মিরপুরের চলন্তিকা ঝিলপাড় বস্তি
বিশেষ প্রতিবেদক : রাজধানীর রূপনগর ঝিলপাড় বস্তিতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির অবৈধ সংযোগের পর এবার বেরিয়ে এসেছে ইয়াবা সিন্ডিকেট ও কিশোর গ্যাং গ্রুপের তথ্য। ইয়াবা সিন্ডিকেট চালানোর পাশাপাশি কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের দিয়ে অন্যদের মারধর ও জোর-জবরদস্তি করানো হতো এই বস্তিতে। এর মূলে ছিলেন যুবলীগের রূপনগর থানা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক পরিচয়ধারী রহিম শিকদার, যুবলীগ নেতা শামসু, সোহেল রানা ও হাজেরা নামে এক নারী।
সম্প্রতি মিরপুর ৭ নম্বর সেকশনের এই বস্তিতে আগুন লাগলে বস্তির সব ঘর পুড়ে যায়। ঘর হারিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আশপাশের স্কুলগুলোতে আশ্রয় হয় বস্তিবাসীর। ঝিলপাড় বস্তি হিসেবে পরিচিত এই বস্তিটিও উঠে আসে আলোচনায়। বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় বিভিন্ন অনিয়ম-অভিযোগের কথা। জানা যায়, বস্তিতে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিত একটি চক্র। বস্তির জায়গা ‘দখল’ নিয়ে এখন নতুন করে তৈরি হয়েছে দ্বন্দ্বও। জানা গেছে মাদক কারবার আর কিশোর গ্যাংয়ের সব তথ্যও।
ঝিলপাড় বস্তিতে বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে পুরো ঝিলপাড় বস্তিতে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করতেন নজরুল ইসলাম ওরফে নজু সরদার। তার ওপর কথা বলার মতো কেউ ছিলেন না। তিনি ছিলেন দেশের ‘শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী’দের একজন। ২০১৮ সালের ২৮ মে দিবাগত রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান নজু সরদার।
ইয়াবা সম্রাট নজু সরদারের মৃত্যুর পর ঝিলপাড় বস্তির ‘মাদক সাম্রাজ্যে’র দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী হাজেরা বেগম। আর তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন আরামবাগ বস্তির অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ লাইনের টাকা উত্তোলনকারী ও যুবলীগ নেতা পরিচয়ধারী রহিম শিকদার, চলন্তিকা অংশের টাকা উত্তোলনকারী শামসু ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা সোহেল রানা।
জোসনা বেগম নামে এক নারী ২১ বছর ধরে ওই বস্তিতে বাস করছেন। তিনি বলেন, হাজেরা বেগম এখন ইয়াবা বিক্রি করেন। তার সঙ্গে শাশুড়ি সুফিয়া বেগম, নজুর দুই ভাই তোফা সরদার ও বাবুল সরদার, বোন লীলা ও শান্তি মাদক বিক্রিতে সহযোগিতা করেন। এমনকি তারা নিজেরাও মাদক কারবার করে থাকেন। তাদের অনেক ক্ষমতা। সামান্য কিছু হলেই কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের দিয়ে প্রতিপক্ষকে মারধর করা হয়।
ইয়াবা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে রহিম শিকদার বলেন, বস্তির কোথাও মাদক বিক্রি হয় না বলেই জানি। অন্য কেউ করে কি না, তা জানি না। মাদকের সঙ্গে নিজের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলেও জানান তিনি।
হাজেরা বেগমের স্বামী নজুর মাদক ব্যবসার মাসোহারা স্থানীয় কাউন্সিলর হাজী রজ্জব হোসেন এবং পুলিশ ও স্থানীয় রাজনীতিবিদরা নিতেন বলে জানা যায়। এর সুবাদে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বস্তিতে মাদকবিরোধী অভিযানে এলে সেই খবর আগেভাগেই নজুকে জানিয়ে দিতেন কাউন্সিলর।
