নিজস্ব প্রতিনিধি : পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সফিউল্লাহ ও জিয়াউর রহমান একই ব্যাচে কমিশন পেয়েছিলেন তবে ক্রমিক নাম্বরানুযায়ী জিয়ার নামটি ছিল উপরে। তাই জিয়া মনে করতেন ঐ ক্রমিক নাম্বরানুযায়ী তিনি জেষ্ঠ্য। ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান এবং জিয়াকে ডিপুটি চিফ অফ স্টাফ করা হলে জিয়া শেখ মুজিব সরকারের এমন সিদ্ধান্তে খুশি হতে পারেননি। সেনাপ্রধান না হতে পেরে জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন। অথচ পরবর্তীতে দেখা যায় জিয়াউর রহমান নিজে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তিনিও সিনিয়রিটি ভঙ্গ করে সিনিয়র অফিসার জেনারেল দস্তগীরকে টপকিয়ে জেনারেল এরশাদকে সেনা প্রধান করলেন। তিনি নিজে সিনিয়রিটি ভঙ্গের নিয়মে ক্ষুব্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার জন্য খুনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেন অথচ সেই অন্যায় তিনি নিজেও করলেন? একজন মানুষ হিসাবে মেজর জিয়ার এ কেমন মানবিকতা বা নৈতিকতা?

ওসমানীও জিয়াকে ভালো চোখে দেখতেন না। এক সময় সিদ্ধান্ত হয় জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে বার্লিনে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে দেওয়ার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা হয়ে যায়। এটা জেনে জিয়া কর্নেল খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী) ও শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সচিব জনাব তোফায়েল আহম্মেদের তদবিরের মাধ্যমে দূত নিয়োগের সিদ্ধান্তকে স্থগিত করাতে সক্ষম হন। এতেও জিয়া শেখ মুজিবের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না বরং আরও বেশি ক্ষুব্ধ হন।

খালেদকে শেখ মুজিবের বেশি কাছের মনে হত। কারণ খালেদ যখন তখন শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে পারতেন কিন্তু জিয়াকে লাইনে অপেক্ষা করতে হতো। বিদেশে দূত হিসাবে জিয়াকে বার্লিন পাঠানোর কথা শুনে একবার রেগে গিয়ে জিয়া কর্নেল হামিদকে বলেছিলেন,
‘শেখকে ঐ ব্যাটারাই (সফিউল্লাহ-খালেদ) আমার বিরুদ্ধে খেপিয়েছে’।
এখন দেখা যাক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেন জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়ােগ দিলেন না । সে বিষয়ে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নিজস্ব বক্তব্যটি কেমন ছিল। একদিন সেনাপ্রধান পদে নিয়োগ বিষয়ে প্রশ্ন করলে বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিল, “সে অনেক কথা, আমি তো জিয়া, শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ এদের কাউকে চিনি না। তাই ফাইলটা মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ওসমানীকে পাঠিয়ে দিলাম এবং সাজেষ্ট করতে বললাম। উনি বললেন, এদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তাকে সেনাপ্রধান করতে পারেন, সবাই ভালো অফিসার। আমি আবার বললাম, তাহলে বলুন, আপনার মত কে সবচেয়ে ভালো, তারপর কে, তারপর কে? তখন ওসমানী সাহেব বললেন, এরা আমার ছেলের মত, বাবা কি ছেলেদের এক, দুই, তিন নম্বর দিতে পারে? বুঝলাম ওসমানী সাহেব আর কিছু বলবেন না। বাধ্য হয়ে তখন অন্যদের থেকে এদের সম্বন্ধে বেশ কিছু তথ্য নেবার পরে মনে হল, জিয়া অফিসার হিসেবে খুব ভা্লো, কিন্তু হি ইজ পলিটিক্যালি এম্বিশ্বাস (তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ আছে)। বঙ্গবন্ধু আরও বললেন, পাকিস্তানে ইস্কান্দার মীর্জা রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী জে. আইয়ুব খানকে সেনাবাহিনী প্রধান করেছিল। সেই আইয়ুব খানের ক্যু থেকেই পাকিস্তানে আর্মি শাসনের শুরু। বাংলাদেশে আমরা পাকিস্তানের সেই ইতিহাস যদি রিপিট করতে না চাই, তাহলে সেনাপ্রধান নিযোগের সময় এ বিষয়টা বিবেচনা করা দরকার।
এটি ছিল মেজর জিয়ার উপর বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যত বাণী।
ক্রমিক নাম্বরানুযায়ী জিয়াউর রহমান নিজেকে সিনিয়র মনে করতেন, তাই সেনাপ্রধানের পদটি না পেয়ে জিয়া স্বাভাবিক কারণেই মনে আঘাত পেয়েছিলেন। যদিও এসব পদগুলি সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তের উপর অনেকটা নির্ভর করে। তথাপিও সেই আঘাত তার মনে এক সময় প্রচণ্ড বিক্ষোভের সৃষ্টি করে। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন অতি প্রতিশোধপরায়ন ও প্রচণ্ড উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তাঁর মনের এই আঘাত দিয়ে কি করে শেখ মুজিবকে প্রত্যাঘাত করা যায়, তখন থেকেই এ দিকটা নিয়ে তিনি চিন্তা ও পরিকল্পনা করেছিলেন।
সুত্রঃ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ও জেনারেল জিয়া