মহসীন আহমেদ স্বপন: টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার শুরু থেকেই নানা রকম অস্বস্তি এবং সমস্যার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, নতুন সড়ক পরিবহণ আইন এবং সামাজিক অস্থিরতাসহ নানা সমস্যায় জনমনে নানা উদ্বেগ উৎকন্ঠা ক্রমশ বাড়ছে। এসবের মধ্যেও ১১ মন্ত্রী স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হলেও এই এগারো মাসের মন্ত্রিসভায় ১১ ব্যর্থ মন্ত্রীর কারণে এক বছরের কম বয়সী আওয়ামী লীগ সরকার নানা টানাপোড়েন এবং জন অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
সাফল্যের কেন্দ্রে যিনি রয়েছেন তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখনো জনগণের আস্থার প্রতীক। সবাই তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। তিনি যেকোন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সাহসী বুদ্ধিদীপ্তভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এখনো বাংলাদেশে সবচেয়ে সফল মন্ত্রী এবং রাজনীতিবিদ হলেন শেখ হাসিনা। তিনি টানা তৃতীয় ও চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী থেকে জনগনের দু:খ এবং সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে সফল ব্যক্তি।
অন্যদিকে ব্যর্থ মন্ত্রীদের তালিকায় যে ১১ জন রয়েছে তাদের মধ্যে সবার আগে রয়েছে টিপু মুনশির নাম। পেঁয়াজসহ দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি এবং পেঁয়াজের দামের বিশ্বরেকর্ড টিপু মুনশিকে ব্যর্থতার তালিকায় শীর্ষে রেখেছে। টিপু মুনশি নিজেও তার ব্যর্থতার কথা অস্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, পদত্যাগ ১ সেকেন্ডের বিষয়। তিনি পদত্যাগ করুন বা না করুন তবে মন্ত্রী হিসেবে যে তিনি ব্যর্থ সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ভেতরে বাইরে কারোরই কোনো সন্দেহ নেই।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সফল মন্ত্রীদের তালিকায় রয়েছেন। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, জঙ্গীবাদ দমন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তার দৃঢ় অবস্থানে রয়েছেন।
পক্ষান্তরে ব্যর্থার পরিমন্ডলে রয়েছেন পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। বাংলাদেশ এখন বায়ুদূষনে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ। বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে নানা রকম কথা বার্তা হলেও তিনি কিছ্ইু করেননি। মন্ত্রী হিসেবে তাকে এই বিষয়গুলো নিয়ে কোনো বক্তব্য, বিবৃত্তি বা কোনো উদ্যেগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।
পদ্মাসেতু-মেট্রোরেলসহ সড়ক অবকাঠামোয় বড় বড় কাজ হলেও যেখানে কোন দূর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত না হওয়ায় সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে সাধারণ মানুষ বিবেচনা করলেও অনেকে মনে করছেন তার কথা মন্ত্রণালয়ের লোকজন মানছেন না। তাদের দাবী যেসব কাজ একজন উপসচিব পদ মর্যাদার লোকজন করার কথা তা রাস্তায় নেমে তাকেই করতে হয়। এটা বাহবা পাওয়া ছাড়া আর কিছুই না। তিনি এইসব কাজ তদারকির ক্ষেত্রে যথেষ্ট সিরিয়াস। এসব বিবেচনায় তিনি একজন সফল মন্ত্রী। গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ও ব্যর্থদের তালিকায় রয়েছেন। তিনি এফ আর টাওয়ারের পরে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, সমস্ত ত্রুটিপূর্ণ এবং নকশাবহির্ভুত ভবন চিহ্নিত করবেন। তাঁর সেই বক্তব্য শুধু বক্তব্যই রয়ে গেছে। এফআর টাওয়ারের তদন্ত রিপোর্ট নিয়েও বাস্তবে কোন কাজ হয়নি। তিনি বিজেএমই ভবন ভেঙে ফেলার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই ভবনও এখন বহাল তবিয়তে রয়েছে। বাংলাদেশে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের কোন নতুন অবয়ব বা নতুন সম্ভাবনা নিয়ে জনগণের সামনে উদ্ভাসিত হয়নি।