রবিউল ইসলাম নামে স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন, ২০১৬ সালেও একবার নজুকে ধরতে র্যাব-৪ রূপনগরের ওই বস্তিতে অভিযান চালায়। তখন নজুর মা, স্ত্রী ও বোনরা বস্তির ভেতরে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নজুকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। হাজেরা বেগম এখনো সেই কাজই করে চলেছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, বস্তিতে মাদক নিয়ে কথা কাটাকাটি হলেই কাউন্সিলর রজ্জব হোসেনের কাছে চলে যান হাজেরা বেগম। এর কিছুক্ষণ পর কিশোর গ্যাং গ্রুপের (যাদের বয়স ১৪ থেকে ১৬ বছর) কয়েকটি দল এসে হাজির হয়। এক গ্রুপ দাঁড়িয়ে থাকে, আরেক গ্রুপ প্রতিপক্ষকে মারধর করে। এমনকি প্রতিপক্ষের দোকানপাট বা ঘরের আসবাবপত্রও ভাঙচুর করা হয়।
হালিমা বেগম দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে থাকেন চলন্তিকা বস্তিতে। ছেলে নাহিদ অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। আগুন লাগার আগে নাহিদের সঙ্গে হাজেরার সামান্য বিষয়ে কথা কাটাকাটি হয়। এ জন্য কিশোর গ্যাং গ্রুপকে ডেকে নাহিদকে মারধর করেন বলে অভিযোগ করেন হালিমা। কাউন্সিলরের কাছে নাহিদের মা-বোন বিচার দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি বলে জানান জোবায়দা নামে বস্তির আরেক বাসিন্দা।
বঙ্গবন্ধু বিদ্যা নিকেতনের বিপরীত পাশের রাশেদুল নামে একজন ব্যবসায়ী বলেন, যুবলীগ নেতা সোহেল রানা অফিস দিয়ে বসেছেন। ওই অফিসেই বসে কিশোর গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করেন। কেউ চাঁদা না দিলে তার পেছনে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের লাগিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সোহেল রানার হাতে।
রাসেল শিকদার নামে আরামবাগ আবাসিক এলাকার একজন বাসিন্দা বলেন, বস্তিতে অন্তত ২০টির মতো গ্রুপ রয়েছে। কিশোর গ্রুপ, ইয়াং গ্রুপ, পাংখা গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয়। একেক নেতা একেক গ্রুপকে নেতৃত্ব দেন। তাদেরকে দিয়েই মিছিল-মিটিং করানো হয়। আবার দরকার পড়লে হামলাও চালানো হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুবলীগ নেতা সোহেল রানা বলেন, বস্তিতে কোনো কিশোর গ্যাং গ্রুপ নেই। আমি কাউকে নিয়ন্ত্রণও করি না। অফিসে বসেই মাঝে মধ্যে এলাকার ছোট-খাটো সমস্যার সমাধান করি।
মাদক বিক্রির বিষয়ে তিনি বলেন, ইয়াবা কেন, কোনো মাদকই এখানে বিক্রি করা হয় না। যারা আমার নাম বলেছে, তারা ভুল বলেছে। তারা শত্রুতা থেকেও আমার নাম বলতে পারে। আগুন লাগার দিন থেকেই এই অফিস থেকে অসহায় বস্তিবাসীদের সবরকমের সহযোগিতা করা হচ্ছে। সেটা হয়তো অনেকের সহ্য হচ্ছে না।
ঝিলপাড় বস্তিতে ইয়াবা সিন্ডিকেট ও কিশোর গ্যাং গ্রুপের বিষয়ে জানতে চাইলে রূপনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাদক বিক্রি বন্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বস্তিতে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। যাদের নামে মামলা ছিল, তাদের বেশিরভাগই জেলে রয়েছেন। দুয়েকজন জামিনে বের হলেও তাদের ওপর নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। নজু সরদার ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী হাজেরা বেগম এখন মাদক ব্যবসা করেন না বলেই জানি।
ওসি আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, রহিম শিকদারের বিরুদ্ধে জবরদখল, সরকারি কাজে বাধা দেওয়াসহ বেশ কয়েকটি মামলা থাকলেও মাদকের কোনো মামলা নেই।