চালের বাজারে অস্বস্তি

অর্থনীতি জাতীয় বানিজ্য

ধীরে আসছে আমদানি করা চাল

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঊর্ধ্বমুখী চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আমদানির উদ্যোগ নেয় সরকার। দু-মাসের বেশি সময় হয়ে গেলেও খুব বেশি চাল আমদানি করা যায়নি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এখন পর্যন্ত চার লাখ টনের মতো আমদানির চাল দেশের বাজারে ঢুকেছে।
যদিও কিছুদিন ধরে চালের দাম আর ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে না, তবে আগের বাড়তি দাম অনেকটা স্থিতিশীল হয়ে আছে। ফলে এখনো চাল ভোগাচ্ছে, দামের অস্বস্তি কাটছে না সাধারণ মানুষের।
চালের বাজার নিয়ে অনেকটা কৌশলী অবস্থানে সরকার। শুল্ক উঠিয়ে আমদানির গতি বাড়িয়ে চালের দাম একেবারে নামিয়েও ফেলতে চায় না সরকার, কারণ এতে আবার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সবচেয়ে বড় ধানের মৌসুম বোরোকে সামনে রেখে বুঝে-শুনে পদক্ষেপ নিচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
তবে চাল আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, স্থলবন্দরগুলাতে চালের দাম ইতোমধ্যে কমে গেছে। বন্দরে জট থাকায় অতিরিক্ত খরচের কারণে আমদানি করা চালের দাম বেশি পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে বাজারের দামের চেয়ে আমদানি ব্যয় বেশি হচ্ছে। তাই চাল আনতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন আমদানিকারকরা।
সরকারি বাণিজ্য সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বুধবারের বাজারদর অনুযায়ী, কেজিপ্রতি মোটা চালের দাম আগের মতোই ৪৬ থেকে ৫০ টাকা। সরু চালের দাম ৬০ থেকে ৬৬ টাকা।
চালের দাম বাড়তে থাকলে নি¤œআয়ের জনগোষ্ঠীকে সহায়তা এবং বাজারদর স্থিতিশীল রাখতে বেসরকারি পর্যায়ে চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে সরকার।
খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে গত ২৭ ডিসেম্বর বেসরকারিভাবে চাল আমদানির জন্য বৈধ আমদানিকারকদের প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্রসহ ১০ জানুয়ারির মধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে বলা হয়।
খাদ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন শর্তে বেসরকারি পর্যায়ে সর্বমোট ৩২০ ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়। এই অনুমতির চিঠি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির অনুমতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর যারা ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঋণপত্র (লেটার অব ক্রেডিট-এলসি) খুলতে পারেনি, তাদের বরাদ্দপত্র বাতিল করা হয়েছে ইতোমধ্যে।
বেসরকারিভাবে চাল আমদানির জন্য বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যেসব আমদানিকারক এলসি খুলেছেন কিন্তু চাল বাজারজাত করতে পারেননি তাদের এলসি করা সম্পূর্ণ চাল বাজারজাতকরণের জন্য আগামী ১৫ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
খুলনার চাল আমদানিকারক ও কাজী সোবহান ট্রেডিং করপোরেশনের মালিক কাজী নিজাম উদ্দিন সুজন বুধবার বলেন, ‘চাল আমদানির মূল সমস্যা হচ্ছে পোর্টগুলোতে। বন্দরে ভারতের দিকে প্রচুর জ্যাম আছে। জ্যামের কারণে চাল আটকে আছে। ধরেন একটি গাড়ি জ্যামে পড়ে ২০ দিন বন্দরে দাঁড়িয়ে আছে, ওই গাড়িকে প্রতিদিন তিন হাজার রুপি করে ডিটেনশন ফি দিতে হচ্ছে, মোট ৬০ হাজার রুপি দিতে হচ্ছে ২০ দিনে। ওই গাড়িতে যদি ২০ টন চাল থাকে, সেই ২০ টনের প্রতি কেজিতে তিন টাকা করে বেড়ে গেল। কিন্তু বাজারে কেজি প্রতি চালের দাম এখন ৪০-৪২ টাকা। প্রতি কেজি চাল আমদানির খরচ ৪৪ টাকা। তখন তার লস হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘পোর্ট এলাকায় কেজিতে চালের দাম ৪ থেকে ৫ টাকা কমে গেছে। কিন্তু আমরা খুচরা বাজারে এর কোনো প্রভাব দেখছি না। আমরা দেখছি, আমরা আমদানি করে যে চাল বিক্রি করি, খুচরা বাজারে সেটার ১৫ টাকা পার্থক্য হচ্ছে। কেন হচ্ছে এটা আমরা জানি না। আমদানিকারকদের প্রফিট লেভেল ১০ থেকে ২০ পয়সা।’
