বিআরটিসির দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মন্ত্রীর হুঁশিয়ারি
মহসীন আহমেদ স্বপন : বাসের ফ্লোর কাঠের তৈরি। হাতের আঙুল দিয়ে সামান্য চাপ দিলে আবার বেঁকে যায় সেই বাসের বডি! সম্প্রতি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন বিআরটিসি’র চাহিদা অনুযায়ী ভারত থেকে আনা বাসগুলোতে ধরা পড়েছে এমন ত্রুটি।
এদিকে দুর্নীতিতে জড়িত বিআরটিসির কর্মকর্তাদের রাখার প্রয়োজন নেই বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সোমবার দুপুরে রাজধানীর মতিঝিল বিআরটিসির কর্মকর্তা ও ডিপো ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে এ হুঁশিয়ারি দেন তিনি। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা যতই যোগ্য আর প্রভাবশালীই হোক না কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নতুন বিআরটিসির চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন সেতুমন্ত্রী। তিনি বলেন, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে বিআরটিসিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠান করার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে রূপ নেবে। যারা অনিয়ম, অপকর্ম করবে তারা যতই অভিজ্ঞ অফিসার হোক তাদের প্রয়োজন নেই।
সরকারি সংস্থাটির সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সদ্য সাবেক বিআরটিসি চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়াকে ভারতে নিয়ে ম্যানেজ করা হয়েছে। আর তার ফলেই স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী বাস চাওয়া হলেও ভারতীয় টাটা কোম্পানি এমন নিম্নমানের বাস ধরিয়ে দিয়েছে বিআরটিসিকে।
বিআরটিসির ডিপো ঘুরে অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারত থেকে কেনা বিআরটিসির ছয়শ বাসের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চারশ বাস চলে এসেছে দেশে। এর মধ্যে একতলা দুইশ এসি বাসের মধ্যে এসেছে ১২৯টি, বাকিগুলো আসার পথে। নন-এসি একতলা টাটা বাস এসেছে একশটি। এই বাসগুলোর ছাদ ফুটো হয়ে পানি পড়ছে। নতুন বাস এমন হওয়ার পর সরবরাহকারী কোম্পানিকে ডাকা হয়েছে। এখন আবার বাসগুলো নতুন করে মেরামত করতে বলা হচ্ছে ওই কোম্পানিকে।
বিআরটিসির দোতলা বাস কেনা হয় তিনশটি। এর মধ্যে এ পর্যন্ত এসেছে ১৬৮টি। সরেজমিনে দেখা যায়, এই বাসগুলোর বডিশিট অত্যন্ত নিম্নমানের। হাত দিয়ে চাপ দিলেই বাঁকা হয়ে যাচ্ছে সেই বাসের বডি। আরও জোরে ধাক্কা দিলে একেবারে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। বাসের বডি তৈরিতে নিম্নমানের শিট ব্যবহারের কারণেই এমনটা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিআরটিসি ডিপোর কারিগরি বিভাগের কর্মকর্তারা।
অনুসন্ধানে বাসের ওজনেও তারতম্য পাওয়া গেছে। ‘স্পেসিফিকেশন’ নথি ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশ চেয়েছিল ১৬ হাজার দুইশ কেজি ওজনের বাস। সেখানে দেশে আসা বাসগুলোর ওজন ১৫ হাজার কেজিরও নিচে।
শুধু বাসের বডি নয়, বাসগুলোর অন্যান্য স্পেসিফিকেশনেও ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ বিআরটিসি’র চালক ও কন্ডাক্টরদের। তারা বলছেন, এসি বাসগুলো প্রতি লিটার জ্বালানিতে তিন কিলোমিটার যাওয়ার কথা থাকলেও সেগুলোর মাইলেজ মাত্র ১ দশমিক ২ কিলোমিটার। এসব বাসের সামনের অংশে এসিও কম কাজ করছে। বাসের ভেতরে সিট বসানো নিয়েও ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি বাসের সিট ক্যাপাসিটি ৫১ হওয়ার কথা থাকলেও সিট বসানো হয়েছে ৪১টি। এতে যাত্রী পরিবহন কম হওয়ায় সরকারের রাজস্ব আয় কম হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিআরটিসি’র বাসচালকরা জানান, বাসগুলোর গতি ৯০ কিলোমিটারে উঠলেই ইঞ্জিন গরম হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া নন-এসি বাসের লাগেজ ক্যারিয়ার ত্রুটিযুক্ত। লং রুটে ঘণ্টায় ৭৫ কিলোমিটারের বেশি গতি ওঠানো যাচ্ছে না। বাসের ফ্লোর কাঠের তৈরি হওয়ায় কিছুদিনের মধ্যে ক্ষয় হতে শুরু করবে বলে আশঙ্কা তাদের।
জানা যায়, বিআরটিসি বাস ঠিকমতো তৈরি হচ্ছে কি না, তা দেখতে বহুবার ভারত সফরে গেছেন বিআরটিসির সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া। সেসব সফরে তিনি তার পছন্দমতো কিছু কর্মকর্তাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। সে সময় চেয়ারম্যানের সফরসঙ্গী বিআরটিসির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করে বলেন, বাসের এসব ত্রুটি তখন তাদের চোখেও ধরা পড়েছিল। কিন্তু চেয়ারম্যান ভারতীয় কোম্পানি থেকে কমিশন খেয়ে এসব নিয়ে কথা তোলেননি।
এ বিষয়ে বিআরটিসি চেয়ারম্যান এহছানে এলাহীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বাসের সিট চাহিদার তুলনায় কম দেওয়া ও স্পেসিফিকেশনের অন্যান্য ত্রুটির কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ভারতীয় বাস কোম্পানিকে ডাকা হয়েছে। দু’বছর এসব বাসের কোনো ত্রুটি ধরা পড়লে তারা মেরামতের বিষয়টি দেখবে।
স্পেসিফিকেশন না মেনে বাসের বডি শিট নিম্নমানের কেনÍ এ প্রশ্নের জবাবে সাবেক চেয়ারম্যান জানান, কয়েকটি বাসে এমন ত্রুটি ধরা পড়ার পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি বলা হয়। পরবর্তী বাসগুলোতে সিট সংখ্যা বাড়িয়েছে তারা। তবে বাংলাদেশ যে চাহিদা অনুযায়ী চেয়েছিল, তা দিতে পারেনি।
বিআরটিসি চেয়ারম্যান এহছান এলাহী বলেন, একতলা বাসগুলোর ছাদ ফুটো হওয়ার বিষয়টি নিয়ে টেকনিক্যাল কমিটি যে সিদ্ধান্ত দেবে, তার আলোকে ব্যবস্থা নেবে বিআরটিসি। ভারতীয় বাস কোম্পানি পুনরায় বাসগুলো মেরামত করে দেবে যেন ভবিষ্যতে আর ছাদ ফুটো হয়ে পানি না পড়ে। কয়েকটি বাস তারা এরই মধ্যে মেরামত করে দিয়েছে। সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। টেকনিক্যাল কমিটিতে বুয়েটের দু’জন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, তারা বিষয়টি দেখছেন।