আরো বাড়বে পেঁয়াজের দাম

অর্থনীতি এইমাত্র জাতীয় বানিজ্য রাজধানী সারাদেশ

পেঁয়াজ নেই, তবুও বিক্রির ঘোষণা টিসিবির!

এম এ স্বপন : হঠাৎ করেই অস্থির রাজধানী ঢাকার পেঁয়াজের বাজার। ৪ দিনের ব্যবধানে কেজি প্রতি দাম বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আড়তদাররা বলছেন, চলতি মৌসুমে প্রতিকূল আবহাওয়ায় উৎপাদন কম হওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী পেঁয়াজের আমদানি না হওয়ায় সাময়িক সংকট তৈরি হয়েছে। যদিও সরবরাহ স্বাভাবিক হলে আর দাম বাড়বে না বলে করছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে দফায় দফায় নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে অসন্তুষ্ট ক্রেতারা। সোমবার দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭৫ টাকায় আর ভারতীয় পেঁয়াজ ৬৫তে। ব্যবসায়ীদের দাবি, ভারত রপ্তানি মূল্য না কমালে দেশের বাজারে দাম আরো বাড়তে পারে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব বলছে সংকট সমাধানে অন্য দেশ থেকেও পেঁয়াজ আমদানি করা উচিত। বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে মনিটরিং জোড়দার করার পরামর্শ তাদের।
অন্যদিকে কেনা হয়নি পেঁয়াজ। সরকারের গোডাউনেও মজুত নেই। তারপরও ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ বিক্রির ঘোষণা দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর কোনো প্রস্তুতি না থাকায় খোলা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেনি ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।
ভারতের কয়েকটি রাজ্যে বন্যার কারণে পেঁয়াজ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিজেদের বাজার স্থিতিশীল রাখতে পেঁয়াজ রপ্তানি মূল্য প্রতি টনে ৩০০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৮৫২ ডলার নির্ধারণ করে দেশটি। এর প্রভাবে গত কয়েকদিনে হিলি বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি প্রায় বন্ধের পথে।
তিনগুন রাজস্ব মিটিয়ে পেঁয়াজ আমদানির প্রক্রিয়া শুরু না হতেই বাজারে বাড়তে শুরু করেছে এর দাম। রাজধানীর শ্যামবাজারের আড়ৎদাররা জানান, গত তিন দিনে পাইকারি বাজারে দর বেড়েছে ২০ টাকা। কারওয়ান বাজারের পাইকাররা পেঁয়াজ বিক্রি করছেন আরো ১০ টাকা বাড়তি দামে।
আমদানি ও পাইকারি পর্যায়ে দাম বৃদ্ধির প্রভাব ভালোভাবেই পড়েছে খুচরা বাজারে।
সংকট সমাধানে ভারতের পাশাপাশি চীন ও আফগানিস্তানসহ অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির পরামর্শ ক্যাব সভাপতির। সাধারণ ভোক্তাদের আশা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে পেঁয়াজের দাম সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসবে।
দামটা বেড়েছে মূলত পাইকারি বাজারে। আর পাইকারি বাজারসংলগ্ন খুচরা বাজারে তাৎক্ষণিকভাবে প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে যেসব খুচরা ব্যবসায়ী গত শনিবার পাইকারি বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনেছেন, তাঁরাও বাড়তি দামে বিক্রি করছেন। জানতে চাইলে পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী মো. আবদুল মাজেদ বলেন, এ বছর দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কম। এর মধ্যে ভারত ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করে দিল। এতে দেশের বাজারে ইতিমধ্যে প্রভাব পড়েছে। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার শ্যামবাজারে দেশি পেঁয়াজের কেজি ৪৩-৪৫ টাকা ছিল, যা গতকাল ৬০ টাকায় ওঠে। একইভাবে ৪২-৪৩ টাকা কেজির ভারতীয় পেঁয়াজ উঠেছে ৫৭-৫৮ টাকায়।
দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ও জোগানের কোনো সঠিক হিসাব নেই। ব্যবসায়ীদের ধারণা, প্রতিবছর চাহিদার ৬০-৭০ শতাংশ পেঁয়াজ দেশে উৎপাদিত হয়। বাকিটা আমদানি হয়। আমদানির প্রায় পুরোটাই আসে ভারত থেকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে আমদানি হয়েছে প্রায় ১০ লাখ ৯২ হাজার টন। ভারতের দ্য হিন্দুর এক খবরে বলা হয়, দেশটির রাজধানী দিল্লিতে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ৪০-৫০ রুপিতে উঠেছে। এ কারণে ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। দেশটির ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) গত শুক্রবার এ-সংক্রান্ত নির্দেশনাটি জারি করে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই রপ্তানি মূল্য বহাল থাকবে। রপ্তানি মূল্যের মানে হলো, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এখন থেকে টনপ্রতি ৮৫০ ডলারের কমে আর পেঁয়াজ রপ্তানি করতে পারবেন না। এই দরে আমদানি করলে বাংলাদেশে এফওবি (ফ্রেইট অন বোর্ড বা ভাড়া ছাড়া মূল্য) দাঁড়ায় কেজিপ্রতি প্রায় ৭২ টাকা। এর সঙ্গে কেজিতে ৫-৬ টাকা ভাড়া যুক্ত হবে। ঢাকার কারওয়ান বাজারের পাইকারি পেঁয়াজ বিক্রেতা মো. আলমগীর হোসেন বলেন, শুক্রবার দুপুরেই তিনি প্রতি পাঁচ কেজি দেশি পেঁয়াজ ২৪০ টাকায় (৪৮ টাকা কেজি) বিক্রি করেছেন। শনিবার দুপুরে তা ৩৩০ টাকায় (কেজিপ্রতি ৬৬ টাকা) ওঠে। তিনি বলেন, এ বছর মৌসুমের শেষ সময়ে বৃষ্টিতে পেঁয়াজ পচে গেছে। এ কারণে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কম।