* ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত
*গণপরিবহনেও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি
*‘হেলাফেলায়’ বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি
*ইউরোপে চলছে সেকেন্ড ওয়েভ
*বিশ্বে মৃত্যু প্রায় পৌনে ১৫ লাখ
মহসীন আহমেদ স্বপন : মার্কিন শীর্ষ সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে আগামী কয়েক সপ্তাহ মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরও বাড়বে। রোববার মার্কিন গণমাধ্যম এবিসি টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অ্যান্থনি ফাউসি জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ছুটির এ মৌসুমে ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সব নির্দেশনা কড়াকড়িভাবে পালনের জন্য তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। অ্যান্থনি ফাউসি বলেন, ‘শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণ বাড়বে। লোকজনকে ভয় দেখানো আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে এটাই বাস্তবতা।’
অন্যদিকে দেশে করোনা সংক্রমণকে সাধারণ রোগ মনে করে হেলাফেলা করায় এখন মাশুল গুণছে সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, এমন ভুল যেন কেউ না করে।
করোনার লক্ষণ দেখা দিলেই নমুনা পরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু করা উচিত বলে মন্তব্য করেন সাধরণ মানুষ।
ডা. ফাউসি জানান, পারিবারিক সম্মেলন এবং ভ্রমণের গুরুত্ব যেমন বোধগম্য, তেমনি এর পরিণতিও সামাল দিতে হবে। ফাউসি বলেছেন, টিকা চলে এসেছে। টিকা গ্রহণ না করা পর্যন্ত সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের সব নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
‘থ্যাংকস গিভিং’ উপলক্ষে কড়া নির্দেশনার পরও যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ লোক ভ্রমণ করেছেন। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আকাশপথে ভ্রমণ করা ছাড়াও সড়কপথে ব্যাপক ভ্রমণ ছিল সপ্তাহজুড়ে। পরিবহন নিরাপত্তা বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দর দিয়ে গত শনিবার এক দিনেই এক কোটির বেশি মানুষ যাওয়া-আসা করেছে। পরদিন রোববার এ মৌসুমের সর্বোচ্চ যাত্রী বিমানবন্দর দিয়ে যাতায়াত করার কথা।
যুক্তরাষ্ট্রে ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষ এখন কোভিড-১৯-এর সংক্রমণের শিকার। সপ্তাহে ১০ লাখের বেশি করে সংক্রমণ বাড়ছে। এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে ২ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
‘হেলাফেলায়’ বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি : রাজধানীর পুরান ঢাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী জামিল উদ্দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণ ও ফুটবল খেলা মধ্যবয়সী এই মানুষটির নিয়মিত রুটিনের অংশ। গত কয়েকদিন ধরে তিনি জ্বর, ঠা-া-কাশিতে ভুগছিলেন। সাধারণ অসুস্থতা মনে করে প্রথমে চার-পাঁচদিন ঘরে বসেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
টানা জ্বর থাকায় স্ত্রীর অনুরোধে কোভিড-১৯ টেস্ট করতে দেন জামিল। নমুনার আইডিতে ভুল হওয়ায় রিপোর্ট হাতে পাননি। সপ্তাহ শেষে সকালে ঘুম ভেঙে শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে দেরি না করে ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যান তিনি।
সেখানে গিয়ে দেখা গেল, অক্সিজেনের মাত্রা নেমে গেছে ৮৩-তে। প্রথমে ৫ লিটার, ১০লিটার ও শেষে ১৫ লিটার অক্সিজেন নেয়ার পরে অক্সিজেনের মাত্রা ৯০-এর ওপরে উঠলেও কিছুক্ষণ পর পর আবার নিচে নেমে যাচ্ছিল।
নিকটাত্মীয়দের ডেকে চিকিৎসকরা জানান, রোগীকে আইসিইউতে নিয়ে হাইফ্লোনজেল যন্ত্রপাতিতে অক্সিজেন দিতে হবে। আইসিইউতে নেয়ার পর হাইফ্লোনজেলে ৪৫-৫০লিটারেও যখন অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক হচ্ছিল না তখন চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে দেখলেন, ফুসফুসে উল্লেখযোগ্য সংক্রমণ হয়েছে।
এরপর চিকিৎসকরা স্বজনদের ডেকে বন্ড সই নিয়ে জানান, যেকোনো সময় রোগীর অবস্থার অবনতি হতে পারে।
গত তিনদিন ধরে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন জামিলউদ্দিন। তিনদিনে সব মিলিয়ে সোয়া দুই লাখ টাকা বিল এসেছে।
তার স্ত্রী বলেন, ‘জীবনের চেয়ে টাকার মূল্যে বেশি না। তাই টাকা গেলেও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামী করোনা সংক্রমণকে সাধারণ রোগ মনে করে হেলাফেলা করায় এখন মাশুল গুণতে হচ্ছে। এমন ভুল যেন কেউ না করে।’
