*রোহিঙ্গাদের মোবাইলসেবা বন্ধের নির্দেশ
*পুনর্বাসনে নতুন রূপে সেজেছে ভাসানচর
বিশেষ প্রতিবেদক : দেশি-বিদেশি এনজিও সংস্থার নিয়ন্ত্রণহীন কর্মকা-ে কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মোবাইলসেবা বন্ধের জন্য মোবাইল ফোন অপারেটরদের নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অনেক এনজিও রোহিঙ্গাদের উস্কানি দেয়ায় তাদের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো আবারো সক্রিয় হয়ে উঠছে। রাতের অন্ধকারে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা ক্যাম্প পাহারা দেয়ার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। জমি নিড়ানোর নামে রোহিঙ্গাদের কাছে ধারালো অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগে কক্সবাজারের এনজিও সংস্থা মুক্তি’র কার্যক্রম বন্ধ করার পাশাপাশি আরো ৪১টি সংস্থাকে নজরদারির মধ্যে আনা হয়েছে।
গত ২২ আগস্ট প্রত্যাবসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়ার পর ২৫ আগস্ট বিশাল সমাবেশের মাধ্যমে শোডাউন করে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। এরমধ্যে উখিয়ার কামারশালা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জব্দ করে বিপুল পরিমাণ বটি ও দার মতো ধারালো অস্ত্র। এগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য বানানোর অর্ডার দিয়েছিলো এনজিও মুক্তি। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিও সংস্থার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের কাছে নানাভাবে অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু এবারই তার প্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
কক্সবাজার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, কিছু কিছু এনজিওদের কার্যক্রম সন্দেহজনক ও প্রশ্নবোধক। প্রত্যাবাসন না করে এ বিষয়ে তারা উৎসাহিত করছে, এ নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
আইন মেনে রোহিঙ্গাদের জন্য নিড়ানি তৈরি করা হচ্ছিলো বলে মুক্তির পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও জেলা প্রশাসক তা মানতে নারাজ। কক্সবাজারে মুক্তির প্রধান নির্বাহী বিমল চন্দ্র দে সরকার বলেন, জেলা প্রশাসক মহোদয় এবং আর আর সি মহোদয় সংশ্লিষ্ট অফিসার এবং সিআইসি তাদের এ নিয়ে অবগত করা হয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন জানান, মুক্তি এনজিও যে দেশীয় নিড়ানি অস্ত্র যেটা সরবরাহ করেছে তাদের অনুমতি নেয়ার ক্ষেত্রে এটা লিখা ছিল না। তাতে লিখা ছিল স্থানীয়দের জীবনমান উন্নয়নের জন্য উপকরণ দেয়া।
এদিকে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে পাকিস্তানি এনজিও- স্থানীয় এনজিও এবং জামায়াত নেতাদের মাধ্যমে কৌশলে চালাচ্ছে তাদের কার্যক্রম। আর রোহিঙ্গাদের মধ্যে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা শঙ্কিত।
স্থানীয়রা জানান, কোনো না কোনোভাবে ক্যাস্পে অস্ত্র ঢুকে পড়ছে। মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক এনজিও এ ধরনের লোক নিয়োগ দিচ্ছে। এর মধ্যে জামাত-শিবির বেশি।
৬১টি এনজিও কিন্তু প্রত্যাবাসন বিবৃতি দিয়েছিল, প্রত্যাবাসনের তিনদিন আগে বলে জানান তারা।
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহামুদুল হক চৌধুরী বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে আমরা শঙ্কিত। যেভাবে এনজিওগুলো তাদের সক্রিয় করে তুলছে।
এনজিওগুলোকে সরাসরি এনজিও ব্যুরো দেখভাল করে তাই তাদের নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো ভূমিকা রাখা যাচ্ছে না বলে জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম।
তিনি বলেন, এখানে কিন্তু এনজিওদের অনুমতি আমরা দেই না, তাদের কাজ করার অনুমতি দিয়ে থাকে এনজিও ব্যুরো। যারা অনুমতি পাচ্ছে তাদের শুধু কাজ করার জন্য সহযোগিতা করা হয়।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ৩৪টি ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের বসবাস। এসব ক্যাম্পে কাজ করছে দেশি-বিদেশি ১৩৯টি এনজিও।
রোহিঙ্গাদের মোবাইলসেবা বন্ধের নির্দেশ : বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মোবাইলসেবা বন্ধের জন্য মোবাইল ফোন অপারেটরদের নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের নির্দেশের পর বিটিআরসি এ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে সোমবার মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
বিটিআরসির নির্দেশনার চিঠিতে অপারেটরদের বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও গুরুত্ব বিবেচনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনসুরক্ষার স্বার্থে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যাতে মোবাইল সুবিধাদি না পায় এ বিষয়টি নিশ্চিতের জন্য আপনাদের সংস্থাসমূহকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কমিশন থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনকারী কমিটি থেকে এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ব্যাপক হারে সিম/রিম ব্যবহার-সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া গেছে।
আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কোনো ধরনের সিম বিক্রি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সিম ব্যবহার বন্ধ তথা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মোবাইল সুবিধাদি না দেয়া-সংক্রান্ত সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করে বিটিআরসিকে অবহিতকরণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয় চিঠিতে।
পুনর্বাসনে নতুন রূপে সেজেছে ভাসানচর : নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলীয় মেঘনার বুকে জেগে উঠা ভাসানচরকে নবরূপে সাজানো হয়েছে। সারি সারি ঘর, সাইক্লোন শেল্টার, অভ্যন্তরীণ সড়ক, লাইট হাউস, পানি সরবরাহ, খেলার মাঠ, পুকুর, মসজিদ, গার্ডেন, সোলার সিস্টেম ও বনায়ন দ্বীপটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এক সময়ের অখ্যাত ভাসানচর এখন বিশ্বে পরিচিত।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষে ভাসানচরকে সর্বক্ষেত্রে প্রস্তুত করা হয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে অখ্যাত চরটিকে আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। ভাসানচরের নয়নাভিরাম দৃশ্য যে কোনো পর্যটককে আকৃষ্ট করতে যথেষ্ট।
হাতিয়া উপজেলায় অবস্থিত ভাসানচরের দৈর্ঘ্য ১৪ কিলোমিটার প্রস্থ ১৫ কিলোমিটার। তবে প্রতি বছর এখানে নতুন নতুন চর জাগছে। প্রাথমিকভাবে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসনের লক্ষে বিগত এক বছর দৈনিক ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করে। এখানে ১৪৪০টি টিনশেড পাকা ঘর রয়েছে। প্রতিটি শেড এ ১৮টি কক্ষ রয়েছে। শেডের দুই পার্শ্বে রয়েছে বাথরুম ও কিচেন। প্রতি চার সদস্য বিশিষ্ট পরিবারকে ১টি করে রুম বরাদ্দ দেয়া হবে। প্রতিটি রুমে আছে দোতলা বিশিষ্ট ২টি বেড।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে ঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষাকল্পে ভাসানচরের চারদিকে ১৪ কিলোমিটার উঁচু বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া জলোচ্ছ্বাসের সময় নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে নির্মিত হয়েছে ৪ তলা বিশিষ্ট ১২০টি সাইক্লোন শেল্টার। এখানে ভরাটের পর মাটি থেকে ৪ ফুট উঁচুতে তৈরি হয়েছে ১৪৪০টি টিনশেড পাকা ঘর। এছাড়া রয়েছে আরো কিছু সুযোগ-সুবিধা। ভাসানচরে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহে গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। মাত্র এক বছরের মধ্যে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিশাল কর্মকান্ড সম্পন্ন হয়। ভাসানচরের উত্তর পার্শ্বে নৌ-চ্যানেল অতিক্রমকালে মালবাহী জাহাজ, কোস্টার ও লাইটার থেকে বাইনোকুলারে ভাসানচরের বর্তমান দৃশ্য দেখে জাহাজের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিস্ময় প্রকাশ করেন। দূর থেকে বাইনোকুলারে ভাসানচরকে লাল রংয়ে মোড়ানো দৃশ্যমান হয়।
এ প্রসঙ্গে নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনের এমপি আয়েশা ফেরদাউস জানান, ভাসানচরে শুধু ১ লাখ নয় বরং ১০ লাখ রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের পর্যাপ্ত ভূমি রয়েছে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য সর্বাত্মক সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে। তাদের কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প চালু করা হবে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলাসহ সার্বিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর লক্ষে বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম ও দাতাসংস্থা বাংলাদেশের উদ্যোগকে সমর্থন দিচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বন্ধুদেশ চীনের মধ্যস্থতায় আলোচনা চলছে। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে রোহিঙ্গারা নিজে জন্মভূতিতে ফিরে যাবে। এতে করে বাংলাদেশের জন্যও স্বস্তিদায়ক হবে। এক্ষেত্রে ভাসানচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন না হলে প্রায় ২৪শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে মেঘনার বুকে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন প্রকল্পটিকে পর্যটন শিল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যারা দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করেন তাদের কাছে ভাসানচর হবে আকর্ষণীয় স্থান। সিঙ্গাপুর কিংবা ব্যাংককের চাইতেও আকর্ষণীয় মেঘনার বুকে প্রকৃতির মাঝে গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্পে নতুন সংযোজন ভাসানচর।