শেখ রাসেল আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠল, “আমি মায়ের কাছে যাব!”

এইমাত্র জাতীয়

পড়ুন পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃন্যতম হত্যাকান্ড বঙ্গবন্ধু হত্যার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা


বিজ্ঞাপন

আমিনুর রহমান বাদশা : তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবকটা হায়না হেসে দিল সাথেসাথেই। বঙ্গবন্ধুকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে একদম শুরুতেই। সিঁড়ির কাছটায় পড়ে আছেন তিনি। তাজা রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে শেষ ধাপে গিয়ে জমাট বেঁধে গেছে। নিচতলায় শেখ কামালের লাশ, বাকিদের নিথর দেহ পড়ে আছে সিড়ি ফেলে দোতলার রুমে রুমে। মেঝেতে রক্তের স্রোত, দেয়ালে থ্যাঁতলানো মগজের টুকরা। রাসেলকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল মায়ের কাছে। রক্তে লাল ঘরটাতে ঢুকে প্রথমেই দেখলো ভাইয়া শেখ জামাল আর ভাবী রোজী জামালের ঝাঁঝরা হওয়া লাশ। মাত্র একমাস আগেই বিয়ে হয়েছিলো রোজীর। চেহারাটা ছিলো খুব মিষ্টি, তাই বঙ্গবন্ধু ঠিক করে রেখেছিলেন ছোটোবোন খাদেজার আদরের মেয়েটাকেই পুত্রবধূ করে ঘরে আনবেন৷ রোজী নামটাও তাঁরই দেয়া। গোলাপের মত সুন্দর বলেই রোজী। সামনেই কলেজে ইন্টার পরীক্ষায় বসার কথা ছিলো লাজুক আঠারো বছরের মেয়েটার। অথচ তার আগেই বুকটা ঝাঁঝড়া করে দেয়া হলো তার। স্বামীর সামনেই যখন লুটিয়ে পড়লো সে, তখনও হাতে মেহেদির রঙ মুছে নি। সুলতানা কামাল ছিলেন শেখ কামালের ভালোবেসে বিয়ে করা স্ত্রী। পড়াশোনার পাশাপাশি স্পোর্টসেও ভালো ছিলেন সুলতানা। আর ছিলেন ভীষণ তেজী। বঙ্গবন্ধুর ছেলে হয়েও সাহসী অথচ লাজুক শেখ কামাল তাই যথেষ্ট সময় নিয়েছিলেন প্রপোজ করতে। খুব মিষ্টি একটা সম্পর্ক, সেখান থেকেই বিয়ে। এই নিষ্পাপ মেয়েটিকেও বন্দুকের নলে থামিয়ে দেয়া হল। মাথার খুলি ভেঙে ছিটকে পড়ে মগজ। স্বামী শেখ কামালকে অবশ্য আগেই নিভিয়ে দেয়া হয়েছে নিচতলায়। রাসেল অবশ্য দেখছিল তার মাকে। তার আদরের মা, স্নেহে ভরা অথচ মিষ্টিমধুর বকা দেয়া মা পড়ে আছেন নিথর দেহে। সাইকেল চালাতে চালাতে বেশি দূরে চলে যেত বলে বারান্দা থেকে চোখ পেতে রাখতেন মা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। দুরন্ত ছোট্ট ছেলেকে একা হাতেই দেখাশোনা করতেন তিনি। পাশাপাশি সামলাতেন সংসার। বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন আদর্শ জীবনসঙ্গিনী হয়ে। সিঁড়িতে যখন দেখলেন অনাদরে অযতনে পড়ে আছে আজীবনের ভালোবাসার মানুষটির লাশ, প্রিয় মুজিবের লাশ, তখন আর বিন্দুমাত্র সময় নেননি সিদ্ধান্ত নেওয়ার। চিৎকার করে বললেন, “আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেল!” স্বামীর সাথেই সহমরণে গেলেন বীরবেশে। পুত্র শেখ জামাল ও দুই পুত্রবধূর সাথে এক রুমে এনে মেরে ফেলা হলো তাঁকে নির্মমভাবে। আসলে ‘নির্মম’ বিশেষণটাও এখানে খাটবে বলে মনে হয়না। বাংলা ডিকশনারির কোন বিশেষণটা সবচেয়ে নির্দয় নির্মম তা আমারও জানা নেই। রাসেল আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। ছোট্ট শিশুটার এতটুকু প্রাণটা তখন কিভাবে যে ছটফট করছিলো ভাবতে পারিনা। চাইওনা। রক্তের গঙ্গায় ডুবে থাকা মা, ভাই, ভাবীদের লাশ দেখে কি বিষম কান্নাই যে বুক ভেঙে এসেছিলো তার। সবকিছু ছিঁড়েখুঁড়ে বেরিয়ে আসা একটা হাহাকার যেন! ডুকরে উঠে, জলভেজা চোখে অবশেষে সে বলে উঠলো, “আমাকে হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দিন!” প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবদার