নিজস্ব প্রতিবেদক : সুষ্ঠু তদারকির অভাবে বগুড়ায় অনুমোদন ছাড়া মানহীন আয়ুর্বেদিক ইউনানি হোমিও এবং হারবাল ওষুধ উৎপাদনের মহোৎসব চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেই সাথে ভারত থেকেও আসছে বিভিন্ন যৌন উত্তেজক ওষুধ। ফলে মান ও অনুমোদনহীন এসব ওষুধ অবাধে কেনাবেচা হওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলন সংগ্রামের ফলে সাবেক আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার পতনের পরও আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মা চিহ্নিত বগুড়ার আয়ুর্বেদিক, ইউনানি, হোমিওপ্যাথিক এবং হারবাল ঔষধ কোম্পানির মালিকপক্ষ দুর্দান্ত প্রতাপে অন্তবর্তীনকালীন সরকারের আমলে ও ভেজাল ও মানহীন ঔষধ সামগ্রীর উৎপাদন ও বাজারজাত অব্যাহত রেখেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অল্টারনেটিভ মেডিসিন (ট্রেডিশনাল) বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যুগের চাহিদা ও দাবির সাথে সংগতি রেখে সরকার ইউনানী, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রকে গুরুত্ব দিয়ে দেশের সরকারি হাসপাতালে একজন করে ইউনানী ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছে। দাবি উঠেছে হোমিও চিকিৎসক নিয়োগেরও। যেন সাধারণ মানুষ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হারবাল ওষুধে স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারে।

আর এটাকেই সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে কিছু অর্থলোভী হোমিও, ইউনানী ও আয়ুর্বেদ ও হারবাল ওষুধ কোম্পানির মালিক। এসব ঔষধ কোম্পানির মালিকপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউ এইচ ও) এর গাইডলাইন অনুযায়ী গুড ম্যানুফ্যাক্সারিং প্রাক্টিস (জিএমপি) গাইড লাইন অমান্য করে অনুমোদনহীন ওষুধ উৎপাদন করে রাতারাতি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

একটি সূত্রে জানা গেছে, বগুড়ায় ৪/৫টি হোমিও এবং ১৯টি ইউনানী এবং ৮টি আয়ুর্বেদিক ওষুধ কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি কোম্পানির লাইসেন্স দীর্ঘদিন যাবৎ নবায়ন করা হয়নি। নবায়নহীন এসব কোম্পানির আবার কোন কোনটির ৫-১০ বছর পর্যন্ত লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি।
এ গুলোর লাইসেন্সের মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও এসব কোম্পানি সরকারি নিয়মকানুন উপেক্ষা করে ওষুধ উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। উৎপাদন করে যাচ্ছে ভেজাল, মানহীন ও মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ওষুধ ।
তবে মারাত্মক অভিযোগ হল এসব ওষুধ কোম্পানির জন্য বরাদ্দ এ্যালকোহলিক পারমিটের কাগজ ব্যবহার করে চোরাই পথে এ্যালকোহল এনে তা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। একটি সূত্রে জানা গেছে, সাধারণভাবে এ্যালকোহলকে মাদক হিসেবে ব্যবহারের জন্য শুধুমাত্র হোমিও ওষুধ প্রস্তুতকারকদের দায়ী করা হলেও এরসাথে যে অন্যান্য ওষুধ প্রস্তÍতকারকরাও জড়িত এ বিষয়টি কারো আমলেই আসে না।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বগুড়া অফিসের একটি সুত্রে জানা গেছে, বগুড়ার যেসব ইউনানী ওষুধ কোম্পানীর লাইসেন্স দীর্ঘদিন নবায়ন করা হয়নি তার মধ্যে রয়েছে ইউনিয়ন ল্যাবরেটরীজ, এ এস এ ল্যাবরেটরী, ফার্মাজেম ল্যাবরেটরী, ইউনাইটেড ফ্রেন্ডস ফার্মাসিউটিক্যালস, জর্জ ইউনানী ল্যাবরেটরী, রেমেক্স ল্যাবরেটরী, ইষ্টল্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল(বর্তমানে স্থগিত), পিএম ল্যাবরেটরী, রেডরোজ ফার্মাসিউটিক্যাল, আর কে ল্যাবরেটরীজ, প্রিভেন্টিস বাংলাদেশ ইউনানী। এছাড়া আয়ুর্বেদিক ফার্মাসিউটিক্যালস এর মধ্যে নিকো আয়ুর্বেদিক ফার্মাসিউটিক্যাল, ইউনাইটেড ল্যাবরেটরী ও কনফিডেন্স ফার্মাসিউটিক্যালসও দীর্ঘদিন ধরে তাদের লাইসেন্স নবায়ন না করেও ঔষধের উৎপাদন ও বাজারজাত অব্যাহত রেখেছিল।
অপরদিকে সম্প্রতি পারুল হোমিও ও পুনম হোমিও নামের দুটি হোমিও ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করেছিল ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর । তবে এই প্রতিষ্ঠানদুটির কর্তৃপক্ষ জানায় তারা বড় ধরনের চক্রান্তের শিকার। তবে হোমিওপ্যাথি ঔষধের উৎপাদন লাইসেন্স এর ব্যানারে ইথাইল এলকোহল পাচারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ইথাইল এলকোহল সেবনে নরসিংদী, গাজীপুর, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ও ঘটেছে।
এ ছাড়াও বগুড়ার এমী ল্যাবরেটরীজ (আয়ু), দিদার ল্যাবরেটরীজ (আয়ু), সবুজ ল্যাবরেটরীজ (ইউনানি) কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যাবত ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ঔষধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশকে পাশ কাটিয়ে ভেজাল ও মানহীন ঔষধ সামগ্রীর উৎপাদন ও বাজারজাত অব্যাহত রেখেছেন। কারন তারা ঔষধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের ধার ধারে না।
এদিকে বগুড়ার লাইসেন্স নবায়ন, ঔষধের পদ নবায়ন ছাড়া বেশিরভাগ কোম্পানির অনুমোদনহীন ওষুধে বাজার ছেয়ে যাওয়ারও পাওয়া গেছে । ওষুধ প্রশাসন কর্তৃক স্থগিত করা একটি কোম্পানির ওষুধও উৎপাদন অব্যাহত রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোম্পানিগুলো ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রের বাইরে গিয়ে নিষিদ্ধ কেমিক্যাল সিলডেনাফিল সাইট্রেট (এসএস ) ও ক্যাফেইন ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে যৌন উত্তেজক ওষুধ উৎপাদন করছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। আর এসব যৌন উত্তেজক ওষুধ শুধু ফার্মেসির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমানে গ্রাম-গঞ্জের পান বিড়ি ও মুদি দোকানেও পাওয়া যাচ্ছে ব্যাপকভাবে।
ফলে সহজলভ্য এসব ওষুধ ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ লিভার, কিডনি, হৃদরোগসহ মারাত্মক সব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উঠতি বয়সের ছাত্র ছাত্রী, কিশোর – কিশোরী, যুবক যুবতী এসবে আসক্ত হয়ে অনৈতিক কাজের দিকে ধাবিত হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে দাম্পত্য কলহসহ বিবাহ বিচ্ছেদের মুলেও কাজ করছে এসব যৌন উত্তেজক ঔষধ সামগ্রীর ব্যাবহার । দেশের বিভিন্ন এলাকায় এসব যৌন উত্তেজক ঔষধ সামগ্রী সেবনে সেবনকারীরা বিকৃত-মস্তিস্কবাহিত রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়াসহ অকাল মৃত্যুর ঘটনা ও ঘটেছে।
বেস কিছুদিন আগে বগুড়ার একটি আয়ুর্বেদিক কোম্পানিতে প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ অভিযান পরিচালনা করে ৫০ কেজি নিষিদ্ধ কেমিক্যাল ক্যাফেইন আটক করে। অবৈধভাবে কেমিক্যাল ক্যাফেইন মজুদ করার দায়ে ঐ কোম্পানির মালিকের ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট।
বগুড়া জেলা কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সভাপতি বলেন, যেসব ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ওষুধ কোম্পানি অনুমোদনহীন ওষুধ উৎপাদন করে দেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য হুমকির মাঝে ঠেলে দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার জন্য তিনি প্রশাসনের প্রতি অহবান জানান। এছাড়া অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রিকালে প্রশাসনের হাতে ধরা পড়লে তার দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে। কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতি তার দায় দায়িত্ব বহন করবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন তিনি।
যৌন উত্তেজক ওষুধ ব্যবহার সম্পর্কে একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, যৌন উত্তেজক ওষুধ ব্যবহারে মানসিক সমস্যাসহ হৃদরোগে আক্রান্তের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাছাড়া লিভার ও কিডনি নষ্ট হতে পারে। এসব কারণে যৌন উত্তেজক ওষুধ কোন ক্রমেই ব্যবহার করা উচিত নয়।
বগুড়ার সহকারী পরিচালক মরুময় সরকার সাড়ে ৪ মাস পূর্বে নেত্রকোনা থেকে বদলি হয়ে বগুড়ায় এসেছেন তিনি বগুড়ায় যোগদান করার পরে অবশ্য বিভিন্ন কোম্পানির অনুমোদনহীন ওষুধ উৎপাদন সম্পর্কে তিনি অবগত নন বলে জানা, তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তিনি যথানিয়ম ব্যাবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আশ্বাস দেন।
এসকল অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ইউনিয়ন ল্যাবরেটরীজ, এ এস এ ল্যাবরেটরী, ফার্মাজেম ল্যাবরেটরী, ইউনাইটেড ফ্রেন্ডস ফার্মাসিউটিক্যালস, জর্জ ইউনানী ল্যাবরেটরী, রেমেক্স ল্যাবরেটরী, ইষ্টল্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল, পিএম ল্যাবরেটরী, রেডরোজ ফার্মাসিউটিক্যাল, আর কে ল্যাবরেটরীজ, প্রিভেন্টিস বাংলাদেশ ইউনানী। এছাড়া আয়ুর্বেদিক ফার্মাসিউটিক্যালস, নিকো আয়ুর্বেদিক ফার্মাসিউটিক্যাল, ইউনাইটেড ল্যাবরেটরী, কনফিডেন্স ফার্মাসিউটিক্যালস, এমী ল্যাবরেটরীজ (আয়ু), দিদার ল্যাবরেটরীজ (আয়ু), সবুজ ল্যাবরেটরীজ (ইউনানি), পারুল হোমিও ও পুনম হোমিও এর মালিক এর মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তারা মোবাইল রিসিভ না করায় তাদের কোন প্রকার বক্তব্য প্রকাশিত হলো না।