ধর্ষণের শাস্তি ফাঁসি

আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন

মন্ত্রিসভায় এ সংক্রান্ত খসড়া প্রস্তাব

উপস্থাপন হচ্ছে সোমবার

 

বিশেষ প্রতিবেদক : ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে সোমবার মন্ত্রিসভায় এ সংক্রান্ত খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এ ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর চলতি সপ্তাহেই রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি হতে পারে।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ সংশোধিত হচ্ছে। আইনের ৯(১) ধারায় যেখানে ধর্ষণের সাজা যাবজ্জীবন ছিল, সেখানে মৃত্যুদ- যুক্ত করা হবে। এর আগে বৃহস্পতিবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ও জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণ সংক্রান্ত শাস্তির বিধান সংশোধন করে মৃত্যুদ- যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বর্তমানে জাতীয় সংসদ অধিবেশন না থাকার করণে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রাষ্ট্রপতি বরাবর বিল আকারে সারসংক্ষেপ (সামারি) পাঠানো হবে। এর আগেই সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। পরে তা প্রধানমন্ত্রী হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। রাষ্ট্রপতি ৯৩(১) অনুচ্ছেদের বলে অধ্যাদেশ জারি করলেই তা আইনে রূপ নেবে। এরপর জাতীয় সংসদ অধিবেশন বসলেই প্রথম বৈঠকে এই অধ্যাদেশকে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়া হবে।
এদিকে, বেগমগঞ্জে গৃহবধূর ওপন যৌন নির্যাতনসহ সারাদেশে নারী ধর্ষণ, যৌন সহিংসতা এবং বীভৎস নির্যাতনের বিচারের দাবিতে রাজধানী ঢাকাসহ গোটা দেশ গতকালও উত্তাল ছিল। এদিন রাজধানীর শাহবাগ, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ষষ্ঠ দিনের মতো বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন দল ও সংগঠন। এসব কর্মসূচি থেকে ধর্ষক ও নির্যাতকদের গ্রেপ্তার, দ্রুত বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। আগেরদিন (শনিবার) রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ‘ধর্ষণের বিরুদ্ধে ক্রোধ’ প্রকাশ করেছেন হাজারো মানুষ। ‘প্রজন্মান্তরে নারীবাদী মৈত্রী’র কর্মীরা পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে অবস্থান নেন। যৌন সহিংসতাকে জাতীয় জরুরি অবস্থা বলে ঘোষণা দেওয়া হয় অবস্থান কর্মসূচি থেকে। এ সময় বিনা অনুমতিতে যে কোনো যৌনকর্মকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে ধর্ষণের সংজ্ঞা সংশোধনসহ ১০ দফা দাবি জানানো হয়।
বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠনের সঙ্গে অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দেন কয়েকশ শিক্ষার্থী। প্রথাবহির্ভূতভাবে আয়োজিত এ অবস্থান কর্মসূচিতে কোনো বক্তা ছিলেন না। সবাই একযোগে স্লোগানে স্লোগানে ধর্ষকের বিচার, নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান। এ সময় নিপীড়নবিরোধী ছবি ও প্ল্যাকার্ড আঁকা হয়। বাদ্য বাজিয়ে ‘রাষ্ট্র ও পরিবারে সমান হবো অধিকারে’, ‘না মানে, না’ ফেস্টুন প্রদর্শন করেন অবস্থানকারীরা। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ধর্ষণের প্রতিবাদে আরও বিক্ষোভ করেছে ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, আওয়ামী ওলামা লীগ, মইনীয়া যুব ফোরাম, জাতীয় মহিলা পার্টি, জাতীয় যুব সংহতি এবং আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংগঠন।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র প্রকাশিত পরিসংখ্যানে জানা গেছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৭৫ ধর্ষণ এবং ২০৪ নারী ধর্ষণের অপচেষ্টার শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর মৃত্যু হয় আরো ৪৩ জনের। এছাড়াও ধর্ষিত হয়ে আত্মহত্যা করেন ১২ নারী।
