বিশেষ প্রতিবেদক : বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড—দেশের জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই বছর ধরে গড়ে উঠেছে কথিত এক তেল পাচার ও দুর্নীতির সিন্ডিকেট, যা এখন “অঘোষিত সাম্রাজ্যে” রূপ নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে তিনজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও এক শ্রমিকনেতার নেতৃত্বেই এই সিন্ডিকেট বছরের পর বছর ধরে সক্রিয়। এদের মধ্যে অন্যতম একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, একজন ডিপো ইনচার্জ, ও একজন শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা—যাদের বিরুদ্ধে কোটি টাকার তেল চুরি, পদোন্নতিতে বাণিজ্য, অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের একের পর এক অভিযোগ জমেছে।
ফতুল্লা ডিপোর ডিজেল রহস্য : সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ডিপো থেকে প্রায় পৌনে চার লাখ লিটার ডিজেল নিখোঁজের ঘটনায় জ্বালানি খাতে তোলপাড় শুরু হয়। একাধিক তদন্ত কমিটি গঠনের পরও রিপোর্ট জমা না পড়ায় সন্দেহের তীর ঘুরছে অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেটের দিকে।

অভিযোগ রয়েছে, একজন প্রভাবশালী ডিপো ইনচার্জ এই ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। বরখাস্ত হওয়ার কথা থাকলেও, তদন্ত চলাকালেই তাকে উল্টো পদোন্নতি দেওয়া হয়—যা প্রতিষ্ঠানজুড়ে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

ক্ষমতার শীর্ষে এক জেনারেল ম্যানেজার : যমুনা অয়েল কোম্পানির অভ্যন্তরীণ সূত্র দাবি করেছে, মানবসম্পদ বিভাগের এক জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) বছরের পর বছর ধরে পুরো প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রেখেছেন। তিনি নাকি নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি—সবকিছুতেই একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।
অভিযোগ রয়েছে, পদোন্নতির বিনিময়ে অর্থ লেনদেন, অনুপস্থিত কর্মচারীদের হাজিরা “দেখানো”, এবং রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠদের প্রভাব খাটিয়ে দায়িত্ব বণ্টন—এসব অনিয়ম তার অধীনে নিয়মে পরিণত হয়েছে।
তদন্ত সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে যমুনা অয়েলের অভ্যন্তরীণ এক অনুসন্ধানে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ তহবিলের কোটি টাকার অনিয়মের প্রমাণ মেলে। তদন্ত কমিটি তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করলেও, সেই ব্যবস্থা হয়নি; বরং তিনি আরও শক্তিশালী পদে উন্নীত হন।
তহবিল কেলেঙ্কারি ও শেয়ার বাজারে লোকসান : ২০১৬ সালের তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়—শ্রমিক অংশগ্রহণ ও কল্যাণ তহবিলের অর্থ ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে প্রায় ৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। তদন্তে উঠে আসে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা অমান্য করে।
একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে গঠিত তদন্ত কমিটি বলেছিল, “এটি শ্রম আইনবিরোধী সিদ্ধান্ত এবং ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা দায় এড়াতে পারেন না।” তবে এখনো পর্যন্ত কেউ দায় স্বীকার করেননি, বরং জড়িত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
“অঘোষিত সম্রাট” শ্রমিক নেতা : দীর্ঘদিনের কর্মচারী ও বর্তমান শ্রমিক ইউনিয়নের এক প্রভাবশালী নেতার নাম ঘুরে ফিরে আসছে যমুনা অয়েলকে ঘিরে নানা বিতর্কে।
সূত্র জানায়, তিনি তিন দশক ধরে একই পদে বহাল থেকে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ নীতি ও নিয়োগে “রাজনীতি” চালিয়ে আসছেন। দুদকের অনুসন্ধানেও তার নামে প্রাথমিকভাবে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের প্রমাণ মেলার কথা জানা গেছে।
ব্যাংক হিসাবেও অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পেয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেই অ্যাকাউন্টকে “সন্দেহজনক লেনদেন (STR)” হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
অভিযোগ আছে, এই নেতা নিজের প্রভাব খাটিয়ে আত্মীয়-স্বজনসহ দুই ডজনের বেশি মানুষকে কোম্পানির বিভিন্ন ডিপো ও অফিসে নিয়োগ করিয়েছেন। এমনকি একাধিকবার তেল চুরির ঘটনায় সরাসরি আত্মীয়দের নাম জড়ালেও, কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
চাকরি-বাণিজ্য ও অর্থ আত্মসাৎ : যমুনা অয়েলের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, চাকরি দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ওই শ্রমিক নেতার বিরুদ্ধে। এক ঠিকাদারী শ্রমিক তার বিরুদ্ধে থানায় জিডিও করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে “চাপের মুখে” অভিযোগ তুলে নিতে বাধ্য হন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া ওয়েলফেয়ার ফান্ডের প্রায় ১২ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনাতেও তার নাম উঠে আসে। বিভিন্ন কর্মচারীর বেতন থেকে টাকা কেটে নেওয়া হলেও, সেই অর্থ এখনো ফেরত দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ।
দুদকের নজরদারিতে যমুনা অয়েল : দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতিমধ্যে যমুনা অয়েল কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা ও শ্রমিক নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে।
চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কয়েকজন কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদ ও তেল পাচার সংক্রান্ত লেনদেনের বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, প্রাথমিক অনুসন্ধানে কিছু কর্মকর্তার সম্পদের উৎস ও ব্যাংক লেনদেন “অসামঞ্জস্যপূর্ণ” পাওয়া গেছে, যা নিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান চলছে।
পটপরিবর্তনের পরও “অপরিবর্তিত” সিন্ডিকেট : ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও যমুনা অয়েল কোম্পানিতে একই চক্রের প্রভাব অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ।
নতুন প্রশাসনের আগমনের পরও পদোন্নতি, বদলি ও নিয়োগ—সবকিছু একই রকমভাবে চলছে। শ্রমিক ইউনিয়নের একাংশের দাবি, “যত দিন পর্যন্ত এই তিনজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার দখল থেকে যমুনা অয়েল মুক্ত না হবে, তত দিন পর্যন্ত সরকারি জ্বালানি খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে না।”
উপসংহার : একসময় দেশের গর্ব ছিল যমুনা অয়েল কোম্পানি—আজ সেখানে অভিযোগ, দুর্নীতি ও ক্ষমতার খেলা।
দুদকের চলমান তদন্তে যদি এসব অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়, তবে জ্বালানি খাতে এটি হবে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি।
দেশের কোটি কোটি টাকার জ্বালানি নিরাপত্তা এখন প্রশ্নের মুখে—আর সাধারণ মানুষ জানতে চায়, এই “তিন মাফিয়ার” রাজত্বের অবসান কখন হবে?