করে ‘হাসু বুবু’ বা ‘হাসু আপা’ ডাকত রাসেল! শেষ আশ্রয় হিসাবে তাই বোনকেই আগলে ধরতে চেয়েছিল সদ্য মা হারা শিশু! না, হাসু আপার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি তাকে। বরং পরপর সীসার বুলেটে তার চোখ খুবলে বাইরে ছিটকে এল,মাথার খুলি দেয়া হলো থেঁতলে। মগজ ছিটকে পড়েছিল বাথরুমের দেয়ালে। এমনই নৃশংস, এতটাই ভয়াবহ যে বুলেটও হয়ত লজ্জা পেয়েছিলো এই নিষ্পাপ শিশুটাকে ঝাঁঝরা করতে গিয়ে। যারা এই ছোট্ট শিশুটাকে এভাবে যন্ত্রণা দিয়ে মারলো, তার বুকফাটা আর্তনাদ নিয়ে করলো তামাশা, দশ বছরের বাচ্চার লাল রক্তে হাত রাঙালো – তাদের জন্য কীসের ক্ষমা? কীসের মানবতা? বঙ্গবন্ধুকে খুব বেশি কাছে পায়নি সে। সংগ্রামের শেষ দিন গুলোতে বেশিরভাগ সময়ই জেলে রাজবন্দী থাকতেন বঙ্গবন্ধু। পনেরো দিন অন্তর অন্তর দেখা করার সুযোগ থাকত। রাসেল মা বা দিদির সাথে দেখা করতে এলেই বাবার কাছে কান্নামুখে বায়না ধরতো “বাবা বাড়ি চলো।” এই আকুতিতে বুক ফেটে যেতো পিতার। ছোট্ট শিশুকে প্রবোধ দিতেন, “তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো শেষতক তাও যা বাবাকে কাছে পেল, আগস্টের গোখরো সাপেরা কেড়ে নিলো সবকিছু! নোবেলজয়ী দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেলের নামে নাম রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু, “শেখ রাসেল।” মৃত্যুকালে যার বয়স হয়েছিল মাত্র দশ বছর আট মাস। একাত্তরের সেই গোখরো সাপেরা তাদের ধুয়েমুছে যাওয়া নোংরা আইডিওলজি, তাদের লজ্জাজনক হার স্বীকার করতে পারেনি। যার ফলশ্রুতিতে এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড। খন্দকার মোশতাক, যাকে নিজের আপন ভাই ভাবতেন বঙ্গবন্ধু। সেই মোশতাকের বিশ্বাসঘাতকতাই তাঁকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরপরই ক্ষমতা দখল করলো মোশতাক। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বন্ধ করলো বঙ্গবন্ধু খুনের বিচারের যেকোনো সুযোগ। তাঁর খুনীদের উপাধি দেওয়া হলো ন্যাশনাল হিরো। ধূর্ত আমেরিকার পাশাপাশি চীন ও সৌদির বড় একটা সাপোর্ট ছিলো তার পিছনে। যারা কখনো বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়নি, সেই চীন ও সৌদি আরব এবার যেন হুমড়ি খেয়ে পড়লো, সৌদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল ১৬ই আগস্ট। ঠিক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরপরই। চীন, ৩১শে আগস্ট।
পথের সবচেয়ে বড়ো কাঁটাটি দূর হয়ে গিয়েছিলো তাদের। যদিও তখনো বঙ্গবন্ধুর চতুরঙ্গ জাতীয় চার নেতা যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন। সুতরাং তাঁদেরও সরানোর ব্যবস্থা হলো। ৩রা নভেম্বর, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনুষ্ঠিত হল আরেক ঘৃণ্য নরহত্যা। লোহার শিকের ওপার থেকেই বেয়নেট দিয়েই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, রাইফেল তাক করে চিড়িয়াখানার প্রাণীর মতই অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে মেরে ফেলা হল জাতীয় চার নেতাকে। ঝরে গেলেন মুজিবের আদরের তাজউদ্দীন, নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, মনসুর আলীরা।মোশতাকের ক্ষমতা বেশিদিন টিকেনি। একের পর এক বিশ্বাসঘাতক তার জায়গা নিয়েছে।
বজলুল হুদা, সৈয়দ ফারুক হয়ে সদ্য ফাঁসিতে ঝোলা আবদুল মাজেদ সহ অনেকেরই বিচার হয়েছে। কিন্তু এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে অনেকে।


বিজ্ঞাপন