মহসীন আহেমদ স্বপন : দেশের বাতাসে দূষণ প্রতিদিনই বাড়ছে। আর রাজধানী ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দূষিত বায়ুর শহর। এই দূষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে মাত্রাতিরিক্ত ধুলা। নগরের বিভিন্ন স্থানে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে এই ধুলা হয়ে উঠেছে নিত্যসঙ্গী। শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা। শীর্ষে রয়েছে ভারতের দিল্লি। ঢাকার পরেই রয়েছে পাকিস্তানের করাচি ও চীনের বেইজিং। ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। আর এই দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ধুলায় ধূসর বর্ণে পরিনত হয়েছে রাজধানী ঢাকা। সর্বত্রই ধুলাবালিতে একাকার। শীতের আগমনীর সময় প্রকৃতি যেখানে কুয়াশার চাদরে ঢেকে কথার কথা সেখানে রাজধানীর সববিছুই ঢেকে যাচ্ছে ধুলার চাদরে। ধুলার যন্ত্রণায় এখন ঢাকা শহরের রাস্তায় নামাই যাচ্ছে না। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির দুয়েকটি সড়ক ছাড়া রাজধানীর ছোট বড় সব রাস্তায়ই এখন ধুলাবালিতে একাকার। ঘরবাড়ি, স্কুল, মাদরাসা, অফিস, আদালত সবই হচ্ছে ধুলায় ধূসর। এ বছর নগরীর বিভিন্ন স্থানে অন্যান্য বছরের তুলনায় বেড়েছে ধুলার পরিমাণ। এর সঙ্গে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন বলছে, বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে পিএম ২.৫। এত দিন এই উপাদান সবচেয়ে বেশি নির্গত করত চীন। গত দুই বছরে চীনকে টপকে ওই দূষণকারী স্থানটি দখল করে নিয়েছে ভারত। চীন ও ভারতের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে জাপানের টোকিও শহর। প্রতিবেদনটিতে মূলত কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বায়ুদূষণের পরিমাণ পরিমাপ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে বলা হয়েছে। আর বায়ুদূষণের কারণে শিশুমৃত্যুর হারের দিক থেকে পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। পিএম ২.৫ ছাড়াও বায়ুর অন্যান্য দূষণকারী পদার্থের উপস্থিতির দিক থেকে সামগ্রিক দূষণের একটি চিত্র ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। তাতে শীর্ষ বায়ুদূষণকারী দেশ হিসেবে চীন, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও পাকিস্তানের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। এরই মধ্যে ঢাকার বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। মেট্রোরেলসহ চলমান কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকা ধুলার রাজ্যে পরিণত হয়েছে, সঙ্গে যোগ হয়েছে ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন এলাকার ইটভাটার দূষণ। চলতি বছরের শুরুতে আন্তর্জাতিক সংগঠন গ্রিনপিস ও এয়ার ভিজ্যুয়ালের গবেষণায় বিশ্বের বিভিন্ন রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে ঢাকায় বায়ু দূষণের মাত্রা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকার তথ্য এলে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালত ঢাকার বায়ু দূষণ কমাতে ধুলোপ্রবণ এলাকাগুলোতে দিনে দুইবার পানি ছিটানোসহ বেশকিছু ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেন ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে। এতেও রাজধানীর ধুলার পরিস্থিতি আগের মতোই রয়েছে। এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ধুলা রোধে দুই সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রমে তারা অসন্তুষ্ট। সড়কে পানি ছিটানোর জন্য ডিএসসিসি নিজস্ব কোনো পানির উৎসই নেই। ওয়াসার পাম্প থেকে পানি নিয়ে বিভিন্ন সড়কে ছিটায় ডিএসসিসির ১১টি গাড়ি। কিন্তু এ বছর ওয়াসা পানি না দেয়ায় সড়কে পানি