রাইড শেয়ারিং বন্ধের উড়ো খবরে আতঙ্কে চালকরা
এম এ স্বপন : রাস্তায় অনিয়ম করলেই চালক ও পথচারীর মোটা অঙ্কের জরিমানার বিধান রেখে শুক্রবার থেকে চালু হলো নতুন সড়ক পরিবহন আইন। কঠোর এ আইন সম্পর্কে এখনও ঠিকমতো জানেন না যাতায়াতকারী কিংবা পুলিশ। আইন কার্যকরের প্রথম দিনে প্রতিদিনের মতোই অনিয়ম চোখে পড়েছে। পুলিশ সদস্য হয়েও উল্টো পথে গাড়ি ঢুকিয়ে দেয়া। হেলমেট ছাড়াই বাইক চালানো। চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পারাপার। সড়কে রোজকার এমন চিত্রের ব্যতিক্রম চোখে পড়েনি নতুন সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কার্যকরের প্রথম দিনে।
এক বছর আগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে গতি বাড়িয়ে আইনটি পাসের পর নানা দিক বিশ্লেষণের কারণে আইনটি বাস্তবায়নে সময় নিয়েছে সরকার। এ আইন কার্যকরে প্রথমদিন থেকেই তৎপর থাকবে ট্রাফিক পুলিশ। তবে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে মামলা ও জরিমানাসহ কিছু বিষয় কার্যকর করতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে। এসব করার জন্য সফটওয়্যার হালনাগাদ করাসহ কিছু কাজ বাকি রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে শুক্রবার থেকে কার্যকর হওয়া এ আইনে বেশ কিছু সংযুক্তি ও পরিবর্তন থাকলেও অ্যাপ ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবার বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা ও নির্দেশনা দেওয়া হয়নি কোথাও। তবে রাজধানীতে অ্যাপ ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা বন্ধ করা হয়েছে-এমন উড়ো খবরে আতঙ্কে আছেন চালকরা।
সড়ক পরিবহন আইনের মামলার ক্ষেত্রে জনগণের স্বার্থে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ জরিমানা কিছুটা কমিয়ে নির্ধারণ করেছে বলেও জানিয়েছে একটি সূত্র।
পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সড়ক আইন কার্যকরে এরইমধ্যে দেশের সব ট্রাফিক ইউনিটগুলোতে এবং সার্জেন্টদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিশেষ করে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের মামলা পস মেশিনে করা হয়। সেই মেশিনটিতে জরিমানার টাকাসহ আরও কিছু বিষয় নির্ধারিত থাকে। সেই বিষয়গুলো এখনও আপডেট করা হয়নি। সেগুলো আপডেট করে তারপর ট্রাফিক পুলিশ নতুন আইনে জরিমানা করবে। এটি না হওয়া পর্যন্ত আগের নিয়মেই সব চলবে।
আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ যে জরিমানা ও শাস্তির কথা বলা হয়েছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ সেটা কমিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে জরিমানার পরিমান ধার্য করেছে। যেমন ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরযান ও গণপরিবহন চালালে ছয় মাস কারাদ- ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে। এমন অপরাধে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ প্রথমবার ৫ হাজার টাকা ও পরেরবার একই অপরাধে ১০ হাজার টাকা জরিমানার কথা উল্লেখ করে ট্রাফিক সার্জেন্টদের চিঠি দিয়েছে। একইভাবে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া মোটরযান চালালে আইনে ৫০ হাজার টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে ডিএমপি প্রথমবার ১০ হাজার ও দ্বিতীয় দফায় ২০ হাজার টাকা জরিমানা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মোটর সাইকেলের ক্ষেত্রে তিন মাস কারাদ- ও ১০ হাজার টাকা জরিমানার কথা বলা হলেও ডিএমপি সেটা কমিয়ে প্রথমবার এক হাজার ও পরেরবার দুই হাজার টাকা জরিমানার কথা বলেছে।
সড়ক আইন কার্যকরে মামলা ও জরিমানার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, সড়ক আইন কার্যকরে পুলিশ সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তবে মামলা ও জরিমানার ক্ষেত্রে কিছু কাজ বাকি আছে। সেগুলো শেষ করে সংবাদ সম্মেলন করে মানুষকে জানিয়ে তারপর তারা নতুন জরিমানা ও মামলা কার্যকর করবেন। এতে আরও কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।