সূত্র জানায়, ধর্ষণের শিকার নারীদের মধ্যে ৮৬২ জন একক, ২০৮ জন সঙ্গবদ্ধ এবং পাঁচজন কীভাবে কী কারণে ধর্ষিত হয়েছেন তার সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। ধর্ষণের শিকার নারীদের মধ্যে আট বছরের কম বয়সী ৬৭, সাত থেকে ১২ বছর বয়সী ১৪০, ১৩-১৮ বছর বয়সে ১৪০, ১৮-২৪ বছর বয়সী ১৬ জন ধর্ষিত হন। অবশিষ্ট ৩৬৫ জনের বয়স জানা যায়নি। গণধর্ষণের শিকার নারীদের মধ্যে সাত থেকে ১২ বছর বয়সী ছয়, ১৩-১৮ বছর বয়সী ৫২, ৯ থেকে ২৪ বছর বয়সী ২২, ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী সাত এবং ৩০ বছরের বেশি বয়সী সাতজন গণধর্ষণের শিকার হন। গণধর্ষণের শিকার ১১৪ জনের সঠিক বয়সের হিসাব পাওয়া যায়নি বলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, শুধু আইন কঠোর করে বা কঠোর প্রয়োগ করে ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না। এর জন্য এই জেনারেশনের মনন পরিবর্তন করতে হবে, মনোজগতের পরিবর্তন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন বিনোদন মাধ্যমে অনেক কিছু থাকে। এসব কন্টেন্ট আমাদের দেশীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আটক অপরাধীরা জানিয়েছে, এসব কন্টেন্ট দেখে তারা অপরাধে উদ্বুদ্ধ হয়। কেউ কেউ সেই অপরাধের কৌশল রপ্ত করে। এগুলোর বেশিরভাগই বিদেশি প্ল্যাটফর্ম। দেশে ব্যবসা সফল হওয়ার জন্য তরুণ প্রজন্মকে লক্ষ্য করে এ ধরনের কন্টেন্ট তারা প্রকাশ করে।
অপরদিকে, শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সরকার কোনো বাধা দেবে না জানিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কিন্তু আন্দোলনের নামে পরিস্থিতি নষ্ট করতে চাইলে, সহিংসতা ছড়ালে; জনগণের জানমালের নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকারকে কঠোর হতে হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তা প্রতিহত করব। আন্দোলনকারীদের ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, অপরাধীরা ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে। বিচারও দ্রুত হবে। কঠোর বিচারের জন্য যুক্তিসঙ্গত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
মন্ত্রী বলেন, বিএনপি বার বার আন্দোলনের ডাক দিয়ে তারা জনগণের সাড়া পায়নি। এরপরও বারবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। তাদের ডাকে মানুষের আস্থা নেই। মানুষের সাড়া না পেয়ে একবার কোটা আন্দোলন, অন্যবার নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ওপর ভর করেছিল। এখন ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ওপর তারা ভর করেছে। বিএনপি যত অপচেষ্টাই করুক তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থতায় রুপান্তরিত হবে। সরকার নারী নির্যাতনসহ যেকোনো অপরাধের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ধর্ষণের সব্বোর্চ শাস্তি নিশ্চিতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জনগণের সম্পৃক্ততা যদি কোনো আন্দোলনে না থাকে, তাহলে সেই আন্দোলন ব্যর্থ হতে বাধ্য।
ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধীদের শাস্তির ব্যাপারে সরকার জিরো টলারেন্সে রয়েছে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। রোববার সচিবালয়ে নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল মোহাম্মদ শাহীন ইকবালের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন গত তিন মেয়াদের সরকার অপরাধীদের ছাড় দেয়নি। ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ থেকে শুরু করে যারা ধর্ষণ ও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত আমরা কোনো কিছুই লুকাইনি। তাদেরকে জনসম্মুখে এনেছি এবং আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এই ব্যাপারে বর্তমান সরকার জিরো টলারেন্সে রয়েছে। তিনি বলেন, সরকার অত্যন্ত দৃঢ় ভূমিকায় আছে। যেকোনো অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে। আইনমন্ত্রী এরইমধ্যে বলেছেন, এই (নারী নির্যাতন) আইন আরও শক্ত করা হচ্ছে। আগামী ক্যাবিনেটে তিনি উপস্থাপন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন।
এর আগে ধর্ষণের প্রতিবাদে তীব্র সমালোচনা করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, শুধু নারী নয়, সরকারের হাতে গোটা দেশ ধর্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশে যে নারী নির্যাতন, ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে গেছে সে বিষয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। এটা একটা বিরল ঘটনা। এই স্টেটমেন্টে বাংলাদেশের মানুষের সম্মান, ইজ্জত মাটির সাথে মিশে গেছে। আজকে এই সরকার শুধু নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ নয়, সমস্ত বাংলাদেশকে ধর্ষণ করছে। এই স্টেটমেন্ট তার বড় প্রমাণ। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে নারী ও শিশু অধিকার ফোরাম আয়োজিত মানববন্ধনে তিনি এসব কথা বলেন।


বিজ্ঞাপন