নিজস্ব প্রতিনিধি : নরসিংদীতে অপহরণ চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে সংঘবদ্ধ অপহরণকারী চক্রের এই ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।
শনিবার দুপুর সাড়ে ৩টায় এ তথ্য জানায় র্যাব-১১। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন অভিত মিয়া (২৮), পাপ্পু মিয়া (২৮), মারিয়া আক্তার মন্টি (২৩) এবং বাদল মিয়া (৫৮)। তারা নরসিংদী জেলার সদর থানার স্থায়ী বাসিন্দা।
র্যাব জানায়, ২০ ফেব্রুয়ারি রাসেল নামক একজন নারায়ণগঞ্জ র্যাব সদর দপ্তরে একটি অভিযোগ করেন। অভিযোগে তিনি বলেন, গত ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর তাকে (রাসেল) ডিবি পরিচয়ে অজ্ঞাত কয়েকজন ব্যক্তি নরসিংদী আদালতের সামনে থেকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে অবচেতন করে সেখান থেকে তাকে একটি ফ্লাট বাসায় নিয়ে হাত-পা ও চোখ বেঁধে মারধর করাসহ বিভিন্ন শারীরিক নির্যাতন করা হয়। সেই নির্যাতনের ভিডিও আবার মোবাইলে ধারণ করা হয়। পরে ভিকটিম রাসেলকে জিম্মি করাসহ হত্যার হুমকি দিয়ে পরিবারের কাছ থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করে অপহরণকারীরা।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারী ও গোপন অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পায়। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার রাদে র্যাব-১১ এর একটি আভিযানিক দল জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা ভিকটিম রাসেলকে অপহরণের বিষয়ে স্বীকারোক্তি দেয়াসহ অন্যান্য আরও অপরাধের লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়।
র্যাব আরো জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা একটি সংঘবদ্ধ অপহরণকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য। তারা অপহরণের উদ্দেশ্যে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছদ্মবেশে মাইক্রোবাসযোগে ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ বুঝে বিভিন্ন এলাকার বিত্তশালী লোকদের অপহরণ করে চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে অবচেতন করে গোপন স্থানে নিয়ে জিম্মি করে বিভিন্ন শারিরিক নির্যাতন করে। পরে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে পরিবারের কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশলে মোটা অংকের টাকা মুক্তিপণ নেয়।
ভুক্তভোগী রাসেল জানান, ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পরিবারকে না জানিয়ে মন্টিকে বিয়ে করেন তিনি। ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি সৌদি আরবে চাকরি নিয়ে চলে যান। বিদেশ গিয়ে বাবা আবদুল হককে বিয়ের কথা জানান রাসেল। পরে পুত্রবধূ মন্টিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান রাসেলের মা-বাবা।
একই বছরের এপ্রিল মাসে দেশে ফেরেন রাসেল। এক মাস থাকার পর মে মাসে আবার সৌদি আরব চলে যান তিনি। সৌদি আরব যাওয়ার পর রাসেলকে তার স্ত্রী মন্টি জানান, তিনি অন্তস্বত্বা। কিন্তু রাসেলের মা-বাবা জানান, মন্টি তাদের না জানিয়ে নরসিংদীতে তার বাবার বাড়ি চলে গেছেন। যাওয়ার সময় গয়না, মোবাইল ফোন নিয়ে গেছেন।
এ খবর পেয়ে রাসেল গত ১৩ সেপ্টেম্বর আবার দেশে আসেন। মন্টির বাড়িতে গিয়ে জানতে পারেন, তার গর্ভপাত হয়েছে। এর চারদিন পর নরসিংদী সদর থানায় রাসেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন স্ত্রী মন্টি আক্তার।
রাসেল অভিযোগে আরো উল্লেখ করেন, ওই মামলার পর নানাভাবে রাসেলকে হয়রানি করতে থাকে মন্টির পরিবার। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর তাকে ডিবি পরিচয় দিয়ে পাপ্পু মিয়াসহ কয়েকজন ব্যক্তি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গে সিটের নিচে ফেলে মারধর করা হয়। তৃষ্ণায় পানি চাইলে ঠাণ্ডা পানীয় দেওয়া হয়। কিন্তু পানীয় পানের পর সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
রাসেল বলেন, চেতনা ফেরার পর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নিজেকে একটি কক্ষের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেন। এর কিছুক্ষণ পরই রাসেলকে পেটানো শুরু করেন পাপ্পু। পরে পাপ্পুর বন্ধু অভিকও মারধর শুরু করেন। এক পর্যায়ে মারধরের ভিডিও ধারণ করে রাসেলের পরিবারের কাছে পাঠানো হয়। ওই ভিডিও দেখে দেড় লাখ টাকায় সমঝোতা হয়। রাতে বিকাশে ৬০ হাজার টাকা পাঠায় রাসেলের পরিবার। বাকি ৯০ হাজার টাকা নগদ পরিশোধের কথা হয়।
এই টাকা নিতে ২৯ ডিসেম্বর রাতে রাসেলকে মাইক্রোবাসে তোলে পাপ্পু ও তার দলের লোকজন। রাত সাড়ে তিনটার দিকে মাইক্রোবাসটি নরসিংদী শাপলা চত্বরে আসার পর অপহরণকারীরা প্রস্রাব করতে নামেন। রাসেলও প্রস্রাবের কথা বললে তাকেও নামানো হয়। একটি পিকআপভ্যান সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় রাসেল চিৎকার শুরু করেন। তখন অপহরণকারীরা তাকে রেখেই দ্রুত পালিয়ে যায়। এরপর রাসেল সারা রাত নরসিংদী রেল স্টেশনে কাটান। পরদিন সকালে কুমিল্লায় বড় বোনের কাছে চলে যান। সেখানে মুক্তি ক্লিনিকে চিকিৎসা করান।