করোনার লক্ষণ দেখা দিলেই নমুনা পরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শুধু জামিলউদ্দিনই নন, তার মতো আরও অনেকেই করোনাকে অবহেলা করে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়ছেন বলে হাসপাতালগুলো ঘুরে জানা গেছে। স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ববিদদের পরামর্শ অনুযায়ী বাইরে বের হলে মুখে মাস্ক পরা, দুই মিটার দুরত্ব বজায় রেখে চলা এবং উপসর্গ দেখে করোনায় আক্রান্ত কিনা তা পরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাসা কিংবা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিলে ঝুঁকি কমে।
কিন্তু মানুষের অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে নতুন রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর হার বাড়ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মার্কেটগুলোতে উপচেপড়া ভীড়, গায়ে গা ঘেঁষে মানুষ চলাফেরা করছে। গণপরিবহনেও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। এদিকে ইউরোপে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ (সেকেন্ড ওয়েভ) চলছে। আগের চেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশেও নমুনা পরীক্ষা, রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু বাড়ছে। তবে রোগী সুস্থতার হারও বেশ আশাব্যঞ্জক।
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ২ হাজার ৫২৫ জনের শরীরে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, যা গত প্রায় তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বর এর চেয়ে বেশি নতুন রোগী শনাক্তের খবর এসেছিল। সেদিন ২ হাজার ৫৮২ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিলো।
সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত শনাক্ত নতুন ২ হাজার ৫২৫ জনকে নিয়ে দেশে মোট ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩২ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। আর ২৪ ঘন্টায় আরো ৩৫ জনের মৃত্যু হওয়ায় দেশে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৪৪ জনে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ১১৮টি ল্যাবে ১৫ হাজার ৩৭২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ২৭ লাখ ৭২ হাজার ৭০১টি নমুনা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে বাসা ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরো ২ হাজার ৫৩৯ জন রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন গত এক দিনে। তাতে সুস্থ রোগীর মোট সংখ্যা ৩ লাখ ৮০ হাজার ৭১১ জন হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ, এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮১ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
এদিকে, দেশের মোট জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতি দশ লাখে শনাক্ত হচ্ছেন ২ হাজার ৭১৫ দশমিক ১৫ জন, সুস্থতার হার ২ হাজার ২২০ দশমিক ৫৪ জন এবং মৃত্যুর হার ৩৮ দশমিক ৮১।
বিশ্বে করোনায় মৃত্যু ছাড়াল ১৪ লাখ ৬৪ হাজার : বিশ্বে একদিনে করোনায় নতুন করে মৃত্যু হয়েছে ৭ হাজার ২৯৯ জনের এবং একই সময়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ লাখ ২ হাজার ৩৩৫ জন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যা ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার সকাল পর্যন্ত বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৬ কোটি ৩০ লাখ ৫৯ হাজার ৩৫৬ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ১৪ লাখ ৬৪ হাজার ৮৪৫ জনের। সুস্থ হয়েছেন ৪ কোটি ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৯ জন।
করোনায় এখন পর্যন্ত সংক্রমণ ও মৃত্যুতে শীর্ষে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তালিকায় শীর্ষে থাকা দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন ১ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার ৪০৪ জন। মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৭২ জনের।
সংক্রমণে দ্বিতীয় এবং মৃত্যুতে তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভারতে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৯৪ লাখ ৩২ হাজার ৭৫ জন এবং মারা গেছে এক লাখ ৩৭ হাজার ১৭৭ জন।
সংক্রমণে তৃতীয় এবং মৃত্যুতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে এখন পর্যন্ত করোনায় ৬৩ লাখ ১৪ হাজারের বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজার ৮৪৮ জনের।
সংক্রমণে চতুর্থ অবস্থানে থাকা রাশিয়ায় করোনায় সংক্রমণের সংখ্যা ২২ লাখ ৬৯ হাজার ৩১৬ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩৯ হাজার ৫২৭ জনের।
সংক্রমণে পঞ্চম স্থানে থাকা ফ্রান্সে এখন পর্যন্ত করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন ২২ লাখ ১৮ হাজার ৪৮৩ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৫৩ হাজার ৩২৫ জন।
গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২১৮টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯।