ডাক্তার দিপু মনি শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেই যে বড় কাজটি করেছেন সেটি হলো প্রশ্নপত্র ফাঁস; ফাঁসের কেলেঙ্কারি থেকে জাতিকে মুক্তি দিয়েছেন। পাশাপাশি শিক্ষা অঙ্গনের যে সমস্যাগুলো ছিল সেগুলো কথা কম বলে ঠান্ডা মাথায় উদ্যোগ নিয়েছেন।
রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ব্যর্থ মন্ত্রীদের তালিকায় আরেকজন। একের পর এক রেল দূর্ঘটনা, রেল নিয়ে নানান নৈরাজ্য এবং নজিরবিহীন সময় বিভ্রাট রেলকে এক নতুন সঙ্কটের মুখে ফেলেছে এবং এইক্ষেত্রে রেলমন্ত্রী ব্যর্থ মন্ত্রী হিসেবেই পরিচিত পেয়েছে।
ড. হাছান মাহমুদ দায়িত্ব গ্রহণ করেই তথ্যমন্ত্রণালয়কে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে এনেছেন। বিশেষ করে বিদেশি চ্যানেলগুলোর ব্যাপারে তার আইনানুগ কঠোরতা আরোপ এবং অনলাইন মিডিয়াগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন।
অন্যদিকে ড. এ কে আব্দুল মোমেন আরেক জন ব্যর্থমন্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে না পারছেন কিছু করতে আবার ভারত ও বাংলাদেশ সম্পর্ক তার সময়ে নতুন টানাপোড়েনের সামনে পড়েছে। আর এসব বিষয়ে তিনে বক্তব্য ও বিবৃত্তি দেওয়া ছাড়া তেমন কিছু করতেও পারছেন না
আইন মন্ত্রী আনিসুল হক একজন সফল মন্ত্রী হিসেবে নিজেকে জানান দিয়েছেন। বিশেষ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে নূসরাত হত্যার বিচার করা, আবরার হত্যা মামলা দ্রুত বিচারে আনাসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ বিচার কাজগুলোকে দ্রুত নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছেন।
খাদ্য মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার আরেক ব্যর্থ মন্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। তিনি খাদ্য পরিস্থিতি বাজার পরিস্থিতি তার কোনো উদ্বেগ বা উৎকন্ঠা জনগণের চোখে পড়েনি। খাদ্য মজুদ এবং সরবারহের বিষয় নিয়েও তার মন্ত্রণালয়ের কোন রকম দায়িত্বপূর্ণ আচরণ জনগন দেখেনি।
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী সফল মন্ত্রী হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে ভূমি ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এজন্য তাকে সফল মন্ত্রী হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়।
পক্ষান্তরে ইমরান আহমেদ প্রতিমন্ত্রী থেকে পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেও বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যানের ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি হয়নি। বরং সৌদি আরব থেকে নারী কর্মীদের বারবার দেশে ফেরা বাংলাদেশকে এক নতুন সমস্যার মধ্যে ফেলেছে। এ কারণে অভিবাসীদের মধ্যে নতুন আশঙ্কা তৈরী হয়েছে। অভিবাসন নিয়ে বাংলাদেশের যে গর্বের জায়গা ছিল সেই জায়গাগুলো ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে।
মতিয়া চৌধুরীর পর কৃষি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন ড. আব্দুর রাজ্জাক। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি একই ধারায় নিয়ে গেছেন। কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার ব্যাপারে তার দৃঢ় অবস্থান তাকে প্রশংসিত করেছে।
অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তাফা কামালও একজন ব্যর্থ মন্ত্রী। তিনি দায়িত্ব নিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ঋণ খেলাপীর সংখ্যা আর বাড়বে না, তবে ঋণ খেলাপির সংখ্যা বেড়েই চলেছে এবং মন্ত্রীও নানা ধরণের বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