‘চালের দাম কমে যাওয়ায় অনেক আমদানিকারকের লস হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অনেকে হয়তো আমদানিতে কম আগ্রহী হবে। এই বছর চালের দাম আন্তর্জাতিকভাবেই বেশি। এর ওপর বন্দরে জট থাকায় ডিটেনশনের কারণে পরিবহন খরচ বেশি হচ্ছে। এখন প্রতিটি বন্দরে চালের ট্রাক আটকে আছে। বিক্রি হচ্ছে না। গত দু-দিনে আমাদেরই দুই হাজার ২০০ টনের মতো চাল ঢুকেছে, কিন্তু বিক্রি নেই ৫০০ টনও। বাজারটা পড়ে গেছে।’
নিজাম উদ্দিন সুজন আরও বলেন, ‘গুজব শোনা যায়, ডিউটি বা শুল্ক আরও কমবে। ডিউটি কমলে তো যারা এখন চাল আনছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বন্দরে চাল বিক্রি না হওয়ার অন্যতম কারণও এটা।’
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন, ‘বাজারে প্রতিমণ ধানের দাম এক হাজার ৪০০ টাকার মতো। সেখানে চালের দাম কীভাবে কমবে? এখন উপায় আমদানি বাড়িয়ে দেয়া।’
তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি স্থলবন্দর এলাকায় প্রতি বস্তা চালের দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কমে গেছে। বিক্রিও কম হচ্ছে। কিন্তু খুচরা বাজারে তো প্রভাব দেখছি না। স্থানীয় বাজারে ধানের দাম বেশি থাকায় অনেক মিল ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সরবরাহটা ঠিক রাখতে আমদানিই অব্যাহত রাখতে হবে। তবে বোরো ভালো হলে তখন হয়তো পরিস্থিতি পাল্টাবে।’
সার্বিক বিষয়ে কথা হয় খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা ১০ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টন চাল আনার জন্য বরাদ্দ দিয়েছিলাম, এরমধ্যে এলসি খোলা হয়েছে ছয় লাখ ৮৫ হাজার ৬৬৯ টনের জন্য। যারা গত ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এলসি খোলেনি তাদের বরাদ্দ বাতিল করে এখন নতুন করে আবার বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। যারা এলসি খুলেছে তাদের ১৫ মার্চের মধ্যে চাল বাজারে আনতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ছয় লাখ ৮৫ হাজার ৬৬৯ টনের জন্য এলসি খোলা হলেও দেশে এ পর্যন্ত চাল ঢুকেছে দুই লাখ ৫৫ হাজার ৯২২ টন। আমরা সরকারিভাবে এক লাখ ৩০ হাজার ৮২৯ টন চাল আনতে পেরেছি। যে গতিতে চাল আসার কথা ছিল সেই গতিতে আসেনি।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশে দাম বেড়ে যাচ্ছে। আর আমাদের স্থল বন্দরগুলোতে ভিড় বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীদের তো চাল এনে লাভ করতে হবে। তাই সে চাল আনতে অত উৎসাহিত বোধ করছে না। আগে আমদানি বললেই পরের দিন চলে আসতো। এখন অনেক পণ্য আসে, স্থল ও নৌবন্দর এখন অনেক ব্যস্ত। এখন বিদেশে থেকে ছাইও আসছে।’
‘আমদানির চাল দ্রুত বাজারে যেন আসতে পারে সেজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, রেল মন্ত্রণালয়কে বলেছি। এতে গতি কিছুটা স্মুথ হয়েছে। তবে আমাদের ব্যবসায়ীরা ভাবছেন, চাল বেশি করে আনলে তো এখানকার বাজারটা পড়ে যাবে, এতে আবার লস হবে।’
খাদ্য সচিব আরও বলেন, ‘অন্য দেশের চালের দাম ও অন্যান্য খরচ দিয়ে তারা কতটা লাভ করে এখানে চাল বিক্রি করতে পারবে-সেই বিষয়টি ভেবে তারা (আমদানিকারকরা) হিসাব করে চাল আনছে। আমি মনে করি চালের দামটা এখন আর বাড়ছে না। এভাবে থাকলে কদিন পর কৃষক বোরো ধান কাটবে। সমস্যা থাকবে না বলে মনে করছি।’
নাজমানারা খানুম বলেন, ‘আমরা শুল্ক একেবারে জিরো করে অনেক চাল এনে ২০১৭ সালের মতো করতে পারতাম। এটা আমরা করিনি এ কারণে যে, তাহলে আমাদের কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এক-দেড় মাস পরেই আমাদের আগাম বোরোটা উঠবে, তখন যেন কৃষক ন্যায্যমূল্য পায় সেই ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট সচেতন আছি।’
‘সেজন্য আমরা চাপাচাপি করে চাল ঢুকিয়ে দেব, সেটা আমরা করছি না। যে ফ্লোতে চাল আসছে, সেভাবে এলেই আমরা মনে করি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে’ বলেন খাদ্য সচিব।


বিজ্ঞাপন