সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা

আন্তর্জাতিক এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন স্বাস্থ্য

*প্রতি মুহূর্তেই রূপ বদলাচ্ছে
*ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে সব
*দেশে ১দিনে আক্রান্ত ৯৬৯
*মোট সুস্থ ৩,১৪৭ জন
*মোট মৃত্যু ২৫০

 

মহসীন আহমেদ স্বপন : বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউন শিথিল হওয়ায় আবারও সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর মধ্যেই সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকলেও ধাপে ধাপে লকডাউন শিথিলের ঘোষণা দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এছাড়া কড়াকড়ি শিথিল করতে শুরু করেছে বলকান রাষ্ট্র ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়াসহ প্রতিবেশী আরও কয়েকটি দেশ।
এ দিকে বাংলাদেশেও আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে রেকর্ড সংখ্যক ৯৬৯ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১৬ হাজার ৬৬০ জন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১১ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ২৫০ জনে।
মঙ্গলবার দুপুরে করোনা ভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অনলাইন বুলেটিনে এ তথ্য জানান সংস্থাটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।
তিনি জানান, করোনাভাইরাস শনাক্তে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৬ হাজার ৮৪৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে পরীক্ষা করা হয় ৬৭৭৩টি নমুনা। এ নিয়ে মোট নমুনা পরীক্ষা করা হলো ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৩৮টি। নতুন নমুনা পরীক্ষায় আরও ৯৬৯ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১৬ হাজার ৬৬০ জন। এ ছাড়া আরও ১১ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ২৫০ জনে। এদের সাত জন পুরুষ ও চারজন নারী।
নাসিমা সুলতানা আরও জানান, আক্রান্তদের মধ্যে আরও ২৪৫ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এ নিয়ে মোট সুস্থ হয়েছেন ৩ হাজার ১৪৭ জন করোনা রোগী।
ডিসেম্বরে প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে বেশিরভাগ দেশই ভাইরাসটিতে তেমন পাত্তা দেয়নি। অনেক দেশই ধারণা করেছিল, এটি চীনা ভাইরাস এবং এর সংক্রমণ হয়তো ইউরোপ-আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়বে না। এজন্য সেখানকার দেশগুলো তেমন কোনো পদক্ষেপও নেয়নি। ফলও দিতে হচ্ছে তাদের। কারণ সংক্রমণ সংখ্যার দিক থেকে প্রথম দেশগুলোর তালিকার মাঝেই নেই চীন।
বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হলেও প্রথম মৃত্যুর খবর আসে ১৮ মার্চ। দিন দিন করোনা রোগী শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ায় নড়েচড়ে বসে সরকার। ভাইরাসটি যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য ২৬ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয় সব সরকারি-বেসরকারি অফিস। কয়েক দফা বাড়ানো হয় সেই ছুটি, যা এখনও অব্যাহত আছে। পঞ্চম দফায় সেই ছুটি বাড়ানো হয় ৫ মে পর্যন্ত। তার আগেই আরেক দফা ছুটি বাড়িয়ে ১৬ মে পর্যন্ত করা হয়।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যা ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটার তথ্যানুযায়ী মঙ্গলবার পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২ লাখ ৮৭ হাজার ৩৩২ জন। এছাড়া এ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ৪২ লাখ ৫৫ হাজার ৯৪০ জনের শরীরে।
আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৫ লাখ ২৭ হাজার ৪৮৭ জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ২৪ লাখ ৪১ হাজার ১২১ জন। এদের মধ্যে ২৩ লাখ ৯৪ হাজার ১৮৫ জনের শরীরে মৃদু সংক্রমণ থাকলেও ৪৬ হাজার ৯৩৬ জনের অবস্থা গুরুতর।
প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সারাদেশে চলছে ছুটি। বন্ধ বাস, ট্রেন, লঞ্চসহ সব ধরনের গণপরিবহন। যদিও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় পোশাক কারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। এছাড়া গত ১০ মে থেকে শর্তসাপেক্ষে খুলে দেয়া হয়েছে দোকানপাট ও শপিংমলও।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণ ওঠানামা করছে। আবারো কোথাও কোথাও বাড়ছে নতুন শনাক্ত।
এ অবস্থায় ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে লকডাউন শিথিলের প্রক্রিয়া নিয়ে তাড়াহুড়ো না করে ধীরগতিতে তা বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সোমবার জেনেভায় নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক আশঙ্কা প্রকাশ করে আরও বলেন, বিভিন্ন দেশ লকডাউন শিথিল করায় সামনে ভাইরাসটির সংক্রমণের হার আরও বাড়তে পারে।
এদিকে রাশিয়ায় করোনা সংক্রমণ যখন বেড়েই চলেছে, ঠিক তখন দেশটিতে ধাপে ধাপে লকডাউন শিথিলের ঘোষণা দিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সোমবার টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে তিনি আরও জানান, মঙ্গলবার থেকেই ধাপে ধাপে লকডাউন শিথিল শুরু হলেও মূলত তা নির্ভর করবে আঞ্চলিক গভর্নরদের সিদ্ধান্তের ওপর।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার থেকে দেশজুড়ে লকডাউন শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। যদিও করোনার বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। কয়েকটি অঞ্চল এ মুহূর্তে তুলনামূলক নিরাপদ হলেও এখনও ঝুঁকিমুক্ত নয়। আর তাই সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছি আমি।
লকডাউন কিছুটা শিথিল হয়েছে প্রতিবেশী বলকান রাষ্ট্র ক্রোয়েশিয়া ও বসনিয়াতেও। ক্রোয়েশিয়ায় চলতে শুরু করেছে গণপরিবহনও। খুলে দেয়া হয়েছে রাজধানী জাগরেব-এর বিমানবন্দরও।
এখানকার বাসিন্দারা বলেন, আমরা সবাই সতর্কতা মেনে চলছি। গ্লাভস না পরলেও বারবার স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করছি আমরা।
বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থানে স্যানিটাইজার রাখা আছে। যেহেতু এখানে অনেক মানুষ যাতায়াত করছে তাই নিজেদের সুরক্ষিত রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
এছাড়া লকডাউন শিথিল করায় ইউরোপের আরেক দেশ চেক প্রজাতন্ত্রেও খুলে দেয়া হয়েছে বার, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন দোকাট পাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তুরস্কেও শিথিল করা হয়েছে কড়াকড়ি ও নিষেধাজ্ঞা।
প্রতি মুহূর্তেই রূপ বদলাচ্ছে : করোনার মৃদু উপসর্গ কিংবা পরীক্ষার আগেই মারা যাচ্ছেন অনেকে। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, জ্বর সর্দি কিংবা শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা গেলেই করোনায় মৃত্যু- এমন ধারণা সঠিক নয়। তাদের দাবি, এসব উপসর্গ নিয়ে এমনিতেই প্রতিবছর প্রায় আড়াই হাজার লোক মারা যান। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা প্রতি মুহূর্তেই রূপ পাল্টাচ্ছে। তাই এসব উপসর্গ থাকলে দ্রুত শ্বাসকষ্টের চিকিৎসাই একমাত্র সমাধান।
পরীক্ষার পরিসর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে কোভিড-১৯ শনাক্তের সংখ্যাও। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর তালিকা। তবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিন শনাক্তের তালিকার বাইরেও অনেকেই মারা যাচ্ছেন। যাদের অনেকের রয়েছে হালকা উপসর্গ, আবার অনেকের মৃত্যুর পর পজিটিভ বলে শনাক্ত হচ্ছেন। করোনায় মৃতদের দাফনের কাজে যারা যুক্ত তারা বলছেন, পরীক্ষায় পজেটিভ হওয়াদের মধ্যে মৃতের সংখ্যা, উপসর্গ নিয়ে মৃতের অর্ধেকেরও কম। নাম না প্রকাশের শর্তে ঢাকা মেডিকেলের করোনা ইউনিট থেকে জানানো হয়েছে, কিছু রোগী চিকিৎসা শুরুর আগেই মারা যাচ্ছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের এক স্বাস্থ্যকর্মী বলেন, এখন পর্যন্ত করোনা ইউনিটে মোট রোগীর আসছিল ৩২৭জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৫২জন। আর এদের মধ্যে পজেটিভ পাওয়া গিয়েছিল ৯জনের। চিকিৎসা শুরুর আগেই অনেক রোগী মারা যাচ্ছেন।
আল-মারকাজুল ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হামজা শহিদুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক দাফন করা হয়েছে। এরমধ্যে প্রায় একশত এর উপর করোনা পজেটিভ ছিল। আর বাসায় যারা মারা গেছে তাদের করোনা নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। এখনও রিপোর্ট আসেনি। এছাড়া বাকি যারা মৃত্যু বরণ করেছে এর মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন রোগ নিয়ে মারা গেছে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ বলেন, এখন পর্যন্ত ৩৯ জনকে দাফন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১ জন ছিলেন করোনা পজেটিভ। আর বাকিরা মারা গেছে বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে। তাছাড়া অনেকেই আছে করোনা উপসর্গ নিয়ে ৩/৪ দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, শ্বাসকষ্ট কিংবা এসব উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু করোনার সুস্পষ্ট লক্ষণ। যেখানে হাসপাতালগুলোরও কিছু করার থাকে না।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রিদউয়ানউর রহমান বলেন, বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট আছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম লক্ষণ আছে যেমন এর মধ্যে কিছুই নাও থাকতে পারে। এর জন্য এই ভাইরাসকে বলা হয় নটরিয়াস ভাইরাস। এমন কোনো লক্ষণ নেই যে সে করতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় জ্বর, কাশি না হয়েও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। আর সেটার কারণে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, অক্সিজেন কমে যাচ্ছে আর মানুষ মারা যাচ্ছে। আমার মনে হয় সেই জায়গায় চিকিৎসার দরকার আছে। যাদের এই রকম উপসর্গ দেখা যাবে অবশ্যই তাদের হাসপাতালে আসতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, করোনার মতো একই লক্ষণ নিয়ে আগে থেকেই দেশে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার মানুষ মারা যেতেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, টিবির সিমটমওতো আপনার কাশি, বুকের শ্বাসকষ্ট এমনকি হার্টের অসুখ হলেও এই সমস্যা শ্বাসকষ্ট হয়। কাজেই এগুলোকে তো কোভিটের উপসর্গ বলতে পারি না। একই রকম উপসর্গ অন্য অসুখেরও আছে। আর বাংলাদেশে কী আগে মানুষ মারা যায়নি। অসুখে প্রতিদিনই তো আড়াই হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার হালকা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে অবহেলা না করে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সর্বত্র পরীক্ষার বুথ বসানোর ব্যবস্থা করা উচিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। যা করলে দ্রুত সময়ের মধ্যে করোনার সঠিক চিত্র উঠে আসবে বলে মনে করেন তারা।


বিজ্ঞাপন