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকায় পেঁয়াজ অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। একটি মাঝারি পরিবারে মাসে গড়পড়তা পাঁচ কেজি পেঁয়াজ লাগে। কারওয়ান বাজারের পাইকারি দোকান থেকে গতকাল পেঁয়াজ কিনছিলেন জিয়াউর রহমান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাঁচ কেজি পেঁয়াজ কেনার ইচ্ছা ছিল তাঁর, কিন্তু দাম আরও বাড়ার আশঙ্কায় ১০ কেজি কিনে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ঈদুল আজহার আগে আগস্টের শুরুতে তিনি ১০ কেজি পেঁয়াজ কিনেছিলেন ৩৫০ টাকায়। এখন দাম পড়েছে দ্বিগুণের মতো।
ভারত নিজের বাজার অস্থির হলেই পেঁয়াজের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য ঠিক করে দেয়। ২০১৫ ও ২০১৭ সালেও তারা রপ্তানি মূল্য বেঁধে দিয়েছিল। অবশ্য বাংলাদেশে মৌসুমের সময় প্রচুর ভারতীয় পেঁয়াজ আসে। এতে কৃষকেরা দাম পান না বলে অভিযোগ। এ জন্য মৌসুমের সময় ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানিতে কিছু শুল্ক আরোপের দাবি উঠেছিল। যদিও তা সাড়া পায়নি। দেশে নতুন মৌসুম শুরু হবে আগামী ডিসেম্বরে। তখন আগাম পেঁয়াজ বাজারে আসবে। এর আগ পর্যন্ত আমদানির ওপরই নির্ভর করতে হবে।
এখন ভারতীয় পেঁয়াজ ছাড়া ভিন্ন উৎস আছে কি না, জানতে চাইলে আমদানিকারক আবদুল মাজেদ বলেন, সমস্যা হলো পাকিস্তানি পেঁয়াজ দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। চীনা পেঁয়াজ বাংলাদেশের মানুষ পছন্দ করে না। মিসরের পেঁয়াজ অনেক বড় বড়, চারটিতে এক কেজি হয়ে যায়। তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে কিছু পেঁয়াজ আসতে পারে। আমদানি হলে দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। দেশে ২০১৭ সালে এক কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ১৪০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এযাবৎকালে সেটাই ছিল সর্বোচ্চ মূল্য। তখনো ভারত ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ায় প্রভাব পড়েছিল বাজারে।
পেঁয়াজ নেই, তবুও বিক্রির ঘোষণা টিসিবির! : কেনা হয়নি পেঁয়াজ। সরকারের গোডাউনেও মজুত নেই। তারপরও ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ বিক্রির ঘোষণা দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর কোনো প্রস্তুতি না থাকায় খোলা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেনি ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।
এ বিষয়ে সোমবার টিসিবির মুখপাত্র মো. হুমায়ুন কবির বলেন, সোমবার থেকে ন্যায্যমূল্যে খোলা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রির কথা ছিল। কিন্তু বিক্রি শুরু হয়নি। পেঁয়াজ কেনার জন্য কাজ শুরু হয়েছে। খোলা বাজারে বিক্রি শুরু করতে কয়েকদিন সময় লাগবে। তিনি বলেন, পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে দুটি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি স্বল্পসময়ে বন্দর থেকে পেঁয়াজ কেনার জন্য টিসিবির কাজ শুরু করেছে। পেঁয়াজ কেনা হলে এর ওপর ভর্তুকি দিয়ে দাম নির্ধারণ করা হবে। খুব দ্রুতসময়ে এসব কার্যক্রম শেষ করবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে মিশর, তুরস্কসহ কয়েকটি দেশ থেকে আগামীতে পেঁয়াজ আমদানির কথাবার্তা চলছে।
দেশে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতার কারণে রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সভাপতিত্বে একটি সভা হয়। সভায় বাজারে স্থিতিশীলতা আনার জন্য কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যার একটি ছিল সোমবার থেকে টিসিবির মাধ্যমে খোলা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করা। এছাড়া বন্দরে আমদানি করা পেঁয়াজ দ্রুত খালাস করা, পরিবহনের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করা, পেঁয়াজ আমদানিতে এলসি মার্জিন ও সুদের হার হ্রাসে বাংলাদেশ ব্যাংককে পত্র দেয়ার মতো কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এরপর পেঁয়াজের দামের ঊর্ধ্বগতি রোধে সোমবার থেকে ন্যায্যমূল্যে ট্রাক সেলের মাধ্যমে টিসিবি খোলা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করবে বলে রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে এলসি মার্জিন এবং সুদের হার হ্রাসের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এছাড়া বন্দরে আমদানিকৃত পেঁয়াজের খালাস প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করা এবং নির্বিঘ্নে পরিবহন নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, নিজেদের বাজার সামাল দিতে পেঁয়াজ রফতানির ন্যূনতম মূল্য টনপ্রতি ৮৫০ ডলার বেধে দিয়েছে ভারত। এ খবরে দুদিনে দেশের বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে প্রায় ২০ থেকে ২৫ টাকা।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *