মো: রফিকুল ইসলাম, নড়াইল: নড়াইলের লোহাগড়ায় ট্রিপল হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে যেন চলছে হামলা-ভাংচুর-লুটপাটের মহোৎসব। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হত্যা পরবর্তী ভাংচুর-লুটপাট, নারী নির্যাতন, এ যেন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। এ রকম একটি গ্রামের নাম ‘গন্ডব’। প্রায় দশ বছর ধরে এখানকার দুটি গ্রাম্য দলের সংঘাত আর হানাহানি চলছে। ধ্বংস হচ্ছে বাড়িঘর আর লুটপাট হচ্ছে অসহায় মানুষের সহায় সম্বল। প্রতিপক্ষের হামলা ও মামলার ভয়ে পুরুষরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। ফলে গ্রামটি রয়েছে পুরুষশূন্য। সরেজমিনে মঙ্গলবার লোহাগড়ার দাঙ্গা কবলিত কাশিপুর ইউনিয়নের গন্ডব গ্রামে ঘুরে ভয়ংঙ্কর এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
পুরুষশূন্য গন্ডব গ্রামের একটু সামনে এগোলেই ওহিদুল ইসলামের বাড়ি। বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, কেউ নেই। বসত ঘরের দরজা-জানালা ও বেড়া ভাঙ্গা। শূন্য পড়ে আছে গোয়ালঘর। মুঠোফোনে কথা হয় তার স্ত্রী রহিমা খাতুনের (২৫) সাথে। তিনি জানালেন, গত ১০ জুন মারামারি হবার পরে রাত সাড়ে ১২ টার দিকে প্রতিপক্ষের অন্তত ৬০-৭০ জন লোক দেশীয় অস্ত্র রামদা, সড়কি ছ্যান’দা নিয়ে বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাকে বেধড়ক মারপিট করে সোনা আর টাকা-পয়সা, মূল্যবান আসবাবপত্রসহ গোয়ালে থাকা তিনটি গর্ভবতী গাভীসহ মোট ৭ টি গরু ও ১১ টি ছাগল লুট করে নিয়ে যায়। প্রতিটি গাভীর দাম ২ লাখ টাকা। সব কিছু ফেলে প্রথম ও তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া দু’টি সন্তান মুগ্ধ ও স্মিগ্ধকে নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন মনিরামপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে।
একই রকম ঘটনা ঘটেছে পাশের আজাদ বিশ্বাসসহ প্রায় শতাধিক বাড়িতে। এসব বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর-লুটপাট করা হয়েছে। ঘরের জানালা-দরজা ও ঘরের চালের টিন খুলে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। আজাদের স্ত্রী পারুল বেগম (৩৮) ফোনে জানান, হামলার ভয়ে তিল তিল করে গড়া সংসার ফেলে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনটি সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন নড়াইল সদর উপজেলার কমলাপুর গ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তিনি খোঁজ-খবর নিয়ে জেনেছেন তার ৪টি গরু ও ৬টি ছাগলসহ বাড়ির সব কিছুই লুটেরা নিয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, গ্রাম থেকে প্রায় শতাধিক টিউবয়েল, সেচের স্যালো মেশিন ও সেচ মোটর লুট করে পাইপের মধ্যে ইট-পাথরের টুকরা ফেলে নষ্ট করে রেখেছে।
ঘটনার পর খোজ নিয়ে জানা যায়, এই কোন্দলের কারণে গন্ডব-চালিঘাট গ্রামের অন্তত ২০-৩০ জন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী তাদের পড়া-লেখা বন্ধ করে মামলা-হামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার কেউ কেউ মামলায় জেল-হাজতে রয়েছেন।
অনেক কষ্টে পালিয়ে বেড়ানো কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেছে, এরা সবাই এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী, কয়েকজন আবার সামনে এইচএসসি দিবে। এদের মধ্যে গন্ডব গ্রামের বুলবুল কাজীর ছেলে নয়ন কাজী ও আজাদ বিশ্বাসের ছেলে আজিম বিশ্বাস, তারা লোহাগড়া সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। লোহাগড়া কলেজের এইচএসসি পরিক্ষার্থী চালিঘাট গ্রামের রউফ মোল্যার ছেলে বাবু মোল্যা জেল-হাজতে রয়েছেন। একদিকে প্রতিপক্ষের হামলা, অন্যদিকে মামলার ভয়। গত ১২ ও ১৪ জুন হওয়া পৃথক তিনটি মামলায় অজ্ঞাতসহ একটি বা দু’টিতে তাদের নাম রয়েছে বলে তারা জেনেছেন।