উল্লেখ্য, সড়ক পরিবহনে নতুন ও কার্যকর একটি আইনের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। দেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে কম আন্দোলনও হয়নি। কিন্তু, প্রতিটি সরকারে প্রভাবশালী হয়ে থাকা কিছু সংখ্যক পরিবহন মালিকের চাপে বিষয়টি নিয়ে তেমন অগ্রগতি আসেনি কোনও সরকারেই আমলে। ফলে ব্রিটিশ আমলের এ সংক্রান্ত আইনটি সামান্য সংস্কার করে ১৯৮৩ সালে মোটরযান অধ্যাদেশ নামে যে আইন করা হয় তাই দিয়েই চলছিল দেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা। ৯৬-২০০১ সালে ক্ষমতায় থাকাকালীন তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকার এ বিষয়ে একটি রূপরেখা তৈরি করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তবে গতবছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। সারাদেশেই এই আন্দোলনের বিস্তার ঘটলে সরকার বাধ্য হয়ে আইনটি করার উদ্যোগ নেয়। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসেই মন্ত্রিসভায় ও পরে ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ‘সড়ক পরিবহন আইন’টি পাস করা হয়। এরপর ওই বছরেরই ২২ অক্টোবর গেজেট প্রকাশ করে সরকার। আইন পাসের একবছর দুই মাস পর এটি কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে আজ।
রাইড শেয়ারিং বন্ধের উড়ো খবরে আতঙ্কে চালকরা : শুক্রবার থেকে কার্যকর হয়েছে নতুন সড়ক ও পরিবহন আইন। এ আইনে বেশ কিছু সংযুক্তি ও পরিবর্তন থাকলেও অ্যাপ ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবার বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা ও নির্দেশনা দেওয়া হয়নি কোথাও। তবে রাজধানীতে অ্যাপ ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা বন্ধ করা হয়েছে-এমন উড়ো খবরে আতঙ্কে আছেন চালকরা।
নির্দিষ্ট কোনো বিধিনিষেধ না থাকলেও শুক্রবার সকাল থেকেই আতঙ্ক ও মামলার ভয়ে রাজধানীর অ্যাপ ভিত্তিক বাইক ও কার চালকরা যাত্রী সেবা দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছেন।
অ্যাপ ভিত্তিক রাইড শেয়ারিংয়ে নিয়মিত যাত্রী সেবা দিয়ে থাকেন আবু নাঈম খান। তার সঙ্গে কথা হয় শাহবাগ সিগন্যালে। তিনি জানান, সকালে বেড়িয়েছেন রাইড শেয়ারিংয়ে যাত্রি সেবা দিতে। মতিঝিল থেকে এক যাত্রীকে নিয়ে এখানে এসেছেন। এখানে আসার পরে তার মতো আরো বেশ কয়েকজনকে বলতে শোনেন, নতুন সড়ক ও পরিবহন আইনে ঢাকার রাস্তায় কোনো অ্যাপ ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা দেওয়া যাবে না বলে আইন পাস হয়েছে। যা কার্যকর হচ্ছে শুক্রবার সকাল থেকে।
বারডেম ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাসপাতালের সামনে প্রতিদিনের মতো এদিনও রাইড শেয়ারিংয়ের বাইক ও প্রাইভেট কার চালকদের ভিড়। তাদের সঙ্গে কথা বলেও একই ধরনের আতঙ্ক ও আশঙ্কার কথা জানা যায়।
আতঙ্কিত প্রাইভেট কার চালক মুসাব্বির হোসেন বলেন, রাইড শেয়ারিং সেবা বন্ধের কথা লোকমুখে শোনার পর থেকে আর কোনো ট্রিপ দেইনি। অনেকে আবার রাইড শেয়ার করলেও ট্রাফিক বা সার্জেন্ট জিজ্ঞেস করলে অস্বীকার করতে যাত্রীকে অনুরোধ করছেন।
এদিকে বেশ কিছু রাইড শেয়ারিংয়ের যাত্রীরা অভিযোগ করে বলেন, আইনের কথা বলে তারা অ্যাপ ইউজ করছেন না। কিন্তু নানাভাবে তারা রাইড শেয়ারিং করছেন। এতে করে তারা অ্যাপের বাইরেও বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন।
এছাড়া শহর ঘুরে জানা যায়, যাত্রী ও পথচারীরা নতুন পরিবহন ও সড়ক আইন সম্পর্কে বেশি কিছু না জানলেও আইনকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন। আবার নতুন আইন সম্পর্কে বাসচলকদের তেমন ধারণা নেই।
দায়িত্বরত রাসেল আহমেদ নামে এক সার্জেন্ট জানান, বৃহস্পতিবার রাত থেকেই পরিচিত বেশ কিছু উবার ও পাঠাও চালক আমাকে এ বিষয়ে ফোন দিয়ে জানতে চেয়েছেন। আমি তাদেরও বলেছি, এ ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা আসেনি নতুন আইনে। অ্যাপ ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং চালকরা নীতিমালা তারা মেইন্টেইন করছেন কিনা, লাইসেন্স আছে কিনা এবং হেলমেট ব্যবহার করছেন কি না তা চেক করছি।