রিন্টু আনোয়ার
একবিংশ শতকে বাংলাদেশকে শিশুদের নিরাপদ আবাস হওয়ার অঙ্গীকারের নামে আমরা একপ্রকার মশকরাই করেছি কারণ প্রতিপক্ষ নয়, এখন স্বজন-আপনজনরাও শিশুদের জন্য হয়ে উঠছেন চরম দুর্জন। তারা মেতে উঠেছেন অবিশ্বাস্য খুন-খারাবিতে। বাবা এমন কি মাও খুন করছে সন্তানকে। স্ত্রী খুন করছে স্বামীকে। স্বামী পুড়িয়ে মারছে স্ত্রীকে, ভাই খুন করছে ভাইকে। এ এক বীভৎস্যতা! খুনের পর বাবা তার ছেলের লাশটি ঝুলিয়ে রাখছেন গাছে কিংবা লাশ রাখা হচ্ছে শয়নকক্ষে, রাস্তায়, বালুর ভেতর, বস্তার ভেতর, কাদার ভেতর, পানির ট্যাংকে, ড্রেনে কিংবা ডাস্টবিনে। বর্বরতার একোন চরম অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছি আমরা? পাঁচ বছরের ছোট্ট তুহিনের বীভৎস ছবিটা দেখে স্বাভাবিক কান্ডজ্ঞানের যে কেউ প্রশ্নবিদ্ধ, মানুষ এতটা নির্মম, নৃশংস হতে পারে? হ্যাঁ পারে। পারছে। রক্তের সঙ্গে রক্তের টান যেখানে স্বার্থের অনেক ঊর্ধ্বে হওয়ার কথা, সেখানে পিতাই আত্মজের খুনি। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ঔরসজাত সন্তানকে নৃশংসতম কায়দায় হত্যা করল যিনি, তিনি সন্তানের জন্য পৃথিবীর নিরাপদতম আশ্রয়দাতা সেই বাবা। বিপদে-আপদে, আনন্দ-বেদনায় সন্তানরা পিতার বুকেই মুখ লুকায়, আশ্রয় খোঁজে। সন্তানের মুখে নির্মল হাসি দেখার আর সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়তে উদয়াস্ত পরিশ্রম করা মানুষটিই তো পিতা। সেই পিতাই ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় জবাই করল। এরপর অঙ্গ কেটে ছোট্ট দেহটি ঝুলিয়ে দিল গাছে। পেটে ঢুকিয়ে দিল দুটো ছুরি! এই পাষন্ডের সঙ্গে ছিল ঘাতকরূপী চাচা-চাচি, চাচাতো ভাই- বোনের মতো নিষ্ঠুর স্বজনরা। ভাবতেও অবিশ্বাস্য। কিন্তু এটাই সত্য।এ ধরনের কান্ড হুট করে নয়। দুষ্কর্মটি করার আগে নিশ্চয় পরিকল্পনা হয়েছিল। শিশুটিকে হত্যা করে কতটা বীভৎস রূপ দেয়া হবে তা-ও ছিল ঘাতকদের মন-মগজে। এমন ভাবনা বা পরিকল্পনার সময় ছোট্ট তুহিনের দুষ্টুমিভরা হাসি মুখটি তাদের একবারও ভাবায়নি। আর এই বাস্তবতার মধ্যেই আমাদের ঘর-বসতি। আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ঘটতে ঘটতে এখন সেটা চরমতম পর্যায়ে। নিজের মেয়েকে দুর্বৃত্তের হাতে তুলে দেয়া, গলাটিপে শিশুপুত্রকে হত্যা করা বা বিষ প্রয়োগে মেরে ফেলা, সদ্যোজাত সন্তানকে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়ার অনেক উদাহরণ আছে আমাদের সমাজে। আগে সব ঘটনা পত্র-পত্রিকা বা গণমাধ্যমে আসতো না। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে ঘটনাগুলো লুকানো থাকছে না। তাৎক্ষণিকভাবেও প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে।মানুষ কেমন যেন অন্যায়-অবিচারকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই ধরে নিয়েছে। অন্যায়, অবিচার, নির্মমতা, নৃশংসতা- বিষধর সাপের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। শালীনতাবোধের সব সীমাই লঙ্ঘন করে বসেছে আজ। মানুষ এখন এতটাই বদলে গেছে , কোনো তত্ত¡ই আর কাজ করছে না। প্রচলিত মনস্তত্ত¡ বা সমাজতত্ত¡ দিয়ে এ বিষয়গুলোকে এখন আর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। অন্যায়-অপকর্ম করে পার পাওয়া যাবে বা বিচারে কিছুই হবে না, এমন মনোভাব কি মানুষকে পশুত্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ?এভাবে বললে পশুদের প্রতি অবিচার হয়ে যায়। কারণ পশুদের রাজ্যে এমন বর্বরতা নেই। তারা তাদের সন্তান বা প্রিয়জনদের এভাবে কতল করে না। বছর দশেক আগে রাজধানীর আদাবরের আয়েশা হুমায়রা এশা নামে এক নারীর পরকীয়া সম্পর্কের কারণে প্রাণ দিতে হয় এশার ছয় বছর বয়সী শিশু সামিউল আজিমকে। মায়ের প্ররোচনায় সন্তানের নৃশংস ওই হত্যাকান্ডটি ছিল চিন্তার বাইরে। কদিন আগে সুনামগঞ্জের শিশু তুহিনের হত্যাকান্ডটি বীভৎস্যতায় সামিউল হত্যার চেয়েও ভয়াবহ। মাত্রাগতভাবে নারকীয়। দারিদ্র্য, মা-বাবার মানসিক ভারসাম্যহীনতা, পরকীয়া সম্পর্ক, সম্পদের প্রতি লোভ, মাদকাসক্তিসহ বেশকিছু কারণে মা-বাবা তার নিজের সন্তানকে হত্যা করছেন। আবার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় সন্তানকে হত্যা করার ঘটনাও রয়েছে। বিষাদগ্রস্থ বা মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ হয়েও কোনো কোনো মা-বাবা ঘটাচ্ছেন এমন ঘটনা। এমন জঘন্যতার ভয়াবহতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের দেওয়া তথ্যে। সংস্থাটির হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে মা-বাবার নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে ৩০টি শিশুর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া এই সময়ে মা-বাবার নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছে আরও ১০ শিশু। কী ভয়ঙ্কর-অবিশ্বাস্য তথ্য। কতো বিকৃত রুচি হলে মানুষ এতো নিষ্ঠুর হতে পারে।পরপর দুই কন্যাসন্তান জন্ম হওয়ায় সিরাজগঞ্জে পুত্রসন্তান-প্রত্যাশী বাবা বদিউজ্জামান দুই কন্যার মধ্যে ছোটটিকে গলা টিপে হত্যা করেছে। হত্যার পর তার লাশটি ফেলে দিয়েছে ডোবায়। যশোরে ঈদের নতুন পোশাক কিনে দিতে না পেরে দুই শিশু সন্তানকে বিষ খাইয়ে হত্যার পর সেই শিশুদের মা হামিদা খাতুন আত্মহত্যা করেন। মানসিক বিষাদ বা হতাশাগ্রস্থ থাকলে যে কেউ নিজ সন্তান হত্যা বা নিজে আত্মহত্যা করতে পারেন। পারিবারিক সহিংসতা, দীর্ঘমেয়াদি মানসিক যন্ত্রণা বা বায়োলজিক্যাল কারণে মানুষ হতাশায় ভুগতে পারে। এর চরম পরিণতিতে কারও ভেতর আত্মহননের চিন্তা আসে। নিজের প্রতি নির্ভরশীল কেউ থাকলে তাদের ভবিষ্যৎ কী হবেথ সে চিন্তা থেকেও তাদের হত্যা করতে পারে। এ থেকেই দেখা যায়, কোনো মা তার সন্তানকে হত্যার পর আত্মহত্যা করেছেন।এ ধরনের অবিশ্বাস্য ঘটনার তালিকা এখন বেশ দীর্ঘ। রাজনৈতিক ও সামাজিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হত্যাকান্ডের সঙ্গে আমরা পরিচিত। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ ধরনের খুনের ঘটনায় বীভৎস, বিকৃত ও লোমহর্ষকতা বেড়ে গেছে। মাথা ও মুখমন্ডল থেঁতলানো এবং গুলিবিদ্ধ বিকৃত লাশ উদ্ধার হচ্ছে প্রায়ই। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক অস্থিরতা, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হওয়া ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে এসব ঘটনা ঘটছে। ভোগবাদী হয়ে উঠছে মানুষ। কমছে মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ। এ কারণে তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে একে অপরকে নৃশংস খুন করতে দ্বিধা করছে না। সাধারণভাবে এ ধরনের খুন-খারাবি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিই নির্দেশ করে। দেশে আইনের শাসন, অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা বলবৎ থাকলে অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে থাকারই কথা।যার মনে ক্ষোভ যত বেশি, তার দ্বারা হত্যাকান্ডে নৃশংসতা তত বেশি হয়। মানুষের চাহিদা, আকাঙ্খা বেড়ে গেছে। তাই বলে সেটা সন্তান, স্ত্রী, স্বামী বা স্বজনকে হত্যা করে? আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়েছে। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হলে একটা মানুষ খারাপ কাজ করতে একটু ভাবে। তারা খারাপ কাজ পরিহার করে মানবিক আচরণগুলো করে। বীভৎস হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়া সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু, মা-বাবাসহ স্বজনদের হিং¯্র হয়ে ওঠার ব্যাখ্যা নানামুখী। সন্তানের প্রতি মা-বাবার অকৃত্রিম স্নেহ-ভালোবাসার জুড়ি নেই। সন্তান যেন থাকে ‘দুধে-ভাতে’থ এ যেন তাদের প্রাণের চাওয়া। শত ঝড়-ঝঞ্ঝায় মাতৃস্নেহে সন্তানকে আগলে রাখা চাই।ছোটোবেলা থেকেই বলা হয়, শোনানো হয়, মা বাবা যা করেন, সন্তানের মঙ্গলের জন্যেই করেন। কথাটা মিথ্যা না হোক।
কথায় কথায় পশ্চিমা দেশের প্যারেন্টিং এর সমালোচনা আমরা করলেও আমাদের নিজেদের দেশে এবং উপমহাদেশে প্যারেন্টিং এর সমস্যা আরো অনেক বেশি ভয়াবহ। মারধর বা ফিজিক্যাল এবিউজ, জোর জবদস্তি, উঠতে বসতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খোটা মারা আমাদের দেশের কোনো কোনো মা বাবার মন-মননে গেঁথে গেছে। এ থেকেও সন্তানদের মুক্তি দেয়া জরুরি। ছেলেমেয়ের বিয়ের পর তাদের যে প্রাইভেসি দেওয়া প্রয়োজন সেটা আমাদের দেশের বেশিরভাগ বাবা মা-ই বোঝেন না। মেয়ের বাবা মাকে মেয়ের সংসারের ব্যাপারে নাক গলাতে মানা করা হলেও ছেলের বাবা মায়ের বেলায় এটা করা হয় না। ‘মাতাপিতার প্রতি কর্তব্য’ রচনা তো অনেক পড়েছে সন্তানেরা। ‘সন্তানের প্রতি পিতামাতার কর্তব্য’ রচনায়ও মা- বাবাদের চোখ বুলালে মন্দ হয় না।
লেখক : সাংবাদিক/কলামিস্ট