অপরদিকে লোহাগড়া সরকারী পাইলট স্কুলের এসএসসি পরিক্ষার্থী জাকিয়া সুলতানা, মরিচপাশা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইতি খানম, রসো খানমসহ অনেকের অন্য সবার মতো তাদেরও পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবার কথা থাকলেও সম্ভ্রম হারাবার ভয়ে লোখাপড়া ও টিউটর বাদ দিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। এই মেধাবী শিক্ষার্থীরা সেখানে ঘুমিয়ে দিন-রাত পার করছেন। শুধু তাই নয় মারের ভয়ে অনেক শিক্ষার্থীরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছে। তাদের সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলে জানা গেছে, হামলা আর পুলিশের অজ্ঞাত ধারার ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে ঢাকায় আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছে।
আতঙ্কে আছে লোহাগড়া সরকারি কলেজের এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী আজিম বিশ্বাস। সে জানায়, প্রতিনিয়ত হামলা, লুটপাট-ভাংচুর আর হুমকির ভয়ে সে বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। অন্যদিকে মামলা হবার কারণে পুলিশের ভয়ে বাইরে বের হতেও পারছে না। কলেজ, পড়ালেখা, প্রাইভেট টিউটর সব বাদ দিয়ে অন্যদের মতো সেও এখানে-সেখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
এখানেই শেষ নয় গ্রাম্য কোন্দল থেকে বাদ পড়েনি ঢাকায় পড়ুয়া শিক্ষার্থী, সরকারী-বেসরকারী চাকুরিজীবিসহ স্থানীয় সাংবাদিক। গন্ডব গ্রামের গোলাম রব্বানী শেখের ছেলে রফিকুল ইসলাম ও ইউনুচ শেখের ছেলে জাকিয়া মাহমুদ ঢাকা জগন্নাথ কলেজ ৩য় বর্ষ, আশরাফুল ইসলামের ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি এমবিএ শেষ বর্ষ, হিরু শেখের ছেলে সবুজ শেখ ঢাকা কলেজ ইকোনোমিক্স অনার্স ২য় বর্ষ, আমীর শেখের ছেলে বিপুল শেখ বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি ৩য় বর্ষ, জিল্লু শেখের ছেলে রিয়াজ শেখ তেজগাঁও পলিটেকনিক্যাল কলেজ কম্পিউটার সায়েন্স ৩য় বর্ষ ও রশিদ মীনার ছেলে বায়েজিদ মীনা যশোর এমএম কলেজ ইংলিশ মাষ্টার্স ২য় বর্ষ। ফরিদপুর রাজেন্দ্র সরকারী কলেজের প্রভাষক বিসিএস (শিক্ষা) সালাহউদ্দিন রাজু, নড়াইলে ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত তরিকুল ইসলাম, ঢাকার বেসরকারী সংস্থায় চাকুরিজীবি মৃত আকতার শেখের ছেলে ফরিদ শেখ, রউফ শেখের ছেলে নাজির শেখ, মৃত সরোয়ার শেখের ছেলে ফারদুল্লাহ শেখ ও চালিঘাট গ্রামের শুকুর মোল্যার ছেলে আনিচ মোল্যা, লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার কল্যাণ সহকারী রুমানা ইসলাম ও লোহাগড়া প্রেসক্লাবের যুগ্ন সাধারন সম্পাদক এবং দৈনিক মানবজমিন ও গ্রামের কাগজের লোহাগড়া উপজেলা প্রতিনিধি শাহজাহান সাজু।
কাশিপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি রেজাউল ইসলাম বলেন, চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ও ভিজিডি-ভিজিএফ’র চাল চুরির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সংবাদ প্রকাশ করার কারনে দুদকে মতিয়ারের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। বাদী তার পক্ষীয় লোক হওয়ার সুবাদে সুযোগবুঝে সাংবাদিক সাজুর নাম মামলায় অর্ন্তভূক্ত করিয়েছে। সাজুর বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে পৌর শহরের গোপীনাথপুর গ্রামে।