নৌপরিবহনের ক্ষেত্রে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এসেছে খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর হাত ধরে। বিশেষ করে নৌপরিবহনের চারপাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ নৌপথের সংস্কারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। স্থানীয় সরকার বাংলাদেশের মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্ত্রণালয়ের একটি। সেখানে এবারের সবথেকে বড় চমক ছিল তাজুল ইসলামের মতো অপেক্ষাকৃত অরাজনৈতিক ব্যবসায়ীকে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার তুলে দেয়া। মন্ত্রী হিসেবে তিনি এই মন্ত্রণালয়ের জন্য কিছুই করতে পারেনি। বরঞ্চ এই মন্ত্রণালয়ের কাজের গতি শ্লথ হয়েছে এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এখানে এসে সুবিধা পাচ্ছেনা বলেই তাঁরা অভিযোগ করছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সরাসরি স্থানীয় রাজনীতিবিদরা যুক্ত এবং সেখানে এসে এই মন্ত্রণালয় কতটুকু সফল হয়েছে- তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে।
বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবেলায় একটি সফল রাষ্ট্র। তবে সবসময় দায়িত্ববান ব্যক্তি না থাকলে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ে এবং অনেক সমস্যার তৈরি হয়। অতীতে এমন অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের রয়েছে। তবে এবারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের নিবিড় পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য দেখিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের সময় দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল অবস্থানের কারণে দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ আরেকবার সফল রাষ্ট্র হিসেবে আরেকবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
গত ১১ মাসের মন্ত্রিসভায় ব্যর্থ মন্ত্রীর তালিকায় অবশ্যই থাকবেন ধর্মমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ। রোজার ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে তিনি যে কা- ঘটিয়েছিলেন সেজন্য তার নাম ব্যর্থতার তালিকায় অবশ্যই রাখতে হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন সাফল্যের সঙ্গে জেএসসি, জেডিসি এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী সম্পন্ন করেছেন। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন রকম দাবি দাওয়া প্রণয়নের ক্ষেত্রে তিনি যৌক্তিক ভূমিকা পালন করেছেন। যে সব জটিলতা ছিল এই মন্ত্রণালয় তা নিরসনের জন্য চেষ্টা করেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি সফল ভূমিকা রেখেছেন।
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মাহবুব আলী আরেক ব্যর্থ মন্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত হবেন। তিনি বিমানের নানা রকম উন্নয়ন এবং উৎকর্ষতা বৃদ্ধির জন্য কথাবার্তা বলছেন, তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বিমানের যে খারাপ অবস্থা, সেই খারাপ অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
এই ১১ জন ব্যর্থ মন্ত্রীর নানা ব্যর্থতায় গত দুই মেয়াদের সাফল্য অর্জন করেছিল এবং উন্নয়নের যে গতির সূচনা হয়েছিল তৃতীয় মেয়াদে এসে সেই গতিধারা অনেকক্ষেত্রে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও মনে করেন এই সাফল্য ম্লান হওয়ার পেছনে মন্ত্রীদের ব্যর্থতা এক বড় কারণ।
অন্যদিকে সাফল্যের কেন্দ্রে যিনি রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখনো জনগণের আস্থার প্রতীক। সবাই তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। তিনি যে কোন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সাহসী বুদ্ধিদীপ্তভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এখনো বাংলাদেশে সবচেয়ে সফল মন্ত্রী এবং রাজনীতিবিদ হলেন শেখ হাসিনা। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাও সফল মন্ত্রীদের কারণে সরকারের ব্যর্থতাগুলো সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে সাধারণ নেতা কর্মীরা মনে করেন। তারা আরো মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই তাদের আস্থার প্রতীক। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে অল্পদিনেই উন্নত দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ।