জামিলুর রেজা চৌধুরীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক

জাতীয় রাজধানী

নিজস্ব প্রতিবেদক : খ্যাতিমান প্রকৌশলী জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার দিবাগত রাত ২টার দিকে রাজধানীর কলাবাগানের নিজ বাসায় ম্যাসিভ ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মারা যান ৭৭ বছর বয়সী এ প্রবীণ অধ্যাপক। জামিলুর রেজা চৌধুরীর জামাতা অধ্যাপক জিয়া ওয়াদুদ মঙ্গলবার ভোরে ফেসবুকে তার মৃত্যুর খবর জানান।
একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রতিভাবান এ শিক্ষাবিদের মৃত্যুতে শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, একজন স্বনামধন্য প্রকৌশলী হিসেবে তিনি দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ চলমান নানা উন্নয়ন প্রকল্পে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের নেতৃত্বদানকারী এই গুণী ব্যক্তিত্বের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
তার জানাজা মঙ্গলবার বাদ জোহর ধানম-ি ঈদগাহ মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। পরে বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
তার ছেলে আমরিকা এবং মেয়ে ইংল্যান্ডে থাকায় তারা উপস্থিত হতে পারছেন না বলে জানা গেছে।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে তিন মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জামিলুর রেজা চৌধুরী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য ছিলেন। তিনি ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য।
১৯৯৩ সালে যাদের হাত দিয়ে বাংলাদেশের ইমারত বিধি তৈরি হয়েছিল, জামিলুর রেজা চৌধুরী তাদের একজন। দেশের প্রথম মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে ৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। পদ্মা সেতু প্রকল্পের আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্যানেলেরও নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন এ খ্যাতিমান প্রকৌশলী। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ চলমান নানা উন্নয়ন প্রকল্পেও বিশেষজ্ঞ প্যানেলের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন তিনি।
১৯৪৩ সালের ১৫ নভেম্বর সিলেট শহরে প্রকৌশলী আবিদ রেজা চৌধুরী ও হায়াতুন নেছা চৌধুরীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
বাবার বদলির চাকরির কারণে তার শৈশব কেটেছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। প্রাথমিক শেষ করে ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে ভর্তি হলেও পরে তার পরিবার ঢাকায় চলে আসে। প্রথমে নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও পরে সেইন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুল থেকে ১৯৫৭ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন।
ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৩ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করে সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন।
১৯৬৪ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে যান জামিলুর রেজা চৌধুরী। সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডভান্স স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর করেন। ১৯৬৮ সালে সেখানেই পিএইচডি শেষ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘শিয়ার ওয়াল অ্যান্ড স্ট্রাকচারাল অ্যানালাইসিস অব হাইরাইজ বিল্ডিং’।
পিএইচডি শেষে দেশে ফিরে আবার বুয়েটে শিক্ষকতা শুরু করেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। ১৯৭৬ সালে হন অধ্যাপক। ২০০১ সাল পর্যন্ত বুয়েটে অধ্যাপনা করার সময় বিভিন্ন সময়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান এবং ফ্যাকাল্টির ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক ছিলেন তিনি। পরে ওই কম্পিউটার সেন্টারই বুয়েটের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনলজিতে পরিণত হয়।
বুয়েট থেকে অবসরে যাওয়ার পর ২০০১ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী।
২০১৮ সালে তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ২০১৭ সালে একুশে পদক অর্জন করেন তিনি। এছাড়াও ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি টাস্কফোর্সের একজন সদস্য।
মন্ত্রীদের শোক : দেশের অগ্রগণ্য প্রকৌশলী, জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী মঙ্গলবার রাত ৩টার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান (ইন্না লিল্লাহিৃরাজিউন )।
এছাড়া জামিলুর রেজা চৌধুরীর আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক, রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম, ভূমমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ।
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ শোকবার্তায় বলেন, জীবনভর নানা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননার অধিকারী জামিলুর রেজা চৌধুরী দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে অবদানের জন্য ২০১৭ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ২০১৮ সালে তাকে জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা করা হয়। ওই বছরই জাপান সরকার তাকে সম্মানজনক ‘অর্ডার অব দ্য রাইজিং সান, গোল্ড রেইস উইথ নেক রিবন’ খেতাবে ভূষিত করে।’
তথ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি পাওয়া একমাত্র বাংলাদেশি এই অধ্যাপক ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে তিন মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, যা ভুলবার নয়।’
এছাড়া, জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর মৃত্যতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। এক শোকবার্তায় দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, দেশের দুর্নীতি প্রতিরোধ আন্দোলনে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী দুদকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বার বার। তিনি দুর্নীতি প্রতিরোধে যেসব পরামর্শ দিতেন দুদকের কর্মকৌশলে তার প্রতিফলন ঘটতো।’
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, তিনি একাধারে ছিলেন স্বনামখ্যাত প্রকৌশলী, শিক্ষক, পরামর্শক অন্যদিকে ছিলেন উচ্চ নৈতিকতা-সম্পন্ন অনুসরণযোগ্য এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব। তার বহুমুখী প্রতিভা দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মপ্রক্রিয়ায় ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। তার মৃত্যতে দুদক একজন অভিভাবকসুলভ ব্যক্তিত্বকে হারালো। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি দুদক চেয়ারম্যান গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
১৯৪২ সালের ১৫ নভেম্বর সিলেটে জন্ম নেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) অধ্যাপনা শেষে তিনি সর্বশেষ এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর এ দেশে যত বড় বড় ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটির সঙ্গেই তিনি কোনও না কোনোভাবে জড়িত থেকেছেন।
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) অধ্যাপনা শেষে সর্বশেষ এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর এ দেশে যেসব বড় বড় ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে তার প্রায় প্রতিটির সঙ্গেই তিনি কোনও না কোনও ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৪২ সালের ১৫ নভেম্বর সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা প্রকৌশলী আবিদ রেজা চৌধুরী এবং মা হায়াতুন নেছা চৌধুরী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তার অবস্থান তৃতীয়। তার স্ত্রীর নাম সেলিনা নওরোজ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। ব্যক্তিজীবনে তিনি দুই সন্তানের জনক। বড় সন্তান কারিশমা ফারহিন চৌধুরী পেশায় পুরকৌশলী এবং ছোট সন্তান (ছেলে) কাশিফ রেজা চৌধুরী ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি করেছেন।


বিজ্ঞাপন