ছিটানো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপদেষ্টা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম। বিষয়টি নিয়ে ওয়াসার সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি। বাতাসে ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের অতিক্ষুদ্র ভাসমান বস্তু কণার পরিমাণ যদি ১৫১-২০০ পিপিএম হয় তাহলে বাতাসকে অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ পিপিএম হলে খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-৫০০ হলে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। বাংলাদেশের সিটি কর্পোরেশন এলাকার ১১টি স্থানের বাতাসে ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস পর্যন্ত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ নিয়মিত পরিমাপ করা হয় সিএএসই প্রকল্পের মাধ্যমে। এতে দেখা যায় ঢাকার বাতাসে বস্তুকণা ছিল ২৪০ পিপিএম। যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। চিকিৎসকদের মতে, ধুলায় বায়ুদূষণের ফলে রাজধানীতে শ্বাসকষ্ট, যক্ষ্মা, হাঁপানি, চোখের সমস্যা, ব্রঙ্কাইটিস, সর্দি, কাশি, হাঁচিসহ ফুসফুসে ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যাই বেশি। ধুলা-দূষণের কারণেই নানা সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে। মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানীবাসী। ধুলাদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু বিভাগের প্রফেসর শিশু বিশেষজ্ঞ নুরুল ইসলাম বলেন, ধুলিবালি সকল শ্রেণির মানুষের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত ধুলি বালির কারণে ব্রঙ্কাইটিজ, সর্দি, কাশি, জ্বর, চোখের ব্যথা, মাথা ব্যথাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হবে। তিনি বলেন, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের নিমোনিয়া ও শ্বাসকষ্ট রোগ বেড়ে যাবে। বছরজুড়েই চলছে রাজধানীতে উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়ি। বর্ষায় ছিল কাদা-পানি আর খানাখন্দের দুর্ভোগ। শুষ্ক মৌসুমে এসে সর্বসাধারণকে পড়তে হয়েছে ধুলাদূষণে। প্রতিনিয়ত স্কুল-কলেজে যাতায়াতকারী কোমলমতি শিক্ষার্থী ছাড়াও এ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সর্বসাধারণ। যেন দেখার কেউ নেই। উন্নয়ন-ধুলায় শ্বাস নিতেও কষ্ট নগরবাসীর। শহরের রাস্তার দুই পাশের দোকানপাট আর হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো ধুলায় ঢাকা পড়েছে।
এ চিত্র এখন ঢাকার অধিকাংশ এলাকার। বিশেষ করে- রাজধানীর খিলগাঁও, মগবাজার, মৌচাক, মালিবাগ, কাকরাইল, সায়েদাবাদ, মানিকনগর, শ্যামপুর-ধোলাইখাল, চিটাগাং রোড, রায়েরবাগ, গুলিস্তান, বঙ্গবাজার, কারওয়ান বাজার, বংশাল, কুড়িল বিশ্বরোড, ওয়ারী, সদরঘাট, বাবুবাজার, ধানমন্ডি, জিগাতলা, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, মিরপুর, মহাখালী, তেজগাঁও, কালশী, রায়েরবাজার বেড়িবাঁধ, বছিলা, মিরপুর-১৪ থেকে ভাসানটেক, বিমানবন্দর, উত্তরা মডেল টাউনসহ ঢাকার বেশিরভাগ সড়কই ধুলার চাদরে আচ্ছাদিত। সাধারণ যান চলাচলকারী এলাকার তুলনায় মেট্রোরেলের সড়ক নির্মাণ কাজ চলা এলাকাগুলোয় সব সময় ব্যাপক ধুলাবালি ওড়ায় আবাসিক ভবনের বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বাসা পাল্টে ধুলামুক্ত সুবিধাজনক জায়গায় চলে যাচ্ছে।
অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, ঢাকা শহরে অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ, গাড়ির ধোঁয়া ও আশপাশের ইটের ভাটাগুলোর কারণে প্রতিবছর এ সময় বায়দূষণ বেড়ে যায়। এ বছর অক্টোবর পর্যন্ত এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ২০০ পিপিএমের নিচে ছিল। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং নির্মাণকাজ জোরেশোরে শুরু হওয়ায় গত ৫-৬ দিনে সেটা আবার উপরে চলে গেছে।