ ব্যাপারে ভারাটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, গত ১০ বছরে বাসা ভাড়া বেড়েছে অনেক। ঢাকা শহরের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষই ভাড়া থাকে। প্রতি বছরের প্রথম মাসে বাড়িওয়ালারা ভাড়া বৃদ্ধির একটি অলিখিত নিয়ম চালু করেছেন। বছরের জানুয়ারি মাস থেকে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ পৌঁছে যায় ভাড়াটিয়াদের কাছে। গত দশ বছরে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে বাসা ভাড়া। এলাকাভিত্তিক একেক বাসার ধরন অনুযায়ী প্রতি বছর বছর বাসা ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়। এমনো আছে যে, কিছু কিছু বাসায় বছরে একাধিকবারও বাসার ভাড়া বাড়িয়েছে বাড়িওলা।
তিনি আরো বলেন, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির জন্য মনগড়া কারণ দেখিয়ে থাকেন বাড়িওয়ালারা। বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়; সার্ভিস চার্জ; বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল বৃদ্ধি; লিফটের চার্জ; জেনারেটরের তেলের দাম বৃদ্ধি; সিঁড়ি মোছার জন্য বুয়ার বেতন; দারোয়ানের বেতন ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে বাড়িওয়ালারা বাসার ভাড়া বৃদ্ধি করেন।
এদিকে রাজধানীর মিরপুরের একটি বাড়ির ৬তলায় ভাড়া থাকেন বোরহান। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে দুই রুমের বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম ৮ হাজার টাকায়। বর্তমানে এই বাসার ভাড়া দিতে হয় ১৩ হাজার ৫০০ টাকা।
ধানমন্ডির রুবেল বলেন, ২০১৪ সালে জিগাতলায় দুই রুমের এই বাসাটি ভাড়া নিয়েছিলাম ১৩ হাজার টাকায়। বর্তমানে এই বাসার ভাড়া দিতে হয় ১৮ হাজার ৮০০ টাকা।
রাজধানীর জিগাতলার এক ব্যাংকার তারেক হাসান বলেন, আমি এই বাসায় আছি ২০১২ সাল থেকে। তিন রুমের এই বাসাটি আমি তখন ভাড়া নিয়েছিলাম ১৬ হাজার টাকায়। স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে এখনো এই বাসায় আছি। কিন্তু বর্তমানে এই বাসার ভাড়া দিতে হয় ২৫ হাজার টাকা।
একাধিক ভাড়াটিয়ারা অভিযোগ করে বলেছেন, আমরা চাকরি করে যা বেতন পায় তার সিংভাগই দিতে হয় বাসা ভাড়া। এইভাবে বাসা ভাড়া বাড়তে থাকলে বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়বে।